প্রথম বিশ্বকাপেই আগুন ঝরাচ্ছেন ২২ বছরের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার! কে এই জুলিয়ান আলভারেজ?

Julián Álvarez: সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় একটি ছবি। ছবিটি বছর দশেক আগের। সেখানে দেখা যাচ্ছে এক ১১-১২ বছর বয়সী কিশোর মেসির সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সারা বিশ্ব হাঁ করে দেখেছে ফুটবল কাকে বলে! এবারের বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়া। আর্জেন্টিনা বনাম ক্রোয়েশিয়া না বলে বলা যায় এলএমটেন বনাম এলএমটেন। লিও মেসি বনাম লুকা মদরিচ। তবে দিনের শেষে শেষ হাসিটা হাসলেন মেসিই। তিন শূন্য গোলে ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে ফাইনালে উঠে গিয়েছে আর্জেন্টিনা। ২০১৮-র প্রতিশোধ ২০২২-এ নিলেন মেসি। প্রথম থেকেই ম্যাচে বল পজেশন নিজেদের দখলে রেখেছিল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু ফুটবলে শেষ কথা বলে গোল। আর সেইটাই পকেটস্থ করতে সক্ষম হয়েছে আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৩৪ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন মেসি। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপে ১১ গোল করে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হলেন লিওনেল। পাঁচ মিনিট পরেই ক্রোয়েশিয়ার জালে বল জড়িয়ে দেন জুলিয়ান আলভারেজ। এরপর ম্যাচের ৬৯ মিনিটে, ডান প্রান্ত বরাবর মেসির নিখুঁত থ্রু বলে পা লাগিয়ে দলের হয়ে তৃতীয় গোলটিও করেন আলভারেজ। এই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে যদি সবথেকে বেশি কোনও খেলোয়াড় নজর কেড়ে থাকেন তিনি হলেন জুলিয়ান আলভারেজ। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে মেসির থেকে দুটো পাস পেয়ে দুটো গোল করে যিনি এখন শিরোনামে।

কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মক খেলে বাজিমাত করেছিল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু রক্ষণের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেদের তরী ডোবালেন মদরিচ, পেরিসিচরা। প্রথম ৩০ মিনিট বলের দখল বেশি রাখলেও, গোলের সুযোগ বেশি তৈরি করলেও গোলের মুখ খুলতে পারল না তারা। তবে ম্যাচের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচের দখল নিতে শুরু করে আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধের শেষে জোড়া গোল করে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। সেখান থেকে আর ফিরতে পারল না ক্রোয়েশিয়া। এ বারের বিশ্বকাপের সব থেকে ভাল ফুটবল সেমিফাইনালে খেললেন মেসিরা। আক্রমণ থেকে রক্ষণ, নিখুঁত ফুটবল খেলল মেসির দল। বিশ্বকাপে নিজেদের রেকর্ড অক্ষত রাখল আর্জেন্টিনা। ছ'বার সেমিফাইনাল খেলে ছ'বারই জিতল তারা।

আরও পড়ুন- জিতল আর্জেন্টিনা, জাগল ভারত বাংলাদেশ, এই না হলে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল!

এই ম্যাচের ফলে স্পটলাইটে উঠে এসেছেন আর্জেন্টিনার তরুণ ফরওয়ার্ড জুলিয়ান আলভারেজ। মেসির সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া কী দারুণ, তা আর্জেন্টিনার তৃতীয় গোলের ক্ষেত্রেই দেখেছি। মেসিকে অন্য দলের মতো ক্রোয়েশিয়াও জোনাল মার্কিংয়ে রেখেছিল। তিনি বল ধরলেই তিন থেকে চার জন ফুটবলার ছুটে আসছিলেন। কিন্তু তাতেও আটকে রাখা গেল না ‘মর্ডান ডে ফুটবল গড’-কে। মেসিকে মার্ক করলেও, মেসি সুযোগ বুঝে পাস বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন আলভারেজের দিকে। সুযোগ সন্ধানী জুলিয়ান আলভারেজও ভুল করেননি বল জালে জড়াতে। তবে আলভারেজ যে আগামীর সুপারস্টার তা প্রমাণ করে তাঁর প্রথম গোলটি। ৩৯ মিনিটে দলের হয়ে গোলের ব্যবধান বাড়ান আলভারেজ। তিনি যে গোলটি করেছেন তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। ক্রোয়েশিয়ার পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে উঠে, নিজেদের অর্ধে বল ধরে প্রায় ৫০ গজ দৌড়ে যান তিনি। বল নিয়ে সোজা বিপক্ষের বক্সের দিকে ছুটতে থাকেন। বক্সে উপস্থিত ডিফেন্ডাররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের কাজটি করে বেরিয়ে যান আলভারেজ। লিভাকোভিচকে পরাস্ত করে গোল করেন আর্জেন্টিনার বর্তমান ‘নম্বর নাইন’ জুলিয়ান আলভারেজ। কার্যত ক্রোয়েশিয়ার অর্ধে একা ঢুকে গোল করেন তিনি। তাঁকে আটকাতে পারেননি ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডাররা। এরপর ৬৯ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যাচের দ্বিতীয় গোল করেন আলভারেজ। ডান প্রান্তে সাইড লাইনের কাছে বল ধরে ডিফেন্ডারকে ঘাড়ের কাছে নিয়ে এগিয়ে যান মেসি। ‘পায়ের জাদু’ দেখাতে দেখাতে বক্সে ঢোকেন তিনি। তারপর থ্রু বল বাড়িয়ে দেন অরক্ষিত আলভারেজের দিকে। এরপর ডান পায়ে গোল করে ব্যবধান বাড়ান জুলিয়ান আলভারেজ।

স্বভাবতই এই ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন জুলিয়ান আলভারেজ। এরপরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় একটি ছবি। ছবিটি বছর দশেক আগের। সেখানে দেখা যাচ্ছে এক ১১-১২ বছর বয়সী কিশোর মেসির সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই কিশোরটিই হলেন জুলিয়ান আলভারেজ। মেসিকে নিজের সুপারহিরো বলেন আলভারেজ। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর পরিবারের সবাই মেসির ভক্ত। তিনি জানান, ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণা তিনি লিও মেসির থেকেই পেয়েছেন। ১০ বছর আগে মেসির সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ হয়েছিল আলভারেজের। আলভারেজ জানান তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল, মেসির পাশে দেশের জার্সি পরে একসঙ্গে দেশের হয়ে খেলা। এবারের ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে এসে সেই স্বপ্নপূরণ হল। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় আলভারেজের। এবছর ২৯ মার্চ, ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে রেড হট ফর্মে রয়েছেন এই বছর বাইশের তরুণ। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই ছয় ম্যাচে চার গোল করে ফেলেছেন তিনি। আর্জেন্টাইন ফুটবল সার্কিটে আলভারেজকে ভালোবেসে ‘লা আরানা’ বলেও ডাকা হয়।

আরও পড়ুন- মারাদোনার ভূত তাড়া করছে ক্রোয়েশিয়াকে! অবিশ্বাস্য অ্যালভারেজকে দেখে যা বলছে বিশ্ব

২০০০ সালের ৩১ জানুয়ারি, আর্জেন্টিনার কালচেন শহরে জন্ম জুলিয়ানের। আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব ১৯-এর বর্তমান কোচ বাতিস্তুতা জানান, এই তরুণ ফরওয়ার্ডটির মধ্যে একটি দারুণ গুণ আছে যা সচরাচর খেলোয়াড়দের মধ্যে দেখা যায় না। কোনও অ্যাটাক বিল্ড আপ করতে করতেই, পরিস্থিতি অনুযায়ী লাইন অব অ্যাটাকে বদলে ফেলতে পারেন জুলিয়ান আলভারেজ। যা তাঁকে বিপক্ষের জন্য আরও বিপজ্জনক করে তোলে। ২০১৮-১৯ মরশুমে আলভারেজ আর্জেন্টিনার ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করেন। রিভার প্লেটের হয়ে ৯৬ ম্যাচে ৩৬টি গোল করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ২০ দলে সুযোগ পান বিশ্বকাপে। এরপর ২০১৯ সালে সাউথ আমেরিকান অনূর্ধ্ব ২০ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন। এই সময় ফার্নান্দো বাতিস্তুতার সংস্পর্শে আসেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁর খেলা আরও ক্ষুরধার হয় বলে মনে করেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। ২০২২ সালের জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোতে রিভার প্লেট ছেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেন জুলিয়ান আলভারেজ। সেই থেকে ম্যান সিটির জার্সি গায়ে কুড়ি ম্যাচে সাতটি গোল করেছেন তিনি। সমর্থকরা মনে করছেন, পরবর্তী সময়ে লিও মেসির উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাবেন জুলিয়ান আলভারেজই।

 

More Articles