ভক্তের ক্যাচে আউট গুরু বিরাট! বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যেভাবে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন লিটন দাস
Litton Das: কয়েকশো আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্মৃতি নিয়েই আজ তিনি অধিনায়ক। দিনাজপুরের ছোট্ট গলিপথ থেকে ঢাকার রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন লিটন।
রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ। উচ্ছাসে ফেটে পড়ল দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট জনপদ। দিকে দিকে প্রচারিত হল বাংলার বাঘেদের কীর্তির কথা। সাকিব থেকে তামিম- একাধিক নামের জয়ধ্বনি গাইলেন বাংলাদেশের জনতা। বিশ্বজুড়ে প্রশংসায় ভাসলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। জাদুর ভাষায় ‘গিলি গিলি গে’ করে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের থেকে জয় ছিনিয়ে নিলেন তাঁরা। কিন্তু লিটন দাস? বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক। তাঁকে ঘটেও সূচিত হয়েছে আলোচনার অবকাশ। রবিবার রেকর্ড গড়েছেন তিনিও। কোহলি-আউটের বিরাট ক্যাচের উড়ন্ত পদক্ষেপ অবাক করেছে বিশ্বকে! এমনকী লিটনের কীর্তিতে অবাক হয়েছেন আউট হয়ে যাওয়া বিরাট কোহলি নিজেও।
অনবদ্য হয়ে উঠেছেন লিটন। টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে ভালো খেলেছেন তিনি। আবার সেই খেলার প্রশংসা পেয়েছেন তাঁর ‘আইডল’ বিরাটের কাছ থেকে। উপহার হিসেবে পেয়েছেন ব্যাটও। ক্রিকেট খেলা এবং তাঁর সৌজন্যের নজির দিকে দিকে আবর্তিত হলেও লিটন-কথার নেপথ্যে যা রয়েছে তা কিন্তু বারবার নাড়িয়ে দেয় বিশ্বকে। আজ যে দলের অধিনায়ক হয়েছেন তিনি, সেই দলে তাঁর জায়গা নিয়েও বারবার প্রশ্নের সামনে এসেছেন লিটন। বিতর্ক, প্রশ্ন এবং সমালোচনার আবহেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের এই ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের’ ক্রিকেটার।
‘দিনাজপুরের গিলি’
দিনাজপুরের গিলি থেকে অধিনায়ক লিটন দাস। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪। বাংলাদেশের দিনাজপুরে জন্ম হয় লিটনের। ভালো নাম, লিটন বা লিট্টন কুমার দাস (Litton Kumer Das Liton Das)। বাবা বাচ্চু চন্দ্র দাস। মা অনিতা। ছোট থেকেই খেলার দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর, যা বাড়ে দাদা বাপি দাসের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসায়। বাপি বরাবর ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতেন। আর সেই সূত্রেই লিটন দাদার সঙ্গেই যেতেন প্র্যাকটিস দেখতে। দাদাও চাইতেন ভাইয়ের খেলা বাড়াতে। অবশেষে স্থানীয় এলাকায় প্রশিক্ষণ শুরু করলেন লিটন। দাদার পথেই এগিয়ে গেলেন ক্রমশ। প্রথাগত শিক্ষা নয়, বাড়ির কাছের স্কুলে পড়াশোনার প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে লিটন ভর্তি হলেন ঢাকার কাছে অবস্থিত সাভারের ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই চলে গভীর প্রশিক্ষণ, সঙ্গে পড়াশোনাও।
আরও পড়ুন- বাবার মৃত্যু থেকে অধিনায়কত্ব বিতর্ক, সব পেরিয়ে যেভাবে প্রত্যাবর্তন বিরাটের
খেলায় প্রবেশ
লিটন দাস বরাবরই লাজুক স্বভাবের কিন্তু খেলাপাগল ছিলেন বরাবর। কঠিন অধ্যবসায়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল প্রশিক্ষক সামাদ মিঠুর, যাঁর খেলা শেখানোর কৌশল আয়ত্ত করে ফেললেন লিটন। একদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দ্বিতীয় ডিভিশন পর্যন্ত খেলা দাদা বাপি, অন্যদিকে কোচ সামাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন তিনি। একদিকে ক্লাব ক্রিকেট অন্যদিকে জাতীয় দলে খেলার হাতছানি। একের পর প্রতিযোগিতায় ভালো খেলতে শুরু করলেন লিটন। অবশেষে ২০১২ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ঊনিশ দলের হয়ে খেললেন তিনি। ২০১২ এবং ২০১৪, দু'বার এই প্রতিযোগিতায় দেখা গেল লিটনকে। এর সঙ্গেই ২০১৪ সাল নাগাদ লিটন খেললেন রংপুর ডিভিশনের হয়ে। ওই দলের হয়ে, জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিস্ময়কর পারফরম্যান্স দেখা গেল লিটনের। প্রায় ৮৫.৩৩ রানের গড় এবং হাজারের বেশি রান তোলেন ওই এক বছরে। ২০১৪ সালেই লিটনের রংপুর ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয় ওই টুর্নামেন্টে।
জাতীয় দলে প্রবেশ
ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে দেশের নানা প্রতিযোগিতায় নামতে নামতে এবার ডাক আসে জাতীয় দল থেকে। লিটন সুযোগ পান বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলে। ২০১৫-র ১০ জুন, ভারতের বিরুদ্ধে একটি টেস্ট ম্যাচে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম ম্যাচেই নজর কাড়েন লিটন দাস। একই বছরের জুনের ১৮ তারিখ একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। এরপর জুলাইয়ের ৫ তারিখ লিটন দাস খেলা শুরু করেন টি২০ ক্রিকেট।
এরপর জাতীয় দলের অন্যতম উইকেটরক্ষক হিসেবে উঠে আসেন এই ক্রিকেটার। সেখানেও দাগ কাটেন লিটন। মুশফিকুর রহমানের অধিনায়কত্বের আঙিনায় উইকেটরক্ষক হিসেবে দাপিয়ে বেড়ান ২০১৭ থেকে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ওয়েস ইন্ডিজ সফরের লজ্জাজনক হারেও খানিকটা সম্মান বাঁচান এই ক্রিকেটার। ওই সফরের টি২০ ম্যাচে ভালো খেলে সিরিজ সেরা হন লিটন।
২০১৮। এশিয়া কাপের ফাইনাল। বিপক্ষে ভারত। ১১৭ বলের ঝোড়ো ইনিংসে লিটন করেন ১২১ রান। বাংলাদেশকে জিতিয়ে সেদিনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন তিনিই। সাকিব-দোসরে ভারতকে বুঝতে এই ক্রিকেটারের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেন অনেকেই।
২০১৯-এর বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাকিবের সঙ্গে ১৮৯ রানের পার্টনারশিপ এবং সেই ম্যাচ বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার কারিগর হিসেবেও উঠে এসেছিল তাঁর নাম।
২০২০। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতেই ব্যাটে ঝড় তোলেন লিটন। একদিনের ম্যাচে করেন ১২৬ রান। সিলেটের মাটিতে নতুন ইতিহাস গড়েন দিনাজপুরের ছেলে। ওই একই সিরিজে একের পর ম্যাচে রানের পাহাড় তৈরি করেন লিটন।
এরপর ২০২১-এর ওয়েস্টইন্ডিজ সফরেও সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন তিনি। এই বছরের একাধিক সিরিজে দেশের হয়ে ভালো খেলেন তিনি। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে প্রথম শতরান করেন লিটন দাস। ২০২২-এ এসেও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভালো খেলেন লিটন দাস। বারবার বাংলাদেশকে সম্মানের জায়গায় তুলতে তাঁর ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় অন্যতম।
বঞ্চনার নাম লিটন
২০১৫ সাল থেকে জাতীয় দলের হয়ে খেলা এবং ভালো পারফরম্যান্স করার পরেও বারবার খেলার সুযোগ পাননি তিনি। বহুবার দলের সঙ্গে গিয়েও প্রথম একাদশে জায়গা হয়নি লিটনের। উঠেছে বৈষম্যের অভিযোগ। ২০২১-এর নিউজিল্যান্ড সফরের খারাপ খেলার রেশ ছিল বহুদিন। তাঁকে নিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও। একের পর সুযোগ থাকলেও লিটন দাসকে খেলতে হয় জাতীয় স্তরে। বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত পর্যায়ের দলে তিনি খেললেও তাঁকেই বহুকাল খেলতে হয় ক্লাব ক্রিকেটে। তবুও হারেননি, একাধিক বঞ্চনার শিকার হয়েও এগিয়েছেন বারবার।
‘ধর্ম-বিড়ম্বনা'য় লিটন
হিন্দুর ঘরের ছেলে হয়েও বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত দলে কেন তিনি খেলছেন, এ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। তাঁর সতীর্থ সৌম্য সরকারকে ঘিরেও একই বিতর্ক হয়েছিল। এমনকী যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সহঅধিনায়ক করা হয়েছে অনেক পরে, অধিনায়ক করা হয়নি- এই প্রশ্নেও আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সদস্যরা। আবার লিটন দাসের খারাপ পারফরম্যান্স নিয়েও এক শ্রেণির জনতা টেনে এনেছেন তাঁর জাতিগত পরিচয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার এবং ক্রিকেট প্রশাসন প্রায় প্রতিটি বিতর্কেই পাশে দাঁড়িয়েছে লিটনের। এমনকী সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফেও বারবার শুভেচ্ছা পেয়েছেন লিটন। সম্প্রতি একটি শুভেচ্ছা জানিয়েও বিপদে পড়েন লিটন। নবরাত্রি এবং দুর্গাপুজোয় শুভেচ্ছা জানিয়ে কট্টরদের বাক্যবাণে বিদ্ধ হন এই ক্রিকেটার।
আরও পড়ুন- বিরাট-বিতর্কই প্রথম নয়, ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কের নৌকো টলমল হয়েছে বারবার
প্রেমিক লিটন
বরাবর সুদর্শন লিটনের প্রেমে পড়েছেন একাধিক নারী। সিনেমা জগতের কয়েকজন সুন্দরীর সঙ্গেও জড়িয়েছে তাঁর নাম। কিন্তু পুরনো প্রেমকেই মর্যাদা দিয়েছেন লিটন। বহুদিনের প্রেমিকা, বর্তমানে মিরপুরের কৃষিবিদ দেবশ্রী বিশ্বাস সঞ্চিতাকে বিয়ে করেন তিনি। ২০১৯-এর ১৮ জুলাই, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বিয়ে হয় দু'জনের।
বিরাট-প্রেমিক লিটন
লিটনকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ক্রিকেটের ভালোবাসা কে? লিটন আজও বলেন, বিরাট কোহলি। বহুকাল আগেই বিরাট কোহলির ভক্ত তিনি। খেলে শেখেন তাঁকে দেখেই, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এমনই বলেন বারবার। সম্প্রতি ভারতের বিরুদ্ধে ভালো খেলে ভক্ত লিটন প্রিয় সিনিয়রের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন ব্যাট। বিরাট কোহলির দেওয়া সেই ব্যাট তাঁর কাছে অমূল্য, বলেছিলেন লিটন। এমনকী বহুদিন পর বিরাট কোহলির ব্যাটে ঝড় উঠতেই দেশ কাল সীমানা ছাড়িয়ে লিটন লিখেছিলেন ‘গ্রেট’। বারবার ভক্ত হিসেবে নিজেকে বিবর্তিত করেছেন তিনি। রবিবারের ম্যাচে তিনি অধিনায়ক, প্রতিপক্ষ তাঁরই গুরু। কিন্তু পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেই সেই গুরুকে আউট করেছেন তিনি। ক্যাচ ধরেছেন, রেকর্ড গড়েছেন। আবার সেই গুরুই অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছেন ভক্তের দিকে। লিটন এবং বিরাট সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। বারবার প্রতিফলিত হয় এই প্রেমও। আলোচিত হয় দুই ক্রিকেটারের খেলার সম্পর্কের কথা।
কয়েকশো আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্মৃতি নিয়েই আজ তিনি অধিনায়ক। দিনাজপুরের ছোট্ট গলিপথ থেকে ঢাকার রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন লিটন। দাদার স্বপ্ন সার্থক হয়নি কিন্তু ভাই রেখেছেন মর্যাদা। ভাইয়ের সাফল্যে খুশি হয়েই এগিয়ে গিয়েছেন বাপিও। প্রত্যেকদিন নতুন উদ্যমে মাঠে নামেন বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। সাকিবদের ছাড়িয়ে তিনিও হয়ে উঠেছেন অভিনব, অনন্য এবং এক মৌলিক প্রতিভার অধিকারী।