২৫৬ বছরের জীবনে মোট ২৩ বার বিয়ে! চিনের এই 'রহস্যময়' বৃদ্ধ আসলে কে!
Li Ching-Yuen 256 Years old China : ২৫৬ বছর ধরে একজন বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলেন, দেখলেন নানা ওঠাপড়া, এটা কি আদৌ বিশ্বাস করা যায়?
ভারতীয় পুরাণের বিভিন্ন কাহিনিতে অমরত্ব লাভের কথা বলা হয়েছে। মহাবলী হনুমান থেকে পরশুরাম – খুঁজলে এরকম বেশ কয়েকজন পৌরাণিক চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যাবে, যারা অমর হয়েছিলেন। যতদিন মহাবিশ্ব থাকবে, ততদিন তাঁরাও বেঁচে থাকবেন। সেসব কাহিনি শুনতে শুনতে অনেকেই কল্পনায় বিভোর হয়ে যায়। শিশু থেকে কিশোর, সবার মনেই প্রশ্ন আসে, তাহলে সত্যিই অমরত্ব লাভ করা যায়? বাস্তবে আদৌ কি সেটা সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়! তখনই শোনা যায় দীর্ঘশ্বাসের শব্দ; অমর হতে পারলে মন্দ হতো না…
অমরত্ব না পেলেও, দীর্ঘায়ু পেয়েছেন এমন মানুষ কিন্তু অনেকেই রয়েছেন। ভারতেই বেশ কয়েকজন মানুষ এখনও জীবিত আছেন যাঁদের বয়স ১০০-র গণ্ডি পেরিয়েছেন। বিশেষ করে চিন এবং জাপানে বয়সের সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন অনেকেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য জাদুকাঠির ছোঁয়ায় অনেকেই দীর্ঘায়ু লাভ করছেন। কিন্তু সেটাও খুব বেশি হলে কত বছর? ১০০, কখনও ১১২ বছর। কিন্তু ২৫৬ বছর ধরে একজন বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলেন, দেখলেন নানা ওঠাপড়া, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? নয় নয় করে ২৫৬ বছর পর্যন্ত কি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? এই সমস্ত প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন লি চিং ইউয়েন (Li Ching Yuen)।
ইতিহাস বলছে, ১৯৩৩ সালে মারা গিয়েছেন চিনের সিচুয়ান প্রদেশের এই রহস্যময় ব্যক্তি। চোখ মুখের চামড়া একেবারে কুঁচকে গিয়েছে, এক ঝলক দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কত বয়স? এই একটি প্রশ্ন নিয়ে বহু বছর ধরে চলেছে নানা তরজা। আর সেটাই লি চিং ইউয়েনের কাহিনিকে ‘কিংবদন্তি’ করে তুলেছে। আগেকার দিনে ভোটার কার্ড, পাসপোর্টও ছিল না, সেইসঙ্গে কোনও বার্থ সার্টিফিকেট জাতীয় কোনও শংসাপত্রও ছিল না। তাই পারিবারিক দলিল, স্থানীয় মানুষ, পরিবারের কথা কিংবা ওই ব্যক্তির স্মৃতি – গ্রামীণ এলাকায় জন্মসালের দলিল বলতে এসবই ভরসা। লি চিং ইউয়েনের পারিবারিক দলিলপত্রের সন্ধান পাওয়ার পর দেখা যায়, সেখানে তাঁর জন্মসাল লেখা আছে ১৬৭৭! তার মানে মৃত্যুর সাল থেকে হিসেব করলে দাঁড়াবে ২৫৬ বছর!
আরও পড়ুন : সুচিত্রা বলতেন ‘দুষ্টু ছেলে’, ডার্লিং মুনের প্রেমে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম আমি…
প্রথম ধাঁধাঁ লাগে এখানেই। একজন মানুষ কী করে ২৫৬ বছর অবধি বাঁচতে পারেন? কল্পবিজ্ঞানের সাহিত্য বা সিনেমার পর্দা হলে ব্যাপারটা একরকম। কিন্তু এ যে ঘোরতর বাস্তব! এও বলা হয়, বিংশ শতকের তিরিশের দশকে চিনের ওই এলাকার বৃদ্ধ মানুষদের ঠাকুরদারাও নাকি তরুণ লি চিং ইউয়েনকে দেখেছেন। এদিকে খোদ ইউয়েন নাকি একসময় বলেছিলেন, তাঁর জন্মসাল ১৭৩৪। তাহলেও সংখ্যাটি নেহাত কম দাঁড়াচ্ছে না। একজন মানুষের এতগুলো বছর ধরে বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকা, কিংবদন্তির যাত্রা শুরু এখান থেকেই।
কিন্তু, কে এই লি চিং ইউয়েন?
চিনের সিচুয়ান প্রদেশের বাসিন্দা এই ব্যক্তির মূল পেশা ছিল ভেষজ ওষুধ বিক্রি। খুব অল্প বয়স থেকেই ইউয়েন এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের আয়ুর্বেদের মতো চিনের প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে ভেষজ গাছপালার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অজস্র গাছপালায় ঘেরা এই পৃথিবী। প্রকৃতিই তাদের লালনকর্তা, সেই প্রকৃতিই তাদের ভেতর বিভিন্ন ‘শক্তি’ দিয়েছে। কোনও রাসায়নিক নয়, বরং এই বিপুল গাছপালার শরণাপন্ন হলে শরীর মন দুটোই সুস্থ থাকবে। চিনের প্রাচীন শাস্ত্র এমন কথাই বলে। অজস্র উদ্ভিদ রয়েছে, যাদের বিভিন্ন অংশের ঔষধি গুণ বিভিন্ন। সেসবের জ্ঞানই নখদর্পণে ছিল লি চিং ইউয়েনের। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে সংগ্রহ করতেন এসব।
সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। মাশরুম। চিনের প্রাচীন শাস্ত্রে এই মাশরুমকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শরীরে শক্তি দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ মোকাবিলায় সাহায্য করে এটি। দেহে যৌবন ধরে রাখে। সেই মাশরুমের বিশেষজ্ঞও ছিলেন লি ইউয়েন। তবে এছাড়াও আরও একটি কাজ করতেন তিনি। ক্যারাটে ও মার্শাল আর্ট চিনের ঐতিহ্য; এখন গোটা বিশ্বে সমাদৃত। এই মার্শাল আর্টেরই একজন প্রশিক্ষক ছিলেন লি চিং ইউয়েন। এমনকী, চিনের সেনাবাহিনীতেও একসময় মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স কত ছিল জানেন? ৭১ বছর! অবশ্য ২৫৬ বছরের মানুষের ক্ষেত্রে সেটি ‘যৌবন’ই বটে!
আরও পড়ুন : কে এই মহিলা? চিনা গুপ্তচর নাকি! দলাই লামার জীবন নিয়ে কেন আশঙ্কা ভারতের
কী করে এতদিন বেঁচেছিলেন লি চিং ইউয়েন?
যৌবন ধরে রাখার বড় ওষুধ লুকিয়ে রয়েছে আমাদের জীবনেই, এমনটাই বারবার বলতেন লি চিং ইউয়েন। তাঁর জীবনের একটি তথ্য সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়েছে। একটা দুটো নয়, দীর্ঘ এই জীবনে মোট ২৩টি বিয়ে করেছিলেন লি! আর তাঁর সন্তানদের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। তবে ২৫৬ বছর ধরে নিজের যৌবন ও যৌন জীবন যে অটুট ছিল, সেটা বলাই বাহুল্য। তাহলে কি এটাই তাঁর লম্বা আয়ুর ‘সিক্রেট’?
লি চিং ইউয়েন বারবার বলেছিলেন, মন আর শরীরের খুশি থাকাটাই সব। যদি আনন্দে থাকা যায়, পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর আহার করা যায়, তাহলে দীর্ঘায়ু লাভ করা সম্ভব। নিজের ২৩ জন স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর জীবনও নিশ্চয়ই বেশ আনন্দেই ছিল! তবে এসবের বাইরেও ভেষজ ওষুধ, মাশরুম আর পরিমিত আহারও তাঁর আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রধানত গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা লি চিং ইউয়েন দূষণের সম্মুখীন হননি সেভাবে। প্রকৃতিই ছিল তাঁর আশ্রয়। সেইসঙ্গে ছিল মার্শাল আর্ট। শরীর, মন দুটোই সতেজ করার কথা বলেছেন লি ইউয়েন। ‘সতেজ’ যে ছিলেনই, সেটা তাঁর বিয়ের সংখ্যা দেখে সহজেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন : চিনা ভাষায় ‘আই লভ ইউ’ বলে শুরু হয়েছিল বাংলার প্রথম আইটেম সং! চমকে দেবে সেই ইতিহাস
সত্যিই কি ২৫৬ বছর অবধি বেঁচেছিলেন লি চিং ইউয়েন?
আপাত দৃষ্টিতে দেখলে, একেবারেই অবিশ্বাস্য একটি বিষয়। কিন্তু চিনের অনেকেই লি চিং ইউয়েনের এই কিংবদন্তিকে সত্যি বলে মানেন। তিরিশের দশকে চিনেরই এক অধ্যাপক একটি তথ্য সামনে আনেন। তথ্যটি আসলে চিনের রাজ পরিবারের সরকারি নথি। সেখানে দেখা গিয়েছে, ১৮২৭ সালে লি চিং ইউয়েনের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সম্মাননা জানানো হয়েছে। হিসেব অনুযায়ী, আরও ১০৬ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। ঘুরেফিরে সময় থামছে সেই ১৬৭৭ আর ১৯৩৩-এ। তার ওপর যত দিন যায়, কিংবদন্তির গল্পের ভেতর নানা মিথ ঢুকে পড়ে। যা আড়াল করে দেয় আসল সত্যিকে। যে কোনও প্রবাদ হয়ে যাওয়া গল্পের ক্ষেত্রেই এটি খাটে। লি চিং ইউয়েনের জীবনও যে ব্যতিক্রম নয়, সেটাই বা কে বলতে পারে?