কোথাও ঘট, কোথাও সরা, গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে কীভাবে পূজিত হয় লক্ষ্মী
Lakshmipuja: শুধু প্রতিমা নয়, গ্রামবাংলার বুকে লক্ষ্মী বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন।
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আর এই ঘরে থাকো আলো করে...
গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে কাল পূজিত হবেন মা লক্ষ্মী। ধনে-সম্পদে, প্রাচুর্যে যাতে সারাবছর ঘর আলো হয়ে থাকে- এই আশাতে মায়ের আরাধনা করা হয় এই পূর্ণিমায়। ঈশ্বরী পাটনির মতো আজকের সাধারণ মানুষও চান তাঁদের উত্তরপুরুষ যেন থাকে দুধে-ভাতে। তাই প্রতি বৃহস্পতিবার করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হলেও আশ্বিনের এই পূর্ণিমাতে মাকে যেন আহ্বান করে ঘরে ডেকে আনা হয়। তিনি কোথাও কন্যা, কোথাও বউ আবার কোথাও মা রূপে পূজিতা হন। তবে শুধু প্রতিমা নয়, গ্রামবাংলার বুকে তিনি বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাঙালির আবেগ। জড়িয়ে থাকে চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো পিটুলির আলপনার ইতিহাস।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঠিক সময় হলো সন্ধেবেলা। শাস্ত্রমতে কথিত আছে, পূর্ণিমার রাতে আলো-আঁধারিতে এই হাতে দেওয়া আলপনা দেখেই মা লক্ষ্মী বুঝতে পারেন, কোন বাড়িতে তাঁর আরাধনা হচ্ছে। আর সেইমতো সেই বাড়িতে এসে তিনি অধিষ্ঠান করেন। অর্থাৎ, এককথায় আলপনা হলো মা লক্ষ্মীকে আগমনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো। তাই এই বিশ্বাস থেকেই যুগ যুগ ধরে সম্পদের দেবীর আরাধনায় আলপনা দিয়ে আসছেন বাড়ির গৃহিণীরা। এই আলপনার মধ্য দিয়েই উঠে আসে গ্রামবাংলার নানা চালচিত্র। তাঁদের দৈনিক জীবনযাপন, এবং মা হিসেবে সন্তানকে আগলে রাখার কাহিনি। কোথাও আবার কন্যারূপে মা লক্ষ্মীকে বাড়ির গৃহিণী আগলে রাখছেন, সেই চিত্রও। সাধারণত মা লক্ষ্মীর প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে পুজো করার নিয়ম চালু থাকলেও গ্রামবাংলার অনেক জায়গাতেই মূর্তি ছাড়াও বিভিন্ন নিয়মে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।
আরও পড়ুন: বিধবার কামনায় ব্রাত্য ধন দৌলত, ঐশ্বর্য! লক্ষ্মীপুজোয় আজও একঘরে ‘স্বামীহীনা’রা
আড়ি লক্ষ্মী
গ্রামবাংলার বহু গৃহস্থবাড়িতে সাবেক প্রথা মেনে আড়ি লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। একটি ছোট বেতের ঝুড়ি বা কুনকেতে নতুন ওঠা ধান ভরে, ধানের ওপরে লাল চেলিতে মুড়ে বউ সাজানো হয়, সঙ্গে রাখা হয় দু'টি সিঁদুরকৌটো। এই ঝুড়িটিকেই মা লক্ষ্মীর শস্যদাত্রী ও সৌভাগ্যদাত্রী রূপ এবং বাড়ির গৃহিণী হিসেবে কল্পনা করা হয়। আসলে প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামবাংলায় শস্য রাখার ঘর বা গোলাঘরকে মা লক্ষ্মীর বাসস্থান হিসেবে ভাবা হতো। এই ধানভর্তি কুনকেটিই এক্ষেত্রে সেই গোলাঘর বা মা লক্ষ্মীর প্রতীক। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সন্ধ্যালগ্নে গৃহবধূরা উপবাস করে, জলচৌকিতে প্রতিষ্ঠা করা আড়ি লক্ষ্মীকে যথোপচারে পুজো করা হয় এবং পুজোশেষে মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা ও পাঁচালি পাঠ করা হয়।
লক্ষ্মীর ঘট
এগুলি আসলে পোড়ামাটির ঘট। শস্য-সম্পদের দেবী মা লক্ষ্মীর মুখ-সম্বলিত পোড়ামাটির ঘটে চাল বা নদীর জল ভরে ঘটটিকে মা লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে জলচৌকিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ঘটটিকে মা লক্ষ্মী কল্পনা করে ভক্তিভরে যথোপচারে পূজা করেন গৃহবধূরা।
বেরি লক্ষ্মী
এই পুজোতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো নবপত্রিকা।নবীন কলাগাছের ছাল লম্বা ও সমান করে কাটার পর, ছালগুলিকে পাকিয়ে নারকেল গাছের নতুন কাঠি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এভাবে ন’টি বেড় তৈরি করা হয়। কলাগাছের বেড়গুলির গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হয়। এরপর জলচৌকিতে আলপনা দিয়ে তার উপর ন’টি চোঙাকৃতি বের রাখা হয়। বেড়গুলিতে পাঁচ প্রকার শস্য ভরা হয়। একত্রিত বেড়গুলির ওপর একটি শিষ-ডাব রেখে বেরগুলিকে লাল চেলি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। এভাবেই অবয়ব ধারণ করেন ‘বেড়’ লক্ষ্মী। এরপর বাড়ির গৃহিণীরা সংসারের মঙ্গল-কামনায় নিষ্ঠাভরে মা লক্ষ্মীর আরাধনায় ব্রতী হন।
লক্ষ্মী সরা
বাংলার শিল্প-নির্দশন, ঐতিহ্য ধরা পড়ে এখানে। গ্রামবাংলার পটচিত্রে মা লক্ষ্মী বিরাজ করছেন কয়েক শতাব্দী ধরে। পটশিল্পীদের তুলির টানে এই দিন মা আসেন ঘরে। ওপার বাংলায় মাটির সরায় মা লক্ষ্মীর ছবি এঁকে সেই ছবিকে পূজা করা হয়। মা লক্ষ্মীর চিত্র-সম্বলিত মাটির সরাগুলিকে বলা হয় ‘লক্ষ্মী সরা’। তবে কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গেই নয়, পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গাতেও কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন, লক্ষ্মীসরা প্রতিষ্ঠা করে লক্ষ্মীপুজোর চল আছে। প্রায় প্রতিটি সরাতেই মা লক্ষ্মীর সঙ্গে বিরাজ করেন জয়া-বিজয়া ও বাহন লক্ষ্মীপ্যাঁচা। কখনও কখনও লক্ষ্মীসরায় উঠে আসেন সপরিবার মা দুর্গা, এমনকী, রাধা-কৃষ্ণও। আর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এই পটচিত্রর শিল্পীরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও সাজিয়ে তুলেছেন দেবী লক্ষ্মীকে। এখানেই মিলেমিশে গেছে সমস্ত ধর্মীয় বেড়াজাল।
সপ্ততরী
গ্রামবাংলার অনেক জায়গায় লক্ষ্মীর আসনে সপ্ততরী বসিয়ে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। সপ্ততরী আসলে সাতটি কলার পেটো দিয়ে তৈরি সাতটি নৌকা। সেই নৌকাগুলিতে রাখা হয় হলুদ, চাল, ডাল, হরিতকি, খুচরো পয়সা ও টাকা। প্রাচীনকালে জলপথে নৌকোর মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য চলত, আর কে না জানে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’! বড় বড় বণিকেরা সপ্তডিঙা ভাসিয়ে বাণিজ্যে যেতেন। সম্ভবত সেই প্রেক্ষাপট থেকেই 'সপ্ততরী’-কে মা লক্ষ্মী হিসেবে পুজো করার প্রথা শুরু হয়েছিল।