নেপথ্যে অদ্ভুত এক প্রেমকাহিনি! বর্ধমানের বিদ্যাসুন্দর কালীর ইতিহাস আজও রহস্যে ভরা

Kalipuja 2022: একদিন চরের মাধ্যমে তেজচাঁদ বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়ের ব্যাপারে জেনে ফেলেন। খবর কানে যেতেই রাজা প্রচণ্ড রেগে যান। বিদ্যা-সুন্দরের প্রেমের খবর পেয়ে ফাঁদ পাতেন রাজা।

বাংলার ইতিহাস আর সমাজ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে অসংখ্য কালী মন্দির এবং কালী সংক্রান্ত নানা পৌরাণিক ঘটনাবলী। আজ কালীপুজো। প্রতিবছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজো বিশেষ জাঁকজমক করেই পালিত হয়। আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী কালীর আরাধনা করা হয়। আর এই দীপান্বিতা কালীপুজোর সময় ভারতের অন্যান্য জায়গায় মহা সমারোহে দীপাবলি বা দিওয়ালি উৎসব উদযাপিত হয়। মূলত বাঙালি, অসমিয়া ও ওড়িয়ারা দীপাবলির সময় কালীপুজো করে থাকেন।

হিন্দু ধর্মের অন্যতম আরাধ্য কালিকা বা কালীমূর্তিকে নগ্নিকা হিসেবেই দেখা যায়। দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম হলেন কালী। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। প্রকৃত অর্থে কালকে কলন করেন যিনি তিনিই কালী। কালী তাঁর ভক্তদের যেমন রক্ষা করেন, তেমনই মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ করেন। কালী অনন্তের প্রতীক। একদিকে যেমন বিনাশাকারী, অন্যদিকে তেমন সৃষ্টিকারী। কালী তাই শক্তির প্রতীক। দুষ্টের দমনে কালী যেমন রণমূর্তি ধারণ করেন, তেমনই আবার ভক্তের রক্ষার্থে তিনি মমতাময়ী। কালীর এমন মমতাময় রূপের নিদর্শনই মেলে বর্ধমানের বিদ্যাসুন্দর কালীবাড়ির ইতিহাসে।

ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক কালী মন্দির। প্রণাম ঠুকে লুঠপাটে বেরোত ডাকাতরা। কান পাতলে মন্দির ঘিরে শোনা যায় বিভিন্ন লোককথা। দিনের বেলায় সুন্দর নামের এক তরুণ পূজারি উপাসনা করতেন কালীর, তাঁর সঙ্গে রাজকন্যা বিদ্যার প্রেমকাহিনী। বর্ধমান শহর সংলগ্ন দামোদর তীরে তেজগঞ্জে জঙ্গল থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রেমের পথটা সহজ ছিল না। আর সেই প্রণয়ের গল্পই আজকের পুজোর প্রেক্ষাপট।

আরও পড়ুন- কালো বা নীল নয়! অবাক করবে বাংলার এই তিন অঞ্চলের সাদা কালীর কাহিনি

তখন বর্ধমানের মহারাজা তেজচাঁদের আমল। বর্ধমানের বেশিরভাগ এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। বিশেষ করে দামোদর তীরবর্তী তেজগঞ্জ এলাকায় ছিল আরও গভীর জঙ্গল। সেখানেই কালী মন্দিরে পুজো করতেন রাজা। রাজার বিদ্যা নামে এক মেয়ে ছিল। আর রাজবাড়ির পূজারি ছিলেন সুন্দর নামে এক গরীব ব্রাহ্মণ যুবক। সুন্দরের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। রাজবাড়িতে ফুল দিতেন মালিনী নামে এক মহিলা। মালিনীর আনা এক মালা দেখে খুব ভাল লাগে সুন্দরের। তিনি জিজ্ঞেস করেন, মালা কে গেঁথেছে? মালিনী জানান, রাজকুমারী বিদ্যা গেঁথেছেন। সেই প্রেমের সূত্রপাত কীভাবে, তাও শুনিয়েছেন মন্দিরের এক সেবায়েত আভা বটব্যাল। তিনি বলেন, “রাজকুমারী বিদ্যার গাঁথা মালা দেখেই মন্দিরের পূজারির মনে প্রেমভাবের উদয় হয়। পূজারি ভেবেছিলেন, এমন সুন্দর মালা যিনি গেঁথেছেন, তিনি নিশ্চয়ই অতি সুন্দরী!”

আভা জানিয়েছেন, বিদ্যা এবং সুন্দরের প্রেম শুরু হয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। পরবর্তীকালে বিদ্যার সঙ্গে সুন্দরের পরিচয় হয় এবং তাঁদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকী তারা নাকি মন্দিরের পাশ থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ বানিয়ে তার ভিতর দিয়ে একে-অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে যেতেন। কিন্তু তাঁদের প্রণয় খুব বেশিদিন গোপন থাকেনি। একদিন চরের মাধ্যমে তেজচাঁদ বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়ের ব্যাপারে জেনে ফেলেন। খবর কানে যেতেই রাজা প্রচণ্ড রেগে যান। বিদ্যা-সুন্দরের প্রেমের খবর পেয়ে ফাঁদ পাতেন রাজা। ধরা পড়েন প্রেমিক-প্রেমিকা। তিনি বিদ্যা এবং সুন্দরকে কালীর সামনে বলি দেওয়ার আদেশ দেন। সেই সময়ে বর্ধমানের বেশিরভাগ এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি।

কিন্তু ওই কালী মন্দিরে কেউ সচরাচর যেতেন না। কথিত আছে, যারা অন্যায় অত্যাচার করত, তাদের এই মন্দিরে দেবীর সামনে হাঁড়িকাঠে নরবলি দেওয়া হত। তাই সেই সময় এই কালী দক্ষিণ মশান কালী নামেও পরিচিত ছিল। রাজার হুকুম মতো বিদ্যা এবং সুন্দরকে বলি দিতে নিয়ে যাওয়া হয় সেই মন্দিরে। বলি দেওয়ার আগের মুহূর্তে বিদ্যা ও সুন্দর সেই মন্দিরের কাপালিকের কাছে অনুরোধ জানান, মৃত্যুর আগে তাঁরা দেবীকে প্রণাম করে আসতে চান। কাপালিক সেই অনুমতি দেন। প্রণাম করে আসার পর হাঁড়িকাঠে বিদ্যা ও সুন্দরকে ঢোকানোর পর খাঁড়া হাতে বলি দেওয়ার সময় কাপালিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বিদ্যা আর সুন্দর, প্রেমিক–প্রেমিকা যুগল মন্দির থেকে উধাও হয়ে যান। এরপর থেকে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই সময় থেকেই মন্দিরের নামকরণ হয় বিদ্যাসুন্দর কালী মন্দির। তারপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় নরবলিও।

আরও পড়ুন- খাসি বা ইলিশ নয়! ইছামতির গলদা চিংড়ি ভোগে সন্তুষ্ট কৃষ্ণচন্দ্রের সাধের ইটিন্ডার সিদ্ধেশ্বরী কালী

এখানে কালী মন্দির ছাড়াও দুটো শিব মন্দির আছে, যা ভৈরব ও পঞ্চানন্দ নামে পরিচিত। নরবলি বন্ধের পরে মন্দিরে মেষ বলি ও পরে ভেড়া বলি দেওয়া হত। এখন ছাগল বলি দেওয়া হয়। প্রাচীন সেই সুড়ঙ্গ নাকি ছিল তবে এখন নেই, তা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রচলিত এই প্রাচীন অলৌকিক ঘটনা আজও মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। বহু দুর থেকে মানুষ আসেন এই মন্দিরে কালীর দর্শন করতে।

মালা গেঁথে তৈরি হয়েছিল কালীপুজোর গাথা। প্রেমের শক্তিকে পূর্ণতা দিয়েছিল মাতৃশক্তি। বিদ্যা আর সুন্দর একে অন্যের পরিপূরক হয়েছিলেন। সেই থেকে বর্ধমান শহর সংলগ্ন দামোদর তীরে কালী মন্দির পায় বিদ্যাসুন্দরের নাম। কালীর নির্দেশেই বন্ধ হয়েছিল নরবলি। রাজ্যপাট নেই। তবে এখনও প্রাচীন রীতি মেনেই কালীপুজো হয় বলে জানান সেবাইত আভা বটব্যাল। তবে জাঁকজমক আর আগের মতো নেই। কালী এখানে পাষাণ মূর্তি। নিত্যদিন পুজো হয়, সন্ধ্যা আরতি হয়। নরবলি বন্ধ হলেও কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ছাগ বলি দেওয়া হয়।

More Articles