জীবন চালাতে বাছতে হচ্ছে যৌনকর্মীর পেশাও! কেমন আছেন দেশের সাড়ে ৫ কোটি বিধবা?

Widows of India: উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনকে বলা হয়ে থাকে 'বিধবাদের শহর'। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, বৃন্দাবনে বিধবাদের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো।

একসময়ে বৈধব্য ছিল অভিশাপ। বিশেষত, পরাধীন ভারতে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। হিন্দু বিধবারা ভারতীয় সমাজে এখনও বঞ্চিত, অবহেলিত। বিধবাদের নিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষাই চালিয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাতে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে বিধবার সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লক্ষ। ভারতে মোট যত সংখ্যক বিধবা রয়েছেন, তা তানজানিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জনসংখ্যার সমতুল।

ভারতে বিধবা মহিলাদের প্রাচীন ভারতে কিংবা বৈদিক যুগে কী ধরনের নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে, তার উল্লেখ রয়েছে ঋক বেদে। ঋক বেদ অনুসারে, স্বামীর মৃত্যুর পরে বিধবারা তাঁদের ইচ্ছানুসারে সহমরণে যেতে পারতেন। পাশাপাশি, নতুন করে বিয়েও করার অধিকারও তাঁদের ছিল। তবে ধীরে ধীরে বিধবা মহিলাদের উপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেও উল্লেখ রয়েছে মনুস্মৃতিতে। মনুস্মৃতিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিধবা মহিলাদের সাদা শাড়ি পরে থাকতে হবে, মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে হবে। আর যদি কোনও মহিলা নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হন, তবে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে হবে।

যুগের পর যুগ ধরে এই অমানবিকতা বহমান ছিল। এর বিরুদ্ধে প্রথম সরব হন রাজা রামমোহন রায়। এজন্য গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায়কে ঘোরতর যুদ্ধও করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার সতীদাহ প্রথা রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইন প্রণয়ন করেছে। ১৮২৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে বেঙ্গল রেগুলেশন অ্যাক্ট। এই আইনানুসারে সতীদাহ অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এরপর ব্রিটিশ সরকার বিধবা মহিলাদের সামাজিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে নতুন আরেকটি আইনও প্রণয়ন করেছে। ১৯৫৬ সালে প্রণয়ন করা এই আইন বিধবা পুনর্বিবাহ আইন কিংবা 'উইডো রিম্যারেজ অ্যাক্ট' হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুন- বিধবার দেবীপক্ষ! ‘আবার আসিস মা’, ডাকের সঙ্গে মিশে চোখের জল

বৈদিক যুগের অবসান হয়েছে, গঙ্গা-কাবেরী সব দিয়েই বহু জল বয়ে গেছে। ব্রিটিশরা ভারত থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরে ৭৫ বছর অতিবাহিতও হয়ে গেছে। এত কিছু সত্ত্বেও বিধবারা আর্থ-সামাজিকভাবে অবহেলার শিকার। সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি যদিও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বঞ্চনা, অবহেলার হাত থেকে বিধবাদের রক্ষা করার জন্য কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষের ঘুম ভাঙেনি।

এখনও ভারতীয় সমাজে অনেকক্ষেত্রেই মনে করা হয় বিধবারা ডাইনি কিংবা তাঁরা নিজেদের 'কালো জাদু'র মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি পারতে পারে। এমনকী অনেকক্ষেত্রে তাঁদের নিজের স্বামীর হত্যাকারী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এজন্য বহু সময়েই দায়ী থাকেন বধূটির শ্বশুরবাড়ির পরিবারের লোকজন।
আজও ভারতে কোনও মহিলা বিধবা হলে তাঁদের রঙিন শাড়ি পরাটাও নিষেধ। গায়ে কোনও অলঙ্কার চাপানোও নিষেধ। একেই দেশে চাকরি-বাকরি নেই। এই পরিস্থিতিতে দরিদ্র বিধবা মহিলাদের কাজকর্ম পাওয়া হয়ে ওঠে আরও দুষ্কর। তাঁদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয় পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের উপর। আর নাবালক অথবা নাবালিকা সন্তান-সহ বিধবা হয়েছেন যে দরিদ্র মহিলারা তাঁদের অবস্থা কহতব্য নয়।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, সারা দেশ জুড়ে বিধবা মহিলাদের অনেকক্ষেত্রে খুন হতে হচ্ছে অথবা বেছে নিতে হচ্ছে যৌনকর্মীর পেশা। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, বিধবা মহিলাদের অনেকেই নানা ধরনের মানসিক সমস্যার শিকার। নিঃসঙ্গতা, হতাশা, অসহায়তা, উদ্বেগজনিত অসুখ-বিসুখ অথবা নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসহীনতা বিধবাদের মূল সমস্যা।

শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বিধবারা ব্যাপক হারে বৈষম্যের শিকার। এর মূল কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, সকলেই তা জানেন। সারা পৃথিবীতে দরিদ্র বিধবার সংখ্যা ১১ কোটির উপর। ভারতে দরিদ্র বিধবাদের একাংশ পরাধীন ভারতে কাশীবাসী হতেন। এদের মধ্যে ছিল নাবালিকা বিধবারাও। সুন্দরী নাবালিকা বিধবাদের অনেককেই স্থানীয় জমিদাররা অপহরণ করে যৌনতা চরিতার্থ করতেন।

উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনকে বলা হয়ে থাকে 'বিধবাদের শহর'। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, বৃন্দাবনে বিধবাদের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো। এঁদের মধ্যে অনেকেই যৌন নিপীড়নের শিকার। যে মহিলারা স্বামীর মৃত্যুর পরে বৃন্দাবনে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সেখানকার মন্দির চত্বরে দিন গুজরান করছেন। ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন, চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে বৃন্দাবনে বিধবাদের আনাগোনা ও বসবাস শুরু হয়।

আরও পড়ুন- বিধবার কামনায় ব্রাত্য ধন দৌলত, ঐশ্বর্য! লক্ষ্মীপুজোয় আজও একঘরে ‘স্বামীহীনা’রা

ভারতে বিধবাদের অধিকার রক্ষায় একাধিক আইন থাকা সত্ত্বেও সেসব আদতে খাতায়-কলমে থেকে গিয়েছে। যেমন, বিধবাদের অধিকার রক্ষায় রয়েছে 'হিন্দু সাকসেসন অ্যাক্ট'। ১৯৫৬ সালে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অনুসারে হিন্দু বিধবা মহিলাদের পুনর্বিবাহ করার অধিকার রয়েছে। এছাড়া রয়েছে 'ইন্দিরা গান্ধি ন্যাশনাল উইডো পেনশন প্রকল্প'। এই প্রকল্পের আওতায় পড়ছেন ৪০ থেকে ৭৯ বছর বয়সের মহিলারা। এছাড়া ২০২০ সালে চালু করা হয়েছে 'স্কিম ফর ওয়েলফেয়ার অব ওম্যান' এবং 'ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রকল্প'। কিন্তু এই প্রকল্পের আওতায় বিধবাদের সহায়তা বাবদ যে সামান্য টাকা তুলে দেওয়া হয় তা দিয়ে জল গরম হওয়ার কথা নয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের লক্ষ লক্ষ বিধবা মহিলা নিজেদের জীবন ছেড়ে দিয়েছেন স্রেফ ভাগ্যের হাতে।

বিধবাদের জীবনে খানিকটা স্বস্তি ফেরানো যেতে পারে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে তাঁদেরকে সহায়তা করার জন্য, এমনই মনে করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। তবে সে কাজটাও সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ও স্বেচ্ছাসেবীরা একসঙ্গে সহায়ক প্রকল্প গঠন করলে সেক্ষেত্রে বিধবারা কঠিন পরিস্থিতির হাত থেকে খানিক রেহাই পেতে পারেন। বিধবাদের ক্ষমতায়নের কাজটা কেন দেশ স্বাধীনের ৭৫ বছর পরেও অবহেলিত থেকে গেল, সেও চিন্তার বিষয়।
ভারতীয় সমাজে বিধবারা মনে করেন, তাঁদের অকাল বৈধব্যের কারণ হল গতজন্মের পাপ। সেজন্য এজন্মের বৈধব্যের জ্বালা সইতে হচ্ছে তাঁকে। এই অর্থহীন ধারণা নিয়ে আজও যে অবস্থায় কাটান বিধবারা, শুধুমাত্র 'স্বামী' বা দেখভাল করার মালিক নেই বলে- তা যন্ত্রণার। ভারতে বিধবা মহিলাদের একাংশকে আজও বৈধব্য জীবন কাটাতে হচ্ছে কার্যত নিঃসঙ্গতা নির্বাচন করেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, উত্তর ভারতের বাসিন্দা যে বিধবারা বছরের পর বছর ধরে অকালে বিধবা হচ্ছেন সেই তরুণীদের বাকিটা জীবন একঘরে বন্দির মতোই কাটাতে হচ্ছে। আজও, এখনও!

More Articles