জলের জন্য যুদ্ধ! ফুটিফাটা জমিতে ফসল ফলিয়ে তাক লাগালেন জল সহেলিরা...
Jal Sahelis Bundelkhand: কলসিতে জল ভরে, তিনখানা মাথায়, একখানা কাঁখে। সন্ধ্যায় ফের ৩ কিলোমিটার হাঁটা, ফের ৪ কলসি ভরে ফিরে আসা- এই হলো মহিলাদের যাপন।
উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার দুর্গাপুর গ্রামে বাল্যবধূ হয়ে এসেছিলেন তেরো বছরের নীলম ঝা। তারপর যা হয়, প্রতিদিন একই জীবন। ভোরে ওঠো রে, ঘোমটা দাও রে, মুখ ঢাকো রে, চারখানা পেল্লাই কলসি নিয়ে জল ভরতে যাও রে! সে তো আর পাড়ার কলে জল ভরা নয়, প্রতিদিন জল আনতে ৩ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হতো নীলমকে, ফিরতে হতো আরও ৩। গ্রামে জলের একটাই উৎস, একটাই হ্যান্ডপাম্প। লাইনে দাঁড়াতেন। কলসিতে জল ভরে, তিনখানা নিতেন মাথায়, একখানা কাঁখে। সন্ধ্যায় ফের ৩ কিলোমিটার হাঁটা, ফের ৪ কলসি ভরে ফিরে আসা। এমন চলতে চলতে ২০১৫ সালে, ১৮ বছরে পা দিতে না দিতেই প্রথম সন্তান এল পেটে। নীলম গর্ভবতী, কিন্তু তাতে আরাম জোটে না। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। মাথায়, কাঁখে কলসি নিয়ে পরিবারের জন্য জল ভরাই তাঁর কাজ, তাঁর ভবিষ্যৎ। একটা জলের ব্যবস্থা কি করা যায় না বাড়ির কাছাকাছি? আজীবন মেয়েরা এভাবেই সমস্ত কষ্ট সহ্য করে জল ভরে যাবে? প্রশ্ন আসে, উত্তর অন্য পথে পিছলে যায়৷
গ্রামে কল বসানোর চাহিদায় কান দেয়নি কেউই, মেয়েরা এবং মেয়েদের জলের অধিকার স্থানীয় সরকার ও প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকারই নয়। তাহলে? একা নীলম তো নন। উত্তরপ্রদেশের সাতটি জেলা (চিত্রকুট, বান্দা, ঝাঁসি, জালাউন, হামিরপুর, মাহোবা এবং ললিতপুর) এবং মধ্যপ্রদেশের ছয়টি জেলা (ছতারপুর, টিকামগড়, দামোহ, সাগর, দাতিয়া এবং পান্না) নিয়ে গঠিত বারোমাসের খরা-প্রবণ বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের লক্ষাধিক নারীর রোজনামচা এমনই। মন্দির, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত, বুন্দেলখণ্ড জলের অভাব এবং অনাহারে মৃত্যুর তালিকায় উপরে। শিল্পোন্নয়নের অভাবের কারণে, এই অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশই কৃষির উপর নির্ভরশীল। খরা প্রবণ অঞ্চলে কৃষি মানে বোঝাই যাচ্ছে অবস্থাটা আসলে কী!
আরও পড়ুন- মানুষের থেকে জল চাইছে গাছ! গাছের কথা রেকর্ড করে শোনালেন বিজ্ঞানীরা!
'২০৩০ ওয়াটার রিসোর্সেস গ্রুপ' এবং থিঙ্কথ্রু কনসাল্টিং ২০১৯ সালে যৌথভাবে বুন্দেলখণ্ডের জন্য ভিশন ডকুমেন্ট তৈরি করে। সেই তথ্যানুযায়ী, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বুন্দেলখণ্ড ২০৩০ সালের মধ্যে জলহীন অঞ্চল হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। যে অঞ্চলে গড়ে দশ বছরের মধ্যে আট বছরই খরা হয়, সেখানে মহিলাদের জলের অধিকার কোন তলানিতে পড়ে আছে সহজেই অনুমেয়। গ্রামে হ্যান্ডপাম্প চেয়ে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন তাঁরা। তবে একদিন স্বপ্ন সত্যি হয়। গ্রামের বেশ কিছু মহিলা বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে জল সংরক্ষণের মাধ্যমে জলের সংকট কমানোর লক্ষ্যে কাজ করা একটি সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন।
জল সহেলি মডেল
বুন্দেলখণ্ডে মহিলাদের ক্ষমতায়নে এই জল সহেলি মডেলের ভূমিকা যে কী তা বোঝা যায় পুরুষদের দেখেই। জলাশয় পুনরুদ্ধার এবং জলের পরিকাঠামো তৈরির করার লক্ষ্যে মহিলাদের কাজে পুরুষরাও যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। আর এই মহিলা জলযোদ্ধাদের ডাকা হয় জল সহেলি নামে। এই জল সহেলিদের প্রচেষ্টাতেই বুন্দেলখণ্ডের সাতটি (১৩টির মধ্যে) জেলার ১১৩টি গ্রাম জলের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ৩০০ টিরও বেশি গ্রামে হ্যান্ডপাম্প বসিয়েছেন এই জল সহেলিরা।
১৩০০ জন জল সহেলি কাজ করেন এই জল সঙ্কট মোকাবিলায়, সকলেরই পরণে নীল শাড়ি। বুন্দেলখণ্ডের ঝাঁসি, ললিতপুর, হামিরপুর, জালাউন, ছত্রপুর, তিতামগড় এবং মেওয়ারি জেলায় কাজ করছেন এই নীলাম্বরীরা।
জল সহেলিরা নিয়মিত নিজেদের মধ্যে দেখা করেন, আলোচনা করেন এবং স্থানীয় জল সমস্যাগুলি মোকাবিলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। নতুন হ্যান্ডপাম্প বসানো থেকে শুরু করে, মজে যাওয়া পুকুরে প্রাণ সঞ্চার, সেচের জন্য চেক ড্যাম তৈরি সব সিদ্ধান্ত নেন গ্রামের মহিলারাই। স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের পরে জল সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতিটি গ্রামে জল পঞ্চায়েত সমিতি তৈরি করা হয়। প্রতিটি জল পঞ্চায়েতে ২০ থেকে ৩০ জন পুরুষ ও মহিলা সদস্য থাকেন। এই সদস্যরা চার-পাঁচজন মহিলাকে জল সহেলি হিসাবে মনোনীত করেন। সেই নির্বাচিত জল সহেলিরাই গ্রামে জল-সম্পর্কিত কাজগুলি বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দেন।
জল সহেলিরা নিজেরাই কূপ রিচার্জ, চেক ড্যাম তৈরি এবং নদী ও পুকুর পরিষ্কার করা, সীমানা তৈরির কাজ করেন। কানেরি নদী, বড়ুয়া নদী এবং বাচেদী নদী সহ বুন্দেলখণ্ডের অনেক নদীর প্রাণ ফিরিয়েছেন জল সহেলিরাই।
আরও পড়ুন- মিনারেল ওয়াটার আসলে জলহস্তীর প্রস্রাব! জলের এই অদ্ভুত তথ্য চমকে দেবে বিশ্বকে
কীভাবে শুরু হলো জল সহেলির যাত্রা?
বুন্দেলখণ্ডের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই জীবিকা উন্নয়নের লক্ষ্যে পরমার্থ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ শুরু করে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। দেখা যায়, মহিলাদের জল আনতে অনেক দূরে যেতে হয় এবং ফিরতে স্বাভাবিকভাবেই দেরি হয়। এতে পারিবারিক কলহ বাড়ে। এবং চিরাচরিত নিয়মে দোষ গিয়ে পড়ে পরিশ্রম করে ফিরে আসা মহিলাটির ঘাড়েই। মহিলারা জানিয়েছিলেন, সেচের জন্য জল পুরুষদের অগ্রাধিকার কিন্তু পরিবারের খাদ্য এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তা দেখাশোনার ভার তো মহিলাদেরই এসে পড়ে। এই ভাবনা থেকেই মহিলাদের নিয়ে দল গড়া শুরু৷ জলের অধিকার, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মহিলাদেরকেই সামনের সারিতে নিয়ে আসার প্রয়াসে জল সহেলিদের দল গড়ে ওঠে।
২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এই অঞ্চল থেকে অন্যত্র চলে যেত ভালো জীবনযাপনের লক্ষ্যে। এই হার এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। চাষের জন্য পর্যাপ্ত জল মেলে এখন। কৃষকরা তিনবার ফসল চাষ করতে পারেন। এক ফোঁটা জলও নষ্ট হতে দেন না মহিলারা। রান্নাঘর থেকে বর্জ্য জল একটি গর্তে যায় সেই জলেই বাড়ির লাগোয়া সবজি খেতে গাছেরা জল পায়। শাকসবজি কেনার খরচা বাঁচানোর জন্য গ্রামের ৩৮০টি বাড়ির মধ্যে, প্রায় ২৫০টি বাড়িতেই সবজি চাষ হয়। বাড়ির কন্যাশিশুরা জল আনার কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে, নিয়মিত স্কুলে যায় তারা৷ জল প্রকৃতই জীবন, আর জলের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠেছেন মহিলারাই।