ঘরের ভেতর ভেসে রয়েছে বিশাল 'ঝুলন্ত স্তম্ভ', অন্ধ্রপ্রদেশের যে মন্দিরের রহস্য আজও সমাধান হয়নি
Lepakshi Temple Andhra Pradesh : সেরকমই এক রহস্যময় ইতিহাস হল অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষী মন্দির। যার প্রতিটি গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রহস্য…
একটা সময় বিদেশিরা ভাবতেন, প্রাচ্যের দেশ ভারতের পথেঘাটে মূল্যবান সম্পদ পড়ে থাকে। সেইসঙ্গে গোটা দেশেই নাকি জাদুচর্চা করা হয়। রহস্যময় এক অবয়ব দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল এই দেশটিকে। এসব অবশ্য প্রাচীন যুগের কথা। কিন্তু সত্যিই বড়ো অদ্ভুত দেশ এই ভারত। তার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র ইতিহাস। প্রতিটা মন্দির, প্রতিটা পুরনো বাড়ির ইটের সঙ্গে যেন জুড়ে রয়েছে পুরনো দিনের গল্প। সেইসঙ্গে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। যে রহস্যের সামনে আজও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেরকমই এক রহস্যময় ইতিহাস হল অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষী মন্দির। যার প্রতিটি গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রহস্য…
পুরাণ মতে বলা হয়, অন্ধ্রপ্রদেশের এই ঐতিহাসিক লেপাক্ষী মন্দির তৈরি করেছিলেন অগস্থ্য মুনি। মূলত এটি বীরভদ্র মন্দির হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বীরভদ্র, অর্থাৎ শিবের এক রুদ্র অবতার। মন্দিরের প্রধান দেবতাও তিনি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে গণেশ, বিষ্ণু, কালী সহ আরও বেশ কয়েকজন দেবদেবী পূজিত হন। এই মন্দিরেই রয়েছে প্রায় ১৫ ফুট উঁচু ও ২৭ ফুট দীর্ঘ নন্দীর মূর্তি। বলা হয়, ভারতের সবচেয়ে বড়ো নন্দী মূর্তি নাকি এটাই।
কিন্তু পুরাণ সরিয়ে বাস্তব ইতিহাস দেখলে উঠে আসবে ভারতের সভ্যতার জয়যাত্রার কথা। ১৬ শতকের ইতিহাস। আরও ভালো করে বললে আনুমানিক ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ। ভারতের দক্ষিণে তখন বিজয়নগরের রাজা অচ্যুত দেবরায়ের শাসনকাল। তাঁরই দুই পারিষদ ছিলেন বীরান্না ও বীরুপান্না। সম্পর্কে তাঁরা দুই ভাই। তাঁরাই এই লেপাক্ষী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পাথরের এই মন্দির ও বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সামনে দাঁড়ালে আজও মুগ্ধ হতে হয়। পাথর কেটে খোদাই করা মন্দির, তার গায়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ, ভাস্কর্য, স্থাপত্যরীতি – সমস্ত ছবিটাই মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে।
আরও পড়ুন : হার মানল তাজমহল, গিজার পিরামিডও! মায়াপুরে বিশ্বের বৃহত্তম মন্দিরের অন্দর চোখ ধাঁধাবেই
কিন্তু মন্দিরের নাম লেপাক্ষী কেন? এখানেও জুড়ে আছে পুরাণ। জড়িয়ে আছে রামায়ণের কথা। কথিত আছে, লেপাক্ষী মন্দিরের এই অঞ্চল দিয়েই রাবণ সীতাকে নিয়ে পুষ্পক রথে করে লঙ্কায় যাচ্ছিলেন। সেই সময় রাবণকে আক্রমণ করে জটায়ু। আকাশপথেই শুরু হয় ব্যাপক যুদ্ধ। শেষমেশ রাবণের তরোয়ালের আঘাতে দুটি ডানা ছিন্ন হয়ে যায় জটায়ুর। তখন আকাশ থেকে একটি মন্দির চত্বরে এসে পড়েন তিনি। রাম এসে রক্তাক্ত, গুরুতর জখম জটায়ুকে দেখে বলেন, “লে পক্ষী!” তেলেগু ভাষায় এর অর্থ, ‘পাখি, তুমি ওঠো।’ বলা হয়, জটায়ু নাকি এই মন্দিরের অঞ্চলেই এসে পড়েছিলেন। সেখান থেকেই এর নাম ‘লেপাক্ষী মন্দির’।
আরও পড়ুন : হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা
এবার আসা যাক আসল রহস্যে। বীরভদ্রের মূল মন্দিরের বাইরেই রয়েছে নাটমন্দির। গ্রানাইট পাথর কেটে তৈরি এই নাটমন্দিরও আমাদের চোখ ফেরাতে বাধ্য। এখানেই দেখা যায় আশ্চর্য এক জিনিসের। নাটমন্দিরের ভেতর রয়েছে বিশাল বড়ো মোট ৭০ টি থাম। সেই থামের গায়েও কারুকাজ করা। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, একটি বিশেষ থামের একেবারে নিচের অংশটি ফাঁকা! ফাঁকা মানে, ওই স্তম্ভের নিচের অংশে কিছু নেই। কার্যত ঝুলছে! অনায়াসে একটি কাপড় বা কাগজ গলে যাবে সেখান দিয়ে! এমনকী, চাইলে হাতও ঢুকিয়ে দিতে পারেন। সমস্ত থামের পাশে এই থামটি কেন এমন অসম্পূর্ণ? কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে?
সঠিকভাবে বলতে গেলে, এখনও এই বিষয়টি রহস্যই রয়ে গিয়েছে। শতকের পর শতক ধরে একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির। নাটমন্দিরের বিশেষ একটি থাম অসম্পূর্ণ; তবুও সেটি পড়ে যাচ্ছে না! এমনটা কেন, তার সদুত্তর নেই। আর এই ব্যাপারটিই রহস্য আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মন্দিরের কারুকাজ তো বটেই; বিশেষ এই ঝুলন্ত থামও মুখ্য আকর্ষণ। দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। একবার অন্তত এই থামের নিচ দিয়ে কাপড় বা কাগজ গলিয়ে দেন। কারণ স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই থামের নিচ দিয়ে কিছু গলিয়ে দিলে সৌভাগ্য আসে।
আরও পড়ুন : একই ঘরে একসঙ্গে বসবাস করেন শিব-বুদ্ধ, দার্জিলিংয়ের এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যে ইতিহাস
তবে যাবতীয় মিথের আড়ালে সত্যিটা কী? এটা পরীক্ষা করার জন্যই ১৯২৪ সালে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষী মন্দিরে আসেন। সঙ্গে আনেন লোহার রড। স্তম্ভটির তলায় রডটি ঢুকিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়! অন্যান্য স্তম্ভ তো বটেই; গোটা নাটমন্দিরটিই কাঁপতে শুরু করে। সেইসঙ্গে ভেসে আসে অদ্ভুত একটি শব্দ! প্রাচীন এই মন্দির হয়তো পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে, এই ভয়ে সেখান ঠেক এপালিয়ে বাঁচেন ওই ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু মন্দিরটির কোনও ক্ষতিই হয়নি।
তাহলে স্তম্ভের গড়ন কেন এরকম? গবেষকদের ধারণা, এই থামের জন্য হয়তো ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পায় এই লেপাক্ষী মন্দির। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত হওয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। তাই এই সম্ভাবনা সামনে এনেছেন গবেষকরা। কিন্তু আসল কারণ কী, তা এখনও জানা যায়নি। যেমন জানা যায়নি লেপাক্ষী মন্দিরের ভেতর বিশালাকার পায়ের ছাপের রহস্য। যেন কোনও দৈত্য ওই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল! কার পায়ের ছাপ, সেটা আজও রহস্য থেকে গিয়েছে। ইতিহাস, স্থাপত্য, সৌন্দর্য ও রহস্য – সবকিছুর মেলবন্ধনেই আজও দাঁড়িয়ে আছে এই লেপাক্ষী মন্দির। অন্ধ্রপ্রদেশে ঘুরতে গেলে এই মন্দিরে যাওয়া চাইই চাই।