সবচেয়ে কম বেতনের কোচ তিনি, মেসিদের বিশ্বকাপ জয়ের রূপকথার সওদাগর স্কালোনি
FIFA World Cup 2022 : আর্জেন্টিনার ভক্তরা ম্যাচ জেতার পর মজা করে একটা কথা বলছেন। “এর আগে আমাদের একটা লিওনেল ছিল, এখন দুটো লিওনেল”।
কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামের মহারণ তখন থেমে গিয়েছে। চারিদিকে উৎসব, আনন্দ আর কান্নার রেশ। মাঠের মাঝে থাকা মঞ্চে এক এক করে পুরস্কার নিচ্ছেন এমি মার্তিনেজ, কিলিয়ান এমবাপে, লিওনেল মেসিরা। পরাজিত ফ্রান্স রানার্স আপ মেডেল পাওয়ার পর পালা বিজয়ী আর্জেন্টিনার। ৩৬ বছর আগে মারাদোনা, এবার মেসি। একে একে পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠছেন আর্জেন্টিনার তারকারা। সকলের মুখে হাসি, উদ্দীপনা, ঝকঝকে মুখে স্বপ্নপূরণের আলো। হঠাৎই চোখ গেল মঞ্চে উপস্থিত একজনের দিকে। গলায় ঝোলানো আর্জেন্টিনার নীল সাদা কাপড়। নায়কোচিত মুখ একদম শান্ত। আনন্দ থাকলেও তা চাপা পড়ে আছে। মেডেল নেওয়ার পর এগিয়ে গেলেন বিশ্বকাপের দিকে। একবার হাত রাখলেন। ভালো করে অনুভব করলেন। তারপর আবার একটি কোণের দিকে চলে গেলেন লিওনেল সেবাস্তিয়ান স্কালোনি।
জেতার মুহূর্তের পরও ডাগ আউটের এক কোণে দাঁড়িয়ে কেঁদে চললেন আর্জেন্টিনার কোচ। একসময় মেসিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মুখে একটাই কথা, বিশ্বকাপ ফাইনাল যতটা মেসি, দি মারিয়া, মার্তিনেজের, ততটাই লিওনেল স্কালোনির। প্রায় ৭৫ মিনিট অপ্রতিরোধ্য ফরাসি ব্রিগেডকে বোতলবন্দি করে রাখলেন। রক্তের স্বাদ পাওয়ার আগে এমবাপে কার্যত হারিয়ে গিয়েছিলেন মাঠ থেকে। ডেম্বেলে, জিরৌয়ের মতো আক্রমণ ভাগের তারকাকে ম্যাচের ৪০ মিনিটেই তুলে নিতে বাধ্য হলেন ফরাসি কোচ। যে গ্রিয়াজমানের পা থেকে খেলা তৈরি হচ্ছিল, তাঁকেও কিছু করতে দিলেন না অনেকটা সময়। স্কালোনি নীরবে থাকা সেই শিক্ষকের মতো, কোনির ক্ষিদ্দা। শান্ত সুশ্রী মুখে দাঁড়িয়ে ম্যাচ দেখবেন, খেলোয়াড়দের সঙ্গে লড়বেন, জেতার পর রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখবেন চোখ। একটু একটু করে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসবেন। গোল খেলো মাথা থাকবে শান্ত। গোল করলে বা ম্যাচ জিতলে কোনও বাঁধ ভাঙা উন্মাদনা নেই। ঠিক যেন নীল সাদাদের 'ক্যাপ্টেন কুল'। বড়ো দাদা, যে সব কিছু মুখ বুজে মেনে কাঁধের ওপর হাতটি রাখবেন।
আরও পড়ুন : এটাই শেষ নয়, পরের বিশ্বকাপও খেলবেন বিশ্বজয়ী মেসি?
অথচ শুরুর দিকে এই লিওনেল স্কালোনিকে নিয়েই সন্দিহান ছিল আর্জেন্টিনা। সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ফুটবল বিশ্ব। দিয়েগো মারাদোনা, আলেজান্দ্রো সাবেল্লার পর ২০১৭ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন জর্জ সাম্পাওলি। তখন তিনি লা লিগার দল সেভিয়ায় কোচিং করাচ্ছেন। মেসিদের দায়িত্ব পাওয়ার পরই সহকারী কোচ হিসেবে নিয়ে এলেন লিওনেল স্কালোনিকে। বয়স তখন ছিল মাত্র বছর চল্লিশ। কোচিং কেরিয়ারের কোনও ছবিই নেই। সেই ব্যক্তিকে কিনা মেসিদের জন্য আনা হল?
সমালোচনার ধার বাড়ল এরপর থেকে। ২০১৮-র রাশিয়া বিশ্বকাপেও খালি হাতে ফিরতে হল মেসিদের। তারপর সাম্পাওলি সরে যাওয়ার পর মহা ফাঁপরে পড়ে আর্জেন্টিনা। কেন? এখন ভালো, নামী কোচ আনতে গেলে তো অনেক টাকা দরকার। অনেক বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু তখন আর্জেন্টিনা ছিল অর্থসংকটে। বেশি অর্থ দিয়ে নামী কোচ আনা মানে হারাকিরি। তাহলে? শেষমেশ ফের ভরসার পাত্র হয়ে উঠে এলেন স্কালোনি। তিনি নিজে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন, ২০০৬ বিশ্বকাপে মেসির সতীর্থও ছিলেন। তিনি এই দলটির প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু এতবার স্থানীয় কোচ এনেও তো সাফল্য এল না। দিয়েগো মারাদোনাও পারলেন না ২০১০ সালে। আর স্কালোনি তো সেরকম পরিচিত মুখও নন, দক্ষতাও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু কম খরচে এছাড়া আর উপায়ও নেই। শেষমেশ অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হলেন স্কালোনি। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে সমালোচনা হবে। ফলাফল না দেখাতে পারলে ছিঁড়ে খাবে জনগণ। প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করবে মিডিয়া। একটি সাক্ষাৎকারে এই পুরো ব্যাপারটিই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তবুও নিজের কাজ করে যাবেন, সেটাই আসল কথা, বলেছিলেন স্কালোনি।
আরও পড়ুন : প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বজয়! কেন রূপকথাকেও হার মানাবে মেসিদের এই যাত্রা?
২০১৯-এর কোপা আমেরিকাতেও ব্যর্থ হয় আর্জেন্টিনা। তারপর থেকে শুরু হল স্কালোনি অধ্যায়। তিনি বয়সে নবীন, এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের হাল হকিকত জানেন। পুরনো খেলোয়াড় যারা আশানুরূপ খেলা খেলছেন না, তাঁদের বাদ দিলেন তিনি। বদলে নিয়ে এলেন নতুন নতুন মুখ। তৈরি করলেন নতুন একটি আর্জেন্টিনা। মেসি জাহাজ, তাঁর সঙ্গে থাকবেন এই তরুণ তুর্কিরা। প্রথমে সবাই নাক সিটকোলেন। কিন্তু পুরো পরিস্থিতিই বদলে গেল ২০২১-এ। কোপা আমেরিকায় এই দলটিই ট্রফি ছিনিয়ে আনল। তাও ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে! মেসির স্বপ্নপূরণের সেই শুরু। দিন ঘোরার শুরু স্কালোনিরও। দুটো পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। সৌদি আরবের কাছে পরাজয়ের আগে টানা ৩৬টি ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপে এসেছিল আর্জেন্টিনা। আর লিওনেল স্কালোনির কোচিংয়ে ৫৭টি ম্যাচ খেলেছে আর্জেন্টিনা। ৩৯ টি জয়, ১৩ টি ড্র; আর হার? মাত্র পাঁচটি...
এই বিশ্বকাপের আগেও স্কালোনির নাম সেভাবে সামনে আসেনি। বিশ্বকাপ জেতার পরও তিনি ব্যাকফুটে। শুধু কেঁদেই চলেছেন। তাঁর সঙ্গে কাঁদছেন আরও বহু সমর্থক। দেশের জার্সি গায়ে মেসির স্বপ্নের পারফরমেন্স, দি মারিয়ার উত্থান। পাশাপাশি ডিফেন্সে ওটামেন্ডির ভরসা। তবে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হল, এবারের আর্জেন্টিনার একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। জুলিয়ান আলভারেজ, ম্যাক অ্যালিস্টার, রড্রিগো দে পল, লাউতারো মার্তিনেজ, পাবলো ডিবালা, গঞ্জালো মন্ত্রিয়েল, মোলিনা… তালিকা অনেকটাই লম্বা। মেসি নির্ভর খেলা নয়, বরং মেসিকে সামনে রেখে সবাই মিলে একসঙ্গে খেলা। মেসিকে সামনে রেখে সেই টিমগেমকেই সামনে আনলেন স্কালোনি। গোলে রিজার্ভে রয়েছেন আরমানি। আর মাঠে খেল দেখাচ্ছেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। কোপা আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপ, তাঁর হাত, অঙ্গভঙ্গি, সাহস চমকে দিয়েছে সবাইকে। আর এই তরুণদের এগিয়ে আনার অন্যতম কাণ্ডারি লিওনেল স্কালোনি।
আরও পড়ুন : সেনাপতি মেসি, সঙ্গে বিশ্বস্ত মার্তিনেজ, যে মন্ত্রে ফাইনালে স্বপ্নপূরণ আর্জেন্টিনার
আর ট্যাকটিক্স? সেমি ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে মাঝ মাঠে খেলতে দিয়ে ট্র্যাপে ফেলা। তারপর প্রতি আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়ে ফালাফালা করে দেওয়া। মেসি আর আলভারেজের সামনে দাঁড়াতে পারেননি ক্রোটরা। ফাইনালের ৭৮ মিনিটের আগে পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে দুর্ভেদ্য লাগছিল। অসাধারণ ট্যাকটিক্সে ফ্রান্সের আক্রমণ ভাগকে আটকে দিলেন। পরে এমবাপে ঝড় শুরু হলেও এই ফ্রান্সকেও এই পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়, দেখিয়ে দিলেন মেসিরা। ফাইনালের আগে বসিয়ে রাখলেন দি মারিয়াকে। ফলে তাঁকে রিড করার সুযোগ সেভাবে পেল না ফরাসিরা। ফাইনালে নেমে ফ্রান্স যখন মেসি, আলভারেজকে সামলাচ্ছে; দুটো উইং ধরে সচল হলেন ম্যাক অ্যালিস্টার আর দি মারিয়া। আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি দেখলেই বোঝা যায়।
আর্জেন্টিনার ভক্তরা ম্যাচ জেতার পর মজা করে একটা কথা বলছেন। “এর আগে আমাদের একটা লিওনেল ছিল, এখন দুটো লিওনেল”। ভরসা তৈরি করেছেন স্কালোনি। ২০২৬ পর্যন্ত দলের সঙ্গে আছেন ৪৪ বছরের এই নায়ক। খুব করে চাইছেন, মেসি থাকুক। না থাকলেও আর্জেন্টিনীয়দের ভরসা আছে এখন। আরেক লিওনেল যে তারপরও থাকবেন দলে।