রাজস্থানের এই অলৌকিক গ্রাম থেকে বেঁচে ফেরা কঠিন...

ফেলুদার গল্পে জটায়ু লিখেছিলেন ' সাহারায় শিহরণ।' তবে এ গল্পের নাম হওয়া উচিত ' থর - এ থরহরিকম্প ' - এর গল্প। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম মরুভূমির থর। যার অধিকাংশ স্থান এখনও রহস্যে মোড়া। হ্যাঁ, রহস্য যেন অর্ধাঙ্গিনী থর মরুভূমির । তার বুকে যেমন সাজানো অপার সৌন্দর্যের ডালি, ঠিক তেমনি তাঁকে ঘিরে থাকা রহস্যের পর্দাফাঁস করতে সে যেন অহরহ হাতছানি দিয়ে চলেছে আমাদের। না, পর্যটকরা কখনও থরের সাদর আমন্ত্রণ কে উপেক্ষা করতে পারে না, নিশির ডাকের মতোই থরের হাতছানিকে অবজ্ঞা করার উপায় নেই যে। কিন্তু বারবার পর্যটক, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ বা রহস্যসন্ধানী দল ঘরের মাটিতে পদচিহ্ন আঁকলেও এখনো এখানে অমীমাংসিত থেকে গেছে বেশ কিছু রহস্য। তেমনই এক রহস্যের খোঁজে আজ আমরা কড়া নাড়ব থর মরুভূমির দরজায়।

ধু ধু মরুভূমির বুক চিরে ছুটে চলেছে একটা গাড়ি। আমাদের গন্তব্যস্থল জয়সলমের থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরে। গুগলে যার পরিচিতি ' হন্টেড ভিলেজ ' নামে। না তেনারা আছেন কি নেই সেই বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে আগে শুনে নেওয়া যাক এই 'হন্টেড ভিলেজ' - এর আসল ইতিহাস। কেন আজও অভিশপ্ত এই গ্রাম? লুকিয়ে রয়েছে কোন রহস্য? 

রবীন্দ্রনাথের ' হালদার গোষ্ঠী ' গল্পে আমরা দেখেছিলাম জমিদারতন্ত্রের কদর্য রূপ। যেখানে জমিদারের শোষণ যন্ত্রে প্রতিমুহূর্তে নিষ্পেষিত হয় মধুর মত মেহনতি মানুষরা। এই প্রতিবেদনেও দেখা মিলবে এমনই এক জমিদারের। তবে জমিদার, সামন্ত শাসক, নাকি দেওয়ান সে নিয়ে মতভেদ আছে। নাম তার সালিম সিংহ - আতঙ্কের আর এক নাম সালিম সিংহ, নারীলোলুপ, প্রজাবিদ্বেষী সালিম সিংহ।

গ্রামের নাম কুলধার। গ্রামের প্রতিটি মানুষজন তখন সালিম সিংহের অত্যাচারে ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়ছে। মহিলারা ভুগতে শুরু করেছেন নিরাপত্তাহীনতায়। দিনের বেলায় পথে-ঘাটে বেরোনো দায় হয়ে পড়েছে তাদের। সালিম সিংহের লেঠেল বাহিনী সর্বক্ষণ প্রচন্ড উন্মত্ততায় ছুটে চলেছে গ্রামের প্রতিটি কোনায়। প্রতিদিন নতুন নতুন যুবতী মেয়েদের ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করা একপ্রকার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই অত্যাচারী জমিদার সালিম সিংহের। এ যেন তারাশঙ্করের ' রাধা ' উপন্যাসের অক্রুর সরকার - "  অক্রুর নেহি হাম ক্রুর সরকার হ্যায় ।" নারীদেহের প্রতি সালিম সিংয়ের প্রলোভনের গ্রাফ প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বগামী। এক সময় কুলধার গ্রামের মোড়লের মেয়ের দিকে চোখ পড়লো সালিম সিংহের। কিন্তু বিধি বাম। রুখে দাঁড়াল কুলধার গ্রামের অধিবাসীরা। রবীন্দ্রনাথের 'হালদার গোষ্ঠী' গল্পে জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মশাল জ্বেলেছিল বনোয়ারিলাল, অনেকটা একইরকম ভাবে এবার প্রতিবাদ দানা বাধল সালিম সিংহের বিরুদ্ধে।  এই বিরুদ্ধাচারণ বেশিদিন সহ্য করেননি তিনি। সালিম সিংহের বিরুদ্ধে গলা তোলে অশিক্ষিত প্রজাগুলো? এ যেন মরুভূমিতে মরীচিকার মত। সালিম সিংহ এবার তার লেঠেল বাহিনীকে নির্দেশ দিল বলপূর্বক মেয়েটিকে তুলে আনার জন্য। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলে বাঁকাতেই হবে।

আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশে যোগী বনাম রাবণ, কে এই দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ?

কিন্তু রাখে হরি তো মারে কে? গ্রামবাসীরা শেষপর্যন্ত একরাত সময় চেয়ে নিল সালিম সিংহের লেঠেল বাহিনীর থেকে। আর ওই এক রাতের মধ্যেই জনশূন্য হয়ে গেল কুলধার গ্রাম। হ্যাঁ, গ্রামের মেয়েটিকে অত্যাচারী নারীলোলুপ জমিদার সালিম সিংহের হাত থেকে বাঁচাতে সেই রাতেই লেঠেল বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে একবস্ত্রে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন কুলধার গ্রামের প্রায় পনের'শ অধিবাসী। জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ যেন এক নীরব সংগ্রাম। যার সাক্ষী দিগন্তবিস্তৃত এক মরুভূমি।

গল্প এখানেই শেষ নয়। বরং আসল গল্পের শুরু এখান থেকেই। সেদিন রাত্রিতে মহাকাল যেন গিলে খেয়েছিল সমগ্র কুলধার গ্রামকে। হিসাব মেলেনি - একরাতের মধ্যে এমনভাবে শ্মশান হয়ে গেল কুলধারের মত একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম? তবে এরপরেই কুলধার গ্রামকে নিয়ে শোনা যায় বেশকিছু জনশ্রুতি। জনশ্রুতি হলেও সব রটনা নয়, কিছুক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রমাণও মেলে। এখানে যেন সময় সর্বক্ষণ থমকে আছে, বহু পর্যটক এই ঘটনার পর থেকেই অশরীরীদের দেখা পাওয়ার আশায় ছুটে গেছেন কুলধারার আনাচে-কানাচে। দিনের আলো যত কমেছে, ততই বেড়েছে আতঙ্কের পরিমাণ - কেউ শুনেছেন নুপুরের নিক্কন, কারও কানে গেছে কান্নার আওয়াজ, আবার কেউ গ্রামের গোলকধাঁধায় হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। কখনও বা রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খন্ড খন্ড করে শোনা গেছে অমানুষিক আর্তনাদ। দিল্লির এক প্যারানরমাল সোসাইটি সদস্যরা এই গ্রামে কাটিয়ে এসেছেন একরাত। অশরীরী আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি তাদেরও। সমাধান হয়নি মরু রহস্যের।

এককালের জীবন্ত, প্রাণ-প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ নগরী আজ পরিণত হয়েছে মৃতদের আস্তানায়। ইতিমধ্যে মহাকালের রথের চাকা ঘুরছে বহুবার, যত দিন গেছে রহস্যের কালো পর্দা বিশ্বজগৎ থেকে আলাদা করে ফেলেছে থর মরুভূমির বুকের এই গ্রামকে। আতঙ্ক একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রশাসন বাধ্য হয়েই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এখানে রাত্রিবাসের উপর। আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক মনকে যেন একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কুলধার। আর সেই গ্রামের চার দেওয়ালের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে গুমরে গুমরে মরে অশরীরীদের অব্যক্ত কান্না।

তথ্যসূত্র:-
১. https://www.etvbharat.com/bengali/west-bengal/bharat/bharat-news/kuldhara-an-abandoned-village-of-five-hundred-and-fifty-years/wb20200805070024160
২. https://trell.co/read/the-haunted-city-kuldhara-in-rajasthan-b252ddbbda53/?utm_source=Trell
৩. সুখী গৃহকোণ - গায়ে কাঁটা দেওয়া ভোটের সংখ্যা(১লা নভেম্বর, ২০২০) 
৪. আনন্দবাজার পত্রিকা - ১৩ই আগস্ট ২০১৯
৫. ' রাজস্থানের এই গ্রামে গেলে কেউ বেঁচে ফেরে না ' - সংবাদ প্রতিদিন।

More Articles