১০ দিন আগেও হত্যার চেষ্টা করেছিল নাথুরামরা, পুলিশের গড়িমসিই গান্ধী খুনের অন্যতম কারণ?

Assassination of Mahatma Gandhi : ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির আগেও তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল! বহুদিন ধরেই সেই পরিকল্পনা তৈরি করছিল নাথুরামরা।

৩০ জানুয়ারির বিকেল। ভারতের নানা প্রান্তে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকবে মানুষ। কেউ পড়াশোনা, কেউ বা চাকরি, কেউ আবার কপালে হাত দিয়ে ভবিষ্যতের চিন্তা করবে। একু ফাইভ স্টার রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে দিনটা ‘উদযাপন’ করবে, কারোর পেটে দুটো দানা ভাতও পড়বে না। দিল্লির বিড়লা মন্দির এলাকাতেও হাওয়া বইবে রোজের মতো। অনেকেই আসবেন এই বিশেষ দিনে, ঘুরবেন, তারপর চলে যাবেন। একটা সময় অন্ধকার হবে, ঘুমিয়ে পড়বে দেশ। আর বিড়লা মন্দির চত্বরের হাওয়ায় অস্ফুটে ভেসে বেড়াবে একটাই কথা – ‘হে রাম’। খড়ম পরা পায়ের শব্দ, লাঠির পাশাপাশি জোরে শোনা যাবে গুলির শব্দ। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ৭৫ বছর আগে। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, দিল্লির এই বিড়লা হাউজ দেখেছিল মহাত্মা গান্ধীর রক্ত…

সাদা থান, কৃশকায় চেহারা, শ্যামলা বর্ণের মানুষটির সঙ্গে কোনও অস্ত্র ছিল না। লাঠি হাতে নিজের জোরেই হেঁটে যেতেন, জীবন কাটাতেন একেবারে সাধারণ ভাবে। অথচ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সাদা খাদির থান পরা মানুষটির অবদান কতখানি, তা নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই। মোহনদাস করমচাঁদ থেকে মহাত্মা গান্ধী হওয়ার যাত্রা আসলে ভারতের সভ্যতারই এক অংশ। গোটা বিশ্বের কাছে তিনি এক প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক, দার্শনিক চরিত্র। তাঁর অনেক সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা যায়। কিন্তু দিনের শেষে সভ্যতার ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর অবদান তো ভোলার নয়। অহিংসায় বিশ্বাসী সেই মানুষটিই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখলেন একের পর এক হিংসা। তাঁর মৃত্যুও তো সেই হিংসার ছবিই দেখল!

আরও পড়ুন : পথের নাম নৈরাজ্য, মৃত গান্ধী জীবিত গান্ধীর চেয়েও শক্তিশালী যেভাবে

গান্ধী হত্যার প্রাককথন

মহাত্মা গান্ধী হত্যার কাহিনি কেবল একটি দিনের নয়; সেই ঘটনাটিকে দেখতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকটা দিন। ধর্মের ভিত্তিতে একটা দেশ ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল, সেটা কখনই চাননি মহাত্মা গান্ধী। তাঁর আদর্শ, স্বপ্ন এক লহমায় ভেঙে খান খান হয়ে গেল। এখান থেকেই ভারতে একটু একটু করে সামনে এল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। আজকের ভারত ও বিজেপির রাজনীতির ছবিটা তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে যেমন ছিলেন গান্ধী-নেহরু-জিন্নাহ, তেমনই ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তাঁর সঙ্গেই ছিল আরএসএস, এবং ‘হিন্দু রাষ্ট্র দল’ নামে এক চরমপন্থী প্রতিষ্ঠান।

birla house delhi memorial

এখানেই ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল

‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এর হিড়িক বোধহয় তখন থেকেই আরও প্রকটভাবে সামনে আসে। সেখানে অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে থাকেন বিনায়ক সাভারকর। সেখানেই যোগ দেয় মদনলাল পাওহা, নারায়ণ আপ্তে, বিষ্ণু কারকারের মতো বেশ কয়েকজন যুবক। এই তরুণদের স্বপ্নই ছিল ভারতের মধ্যে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করার। এই দলেই ছিল আরও এক মারাঠি যুবক। নাম, নাথুরাম গডসে।
প্রত্যেকেই একেবারে সাধারণ যুবক। হয়তো এলাকার মানুষ আর পরিবারের লোকজন বাদ দিয়ে সেভাবে কেউ চিনতও না। প্রত্যেকের চিন্তাভাবনা একই। নাথুরাম নিজে উগ্র হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা চালাত। তবে হঠাৎ করেই গান্ধী হত্যার পরিকল্পনা করা হয়নি, সেটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির আগেও তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল! এমনকী, বহুদিন ধরেই সেই পরিকল্পনা তৈরি করছিল নাথুরামরা। কিন্তু কেন?

আরও পড়ুন : ভারতীয় টাকায় কেন গান্ধীর ছবি রাখা হল? অনেকেই জানেন না এই তথ্য

১৯৪৮, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ ও গান্ধী হত্যার পটভূমিকা

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হয় ও স্বাধীনতা লাভ করে। এক বছর পূর্তির আগেই এই দুটো দেশ প্রথম যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। যার পটভূমি ছিল কাশ্মীর। সেই যুদ্ধের পরও ঝামেলা কমেনি। কেন? পাকিস্তান সরকারের প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ভারতের কোষাগারে ছিল। সেই টাকা যুদ্ধের পর ফেরত চায় পাকিস্তান। কিন্তু ভারত সেটা দিতে রাজি হয়নি। নেহরু সরকারের ভয়, এই টাকা দিলেই ওরা অস্ত্র কিনে আক্রমণ করবে।

এই গোটা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন মহাত্মা গান্ধী। এমনিতেই দেশভাগের পরিকল্পনা থেকে তিনি নিজের দলের ওপর খাপ্পা। এমন ভাঙাচোরা দেশের স্বপ্ন, দাঙ্গা, রক্ত তো তিনি চাননি। তার ওপর স্বাধীন হওয়ার পরই প্রতিবেশী দুটি দেশ যুদ্ধে নামল। তারপর পাকিস্তানের টাকা আটকে রাখল ভারত। সরাসরি এই ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বললেন মহাত্মা গান্ধী। হকের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তিনি। এও বললেন, অন্যায় করা হচ্ছে। এরপর তিনি নিজে শুরু করলেন অনশন! খোদ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে! দিল্লির বিড়লা হাউজেই তখন থাকেন মহাত্মা। অনশন নিয়ে সেখানে সরগরম পরিবেশ।

এই ব্যাপারটিই পছন্দ হল না সাভারকার, নাথুরাম, মদনলালদের। হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষেপে উঠলেন রীতিমতো। এমনিতেই গান্ধীজির অনেক নীতিই ছিল তাঁদের না-পসন্দ। তার ওপর এই অনশনই ছিল আসল ট্রিগার। ঠিক হল, আর নয়। এবার মহাত্মা গান্ধীর যাওয়ার সময়। তখন থেকেই হত্যার পরিকল্পনা শুরু হল।

আরও পড়ুন : “আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি”, মৃত্যুর একদিন আগেই নিয়তির আঁচ পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?

প্রথম প্রচেষ্টা

৩০ জানুয়ারি নয়, প্রথমে ঠিক হল ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হবে। বিড়লা হাউজে অনেক মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে ভজন করেন গান্ধীজি। নিরিবিলি পরিবেশ, অনেকেই আসেন ‘বাপু’-র সঙ্গে দেখা করতে। এটাই সুযোগ। সেইমতো তৈরি হল নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে, মদনলাল পাওহারা। সঙ্গে থাকল বোমা আর পিস্তল। ২০ জানুয়ারি পরিকল্পনা মতো বোমা ছুঁড়ল মদনলাল। কিন্তু ব্যর্থ সেই প্রচেষ্টা। চারিদিক ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, ছোটাছুটি শুরু হল। সেই পরিস্থিতি দেখে বাকিরাও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গান্ধীজির গায়ে আঁচটুকুও লাগল না। মাঝখান থেকে মদনলাল পাওহাকে গ্রেফতার করা হল। বাকিরা পালিয়ে গেল মহারাষ্ট্রে।

Mahatma Gandhi Death

মহাত্মা গান্ধীর মরদেহ

পুলিশি তদন্তের গড়িমসি, গান্ধীজির ‘জেদ’

এই ঘটনার পরই নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা শুরু হল। পুলিশের বক্তব্য, যে করেই হোক মহাত্মা গান্ধীকে রক্ষা করতে হবে। চারিদিকে নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হল। পুলিশ চৌকি বসানোর প্রস্তাবও দেওয়া হল। কিন্তু গান্ধীজি বেঁকে বসলেন। বিড়লা হাউজ চত্বরে কোনও পুলিশ চৌকি বসবে না। তাহলে অন্তত এক-দুজন পুলিশ থাকুক? গান্ধীজির দাবি, পুলিশ আশেপাশে থাকলেও তাঁরা কাউকে বিরক্ত করবেন না। কোনও তল্লাশি হবে না। অগত্যা সেটাই করা হল।

আরও পড়ুন : তাঁকে ছাড়া অচল ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, দেশ ভুলেছে মহাদেব দেশাইকে 

পরে বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা বলেছেন, ৩০ জানুয়ারির ঘটনার জন্য পুলিশও নিজের দায় এড়াতে পারে না। কারণ, মদনলাল পাওহা-কে গ্রেফতার করার পর লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন সমস্ত পরিকল্পনা, আর কারা রয়েছে এর পেছনে, সবটা জেনে যায় পুলিশ। তারপরও ধরপাকড় শুরু হয়নি। তদন্তের কাজে অত্যন্ত গড়িমসি দেখানো হয়েছিল। ২০-র পর ৩০ জানুয়ারি – মাঝে ১০ টি দিন। পুলিশের হাতে সময় ছিল অনেক। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি তারা।

শেষ প্রহর

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। এবার বিড়লা হাউজ চত্বরে একাই উপস্থিত হয়েছেন নাথুরাম গডসে। পরনে খাকি একটা জামা, আর প্যান্ট। একেবারে সাধারণ চেহারা। বিকেল তখন পাঁচটা বেজে সতেরো মিনিট। বিড়লা হাউজের প্রার্থনা মঞ্চে নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পরে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁকে ঘিরে মানুষের ভিড়। গান্ধীজির পাশে তাঁর দুই নাতনি। হঠাৎই তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নাথুরাম। নমস্কার জানিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল। নাতনি মনু এগিয়ে এসে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে গেলেই এক ঝটকায় সোজা হয়ে যায় নাথুরাম। মনুকে ঠেলে সরিয়ে পকেট থেকে বের করে পিস্তল। পরপর তিনটে গুলি সোজা চালিয়ে দিল মহাত্মা গান্ধীর বুকে। আশেপাশে কোনও চিকিৎসক নেই। রক্তে লাল হয়ে গেল গান্ধীজির সাদা পোশাক। লুটিয়ে পড়লেন তিনি, সঙ্গে একটাই কথা - ‘হে রাম’। মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরই সব চুপচাপ…

More Articles