আকাশ থেকে নেমে আসে মৃত পাখির ঝাঁক, আজও রহস্যময় জটিঙ্গা

Jatinga Mystery: প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে জটিঙ্গা গ্রামের এই ঘটনা যে-কোনও রহস্য গল্পকে কঠিন প্রতিযোগিতা ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

জঙ্গলের মধ্যে একটি গ্রাম। সূর্যাস্তের কিছু সময় পর চারদিকে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। এমন সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি জঙ্গল থেকে গ্রামের দিকে উড়ে এল। গ্রামের বাড়িগুলির ওপর দিকভ্রান্তের মতো উড়তে শুরু করল তারা। তাদের মধ্যে কিছু পাখি উড়তে উড়তে গাছ অথবা বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়েই মারা গেল। কিছু পাখি মাটিতে নেমে এল। তাদের যেন মানুষের হাতে ধরা পড়ার ভয় নেই অথবা মানুষের হাতে ধরা পড়ার থেকে ভয়ানক কিছু থেকেই তারা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছে। তারা কেমন যেন আনমনা হয়ে রইল। মানুষ তাদের ধরুক অথবা ছেড়ে দিক, তার কিছুতেই যেন তাদের কিছু আসে না। সেই সময় কিছু মানুষ গ্রামের ওপর দিকভ্রান্তের মতো উড়তে থাকা পাখিগুলোকে লাঠি অথবা বাঁশ দিয়ে মারার চেষ্টা করছে। যদি কয়েকটা পাখি মারা যায়, তাহলে সেই পাখির মাংস খাওয়া হবে।

ঘটনা শুনে আজগুবি অথবা আপাতদৃষ্টিতে দেখে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হলেও প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে জটিঙ্গা গ্রামের এই ঘটনা যে-কোনও রহস্য গল্পকে কঠিন প্রতিযোগিতা ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

আসামের ডিমা হাসাও জেলার হাফলং থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম জটিঙ্গা। এই গ্রামের রহস্যময় গল্প শুরু হয় ১৯০৫ সাল নাগাদ। এক সন্ধ্যায় জটিঙ্গার গ্রামবাসীরা একটি হারিয়ে যাওয়া মোষ খুঁজতে বেরিয়েছিল। মশাল হাতে কিছুদূর খোঁজাখুঁজি করার পরেই ঘটেছিল এক হাড় হিম করা ঘটনা। তাদের মনে হয়েছিল, যেন তাদের চারিদিকে মরা পাখির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাহাড় এবং জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের গ্রামবাসীরা দেখেছিল যে, তাদের মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে চলেছে এবং সেই ঝাঁক থেকে বহু পাখি মাটিতে পড়ে মরে যাচ্ছে অথবা মৃত অবস্থায় মাটিতে পড়ছে। ঘটনার ভয়াবহতায় আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা এই ঘটনাকে অলৌকিক ঘটনা বলেই মনে করেছিল। তারা ভেবেছিল যে, আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাটিতে পড়তে থাকা মরা পাখি আসলে অশুভ আত্মার কারসাজি। তাই হারিয়ে যাওয়া মোষের মায়া ত্যাগ করে তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই সব গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন: রহস্যময় বিস্ফোরণের শব্দ, সঙ্গে সবুজ আলো! যোধপুরের সেই রহস্যের কিনারা হয়নি আজও

জটিঙ্গা গ্রামের সেই গ্রামবাসীরা ছিলেন নাগা। তারা যখন গ্রাম ছেড়ে নতুন বাসস্থানের খোঁজে বেরিয়েছিল, তখন রাস্তায় তাদের সঙ্গে নার উপজাতির কিছু মানুষের দেখা হয়েছিল। নার উপজাতির সেই মানুষরাও নিজেদের নতুন বাসস্থান খুঁজছিল। নাগাদের দেওয়া ঘটনার বিবরণ তাদের কাছে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল নাগাদের ফেলে আসা গ্রামের ঠিকানা, যা তাদের নতুন বাসস্থানের খোঁজের সমাপ্তি ঘটাতে পারত। নাগা-দের থেকে শোনা ঘটনাকে ভয় না পেয়ে তারা নাগা-দের ফেলে আসা বাসস্থানকেই নিজেদের বাসস্থান বানাল। গ্রামের মানুষ বদলে গেলেও সেই আশ্চর্য ঘটনা আজও প্রত্যেক বছর যেন নিয়ম করেই ঘটে চলেছে।

বহু বিশেষজ্ঞ আজ অবধি জটিঙ্গার এই ঘটনার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ড. সুধীন সেনগুপ্তর মতে, জটিঙ্গার এই ঘটনার পিছনে কারণ হিসেবে লুকিয়ে রয়েছে আবহাওয়া এবং বায়ুচাপের আকস্মিক পরিবর্তন, ভূচুম্বক এবং মাধ্যাকর্ষণের এক জটিল মিশ্রণ। বর্ষায় বেড়ে যাওয়া জলস্তর, ভৌগোলিক ফাটল, এই এলাকায় পাথরে থাকা উচ্চ-চৌম্বকশক্তিযুক্ত খনিজ পদার্থর উপস্থিতি পাখিদের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে এই ধরনের ঘটনা ঘটায়। জটিঙ্গার এই ঘটনা শুধুমাত্র বর্ষাকালেই ঘটে। অধিক বৃষ্টির ফলে জলস্তর বেড়ে থাকায় পাখিরা বিচলিত থাকে। তার সঙ্গে এই এলাকায় উল্লেখ্য বিভিন্ন কারণে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে এবং তারা অস্থির হয়ে ওঠে। তারা রাতের অন্ধকারে উড়তে শুরু করে। এই সময়ে চৌম্বকত্বর পরিবর্তন তাদের বায়ো কম্পাস বিকল করে দেয়। তখন হয় তারা দিকভ্রান্তর মতো একই এলাকায় উড়তে থাকে অথবা মাটিতে নেমে আসে। তার ফলে তারা সহজ শিকারে পরিণত হয়।

যদিও বিভিন্ন তথ্য এই রহস্যের ঘনঘটা আরও বাড়িয়ে তোলে। জটিঙ্গায় উড়ে আসা পাখিগুলি মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে থাকা একটি গ্রামের দিকে উড়ে যায় না। তারা সবসময় নির্দিষ্ট একটা এলাকায় উড়তে থাকে। এছাড়া ধরা পড়া পাখিগুলি জাটিঙ্গা গিরিশিরার উত্তর থেকেই উড়ে আসে, দক্ষিণ দিক থেকে নয়। যদিও দক্ষিণ দিকেও প্রচুর পাখির বসবাস।

এই গ্রামে ধরা পড়া পাখিগুলি বেশিরভাগ স্থানীয় পাখি হলেও সব স্থানীয় পাখি এই আচরণ করে না। বিখ্যাত পক্ষীবিদ সেলিম আলি বলেছিলেন যে, জটিঙ্গাতে ধরা পড়া পাখিগুলি নিশাচর পাখি নয়। যে পাখিগুলি দিনের বেলায় জেগে থাকে, অন্ধকারে তাদের উড়তে শুরু করার বিষয়টাও সাধারণ নয়, ফলে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

একই সঙ্গে গ্রামবাসীদের হাতে পাখিদের মৃত্যু রুখতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার এইচ. পি. ফুকন। গ্রামের কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন বার্ড ওয়াচার ক্লাব। সেই ক্লাবের মাধ্যমে তিনি মানুষকে পরিবেশে পাখির প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছিলেন। তার ফলে পাখি নিধনের সংখ্যা কমেছিল।

বর্তমানে জটিঙ্গাতে উড়ে আসা পাখির সংখ্যা কমেছে। যদিও এই অদ্ভুত ঘটনার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি।

তথ্য ঋণ: দ‍্য ওয়াল, এই সময়

More Articles