দক্ষিণ আমেরিকায় লাল সূর্যোদয়? ব্রাজিলে বামপন্থী প্রেসিডেন্টের নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে দিল
Brazil Elections: লুলা-র এই জয়কে লাতিন আমেরিকার আকাশে নতুন করে বামপন্থার সূর্যোদয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাম, ডান, মধ্যপন্থীর ফারাক যখন ধুয়েমুছে সাফ, সাদা-কালোর পরিবর্তে যখন আধিক্য ধূসরের, ঠিক-বেঠিকের মাপকাঠিও স্থির থাকে না। তাই স্রোতে গা ভাসানোর প্রবণতা দেখা যায়। চার বছর আগে সেই তাতে শামিল হয়েছিল লাতিন আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত ব্রাজিলও। তবে দেরিতে হলেও, ভুল শুধরে নিল তারা। চার বছরের মাথায় ‘মেসিহা’ জাইর বলসোনারোকে কুর্সি দেখে সরিয়ে দিলেন ব্রাজিলের মানুষ। বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাকেই ফের ক্ষমতায় ফেরালেন তাঁরা। বর্তমানে বিশ্বরাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র যখন অবসানের পথে, দক্ষিণপন্থী, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির আগ্রাসন যখন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সময় লুলা-র এই জয়কে লাতিন আমেরিকার আকাশে নতুন করে বামপন্থার সূর্যোদয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নির্বাচনে জয়যুক্ত হলেও, এখনই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে এখনও একমাস অপেক্ষা করতে হবে লুলাকে। বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে বলসোনারোর সঙ্গে তাঁর ব্যবধানও আহামরি কিছু নয়, ৫০:৪৯-এর ফারাক। ২০১৮ সালে যেখানে ৫৫.২ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলসোনারো, সেই তুলনায় এবারে তাঁর প্রতি সমর্থন কমেছে অনেকটাই। এর মধ্যে রাষ্ট্রনেতার চেয়েও, ব্যক্তি বলসোনারোর পরাজয়ই দেখছেন অনেকে। একই সঙ্গে, নতুন করে আশার আলো দেখছেন বহু মানুষ। তাঁদের মতে, বলসোনারোর হার প্রমাণ করে যে, এখনও সবটা দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যায়নি। অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো ঢোকার মতো সামান্য ফাটল রয়েছে এখনও।
ব্রাজিলের পাশাপাশি চিলি, পেরু, কলম্বিয়ার রাজনীতিতেও সাম্প্রতিক কালে নতুন করে বামপন্থার উত্থান লক্ষ্য করা গিয়েছে। উল্কিধারী, সোশ্যাল কনভারজেন্স পার্টির নেতা, ৩৬ বছর বয়সি গ্যাব্রিয়েল বোরিক এ বছর মার্চেই চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষক তথা ইউনিয়ন নেতা হোসে পেদ্রো কাস্তিলোও এ বছরই পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অগাস্ট মাসে কলম্বিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গুস্তাভো পেত্রো। অভিবাসী পরিবারের ছেলে। কলম্বিয়া হিউমানা দলের সদস্য। চার বছর দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনেতার শাসনে থাকার পর ফের বামপন্থী তথা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করল ব্রাজিলও।
কণ্টকমুক্ত নয় লুলা-র যাত্রাপথ
ব্রাডিলের এ বারের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। বলসোনারোর পরাজয়কে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন তাঁরা। তবে জো বাইডেনের ক্ষেত্রে ট্রাম্পর যতটা না পেরেছিলেন, বলসোনারো তার চেয়ে ঢের বেশি কণ্টক লুলার যাত্রাপথে বিছিয়ে রেখে যাচ্ছেন বলেও মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কারণ কট্টর দক্ষিণপন্থী বলসোনারো গত চার বছরে ব্রাজিলে যে বিভাজন তৈরি করেছেন, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দিয়ে তা জোড়া লাগাতে আদৌ সফল হবেন কিনা লুলা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক বিষয়েই নয়, ব্যক্তি পরিচয়, মূল্যবোধ এবং মতামতের ক্ষেত্রে মেরুকরণ জাঁকিয়ে বসেছে ব্রাজিলে। লুলার জয়ের পর তাই সেনা অভ্যুত্থানের দাবিও শোনা যায়।
আরও পড়ুন: অনেক সয়েছি আর না! কেন রাষ্ট্রনেতা বলসোনারোকে ছুড়ে ফেলে দিল ব্রাজিলের জনতা
দেশের এই বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল লুলা। তাই সমর্থকরা উচ্ছ্বাসে ভাসলেও, সামধানী স্বর শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর নিস্পৃহ সুরেই বলেন, ‘অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে প্রশাসনিক দায়িত্ব হাতে পাচ্ছি আমি। তবে ঈশ্বরের উপর আস্থা রয়েছে। নাগরিকদের সাহায্য পেলে অবশ্যই দেশকে এই সঙ্কট থেকে মুক্ত করতে পারব।’’ প্রবীণ বামপন্থী লুলা রাজনীতি করেই চুল পাকিয়েছেন। ঘুষ নিয়ে একটি নির্মাণ সংস্থাকে বরাত দেওয়ার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ২০১৮-র নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি লুলা। ৫৮০ দিন জেলেও কাটাতে হয় তাঁকে, যদিও শেষমেশ তাঁর কারাবাস বাতিল হয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘কৃত্রিম’ বলেও দাবি রয়েছে। তাই জয় নিশ্চিত হওয়ার পর বলেন, ‘‘জীবন্ত অবস্থায় সমাধিস্থ করতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু আজ এখানে আমি।’’
নির্বাচনী ফলাফল মনঃপূত না হলে আদালতে যেতে পারেন বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন বলসোনারো। তবে লুলার জয়ের পর এখনও পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেননি তিনি, হারও স্বীকার করেননি। তাই অস্থিরতা কাটেনি পুরোপুরি। আবার বলসোনারো হার স্বীকার করলেও, তাঁর ঘনিষ্ট সাংসদরাই এখনও ব্রাজিলের কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ আইন প্রণয়ন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিপদে বাধা পেতে হবে লুলাকে। তবে এ ক্ষেত্রে লুলা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন। কারণ, এককালের প্রতিদ্বন্দ্বীকে শরিক করে আগেও দু’-দু’বার সরকার চালিয়েছেন তিনি। এ বারও তাই জানিয়ে রেখেছেন, শুধু নিজের দল ওয়ার্কার পার্টি নয়, সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তিতেই সরকার চালাবেন তিনি। ব্রাজিলে শান্তি এবং ঐক্য ফেরানোই তাঁর লক্ষ্য।
লুলা-র এই দূরদৃষ্টিই তাঁকে বলসোনারোর বিরুদ্ধে জয়ী করেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কারণ কট্টর দক্ষিণপন্থাকে সামনে রেখেই শুধুমাত্র সরকার চালাননি তিনি, গত চার বছরে দেশকে ক্রমশ মধ্যযুগীয় মানসিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। প্রাক্তন সেনা আধিকারিক বলসোনারো বার বার সেনাশাসনের পক্ষে সওয়াল করেছেন। গণতন্ত্রের চেয়ে সেনা শাসনই ব্রাজিলের সমৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক বলে দাবি করেছেন তিনি। একনায়কতন্ত্রের পক্ষে সমর্থনের কথাও লুকিয়ে রাখেননি। ব্রাজিলের একদা সেনাশাসক ব্রিলান্তে উস্ত্রার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের কথাও জানিয়েছেন। একনায়কতন্ত্র নয়, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়াল এবং দক্ষিণ আমেরিকার মতো গণতন্ত্রই ব্রাজিলের আসল শত্রু বলে মন্ত্র করেন।
বলসোনারো ও বিতর্ক
আমাজন অরণ্য ধ্বংসের জন্যও দায়ী করা হয় বলসোনারোকেই। আমাজনের ৬০ শতাংশ বনভূমি ব্রাজিলেরই অন্তর্গত। প্রায় ৬৭ কোটি হেক্টর বিস্তৃত ওই বণভূমিকে পৃথিবীর ফুসফুসও বলা হয়। ওই বনভূমিকে সংরক্ষণের পরিবর্তে সেখানে পরমাণু এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এমনকি আমাজনের জনজাতি সম্প্রদায়ের জঙ্গলের অধিকারও কেড়ে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই বলসোনারো সরকারের বননিধন প্রকল্পের আওতায় আমাজন বনভূমির ৩ হাজার ৯৮০ স্কোয়্যার কিলোমিটার এলাকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, যা আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের চেয়ে আয়তনে পাঁচ গুণ বড়। গত কয়েক বছরে আমাজন বনভূমির ১৭ থেকে ২০ শতাংশ ফাঁকা করে দিয়েছে বলসোনারো সরকার।
নারীবিদ্বেষী তকমাও জুড়ে গিয়েছে বলসোনারোর নামের পাশে। কর্মক্ষেত্রে মহিলা এবং পুরুষের সমান বেতনের বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তি ছিল, নারী-পুরুষের বেতন কখনও সমান হওয়া উচিত নয়। কারণ মেয়েরা গর্ভবতী হন। মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। আবার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে খারা সময়ও ঘরে তোলেন বেতন। এমনকি নিজের প্রথম চার সন্তান ছেলে হলেও, ক্ষণিকের দুর্বলতায় পঞ্চম সন্তান মেয়ে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। দেশের প্রাক্তন মানবাধিকার মন্ত্রী মারিয়া দো রোজারিওকে প্রকাশ্যে কুৎসিৎ, ধর্ষণেরও যোগ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন বলসোনারো। সেই মামলা আদালতে উঠলে তিনি দোষী সাব্যস্তও হন।
সমকামী সম্পর্কেরও ঘোর বিরোধী বলসোনারো এবং পদে থাকাকালীন প্রকাশ্যে তা নিয়ে মতামত জানাতেও পিছপা হননি। রাস্তায় দুই পুরুষকে চুমু খেতে দেখলে, পিটিয়ে শায়েস্তা করবেন বলে মন্তব্য করেন। তাতে সমালোচনা শুরু হলে, আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘‘ছেলেমেয়ের মধ্যে ওই রকম হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখলে, চাবুকপেটা করুন। আচরণ পাল্টাতে বাধ্য হবে। গাঁজাখোর বন্ধুর সঙ্গে মিশলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেমন, তেমনই সমকামীর সঙ্গে মিশলে সমকামী হয়ে যেতেই পারে।’’ নিজের ছেলে সমকামী হলে, তাঁকেও ভালবাসতে পারবেন না, বলে জানান বলসোনারো।
হিংসায় উসকানি জোগানোর জন্য বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন বলসোনারো। প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে, রাজনীতিতেও হিংসা, শারীরিক নিগ্রহের পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে আর্জেন্টিনার ‘ডার্টি ওয়ার’-এর সমর্থনে গলা চড়ান বলসোনারো। সাত এবং আটের দশকে আর্জেন্টিনার সেনা শাসক বিরোধী রাজনীতিক, সমালোচকদের ধরে ধরে যেমন খুন করত, ব্রাজিলে তেমন ৩০ হাজার মানুষকে নিকেশ করে দিলেই, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন বলসোনারো। সেই তালিকায় ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো হেনরিক কার্দোসোকও রাখেন তিনি। ২০১৮ সালে নির্বাচনী প্রচারে বামপন্থী নেতাদের গুলি করে মারার কথা বলেন তিনি।
জন্মহার নিয়ন্ত্রণের কথা বলতে গিয়ে দেশের দরিদ্র মানুষকে কার্যত নিরোধক ব্যবহারের আওতায় আনার কথা বলতে শোনা যায় বলসোনারোকে। তাঁর বক্তব্য ছিল। ‘‘আমরা, অভিজাত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তরা নিজেরে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। গরিব মানুষের সে সবের বালাই নেই। ওদেরকে এসব বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। কারণ অধিকাংশই শিক্ষায় আগ্রহী নয়। তাই কঠোর হতে হবে আমাদের। তবেই বিশৃঙ্খলা ঠেকানো সম্ভব। শুধু বক্তৃতা করে, আইন এনে হবে না।’’ তার পরেও জনপ্রিয়তায় নির্ভর করেই যাবতীয় সমালোচনা পেরিয়ে গিয়েছেন বলসোনারো। টায়ে টায়ে হলেও, তবে এবার মানুষের রায়েই পরাজিত হলেন তিনি।