"মওত মুবারক হো মীনা", প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কেন শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন নার্গিস?
Meena Kumari Tragedy: সিরোসিস অব লিভার রোগে আক্রান্ত হন মীনা। তার মধ্যেও সেরেছেন 'পাকিজা' ছবির অভিনয়।
নায়িকা সংবাদ মানেই পরশ্রীকাতরতার চোরাস্রোত, প্রতিযোগিতা! তাই কি? মীনা কুমারীর মৃত্যুর পর দীর্ঘ চিঠিতে 'মুবারক' বার্তা জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী নার্গিস। সেই চিঠি ছাপা হয়েছিল উর্দু পত্রিকায়। আপামর দুনিয়া পড়েছিল সেই চিঠি! জেনেছিল অন্য এক সমীকরণের গল্প। দু'জনেই বলিউডে পা রেখেছিলেন শিশু শিল্পী হিসেবে। একজন বলি-দুনিয়ায় এসেছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ও ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ জদ্দানবাইয়ের হাত ধরে। না, মীনার ভাগ্য ততটা ভাল ছিল না। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নারীর টান থাকা সত্ত্বেও সেই গৌরবের কুটোটি পাননি তিনি। শুধু পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও তিনি আদতেই ট্র্যাজেডি কুইন। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞাতি ভাইয়ের মেয়ে হেমসুন্দরী ছিলেন ব্রাহ্ম। অল্প বয়সেই কপালে জুটেছিল বৈধব্যের ভোগ। বাংলা ছাড়েন হেম। ধর্ম বদলে মেরঠে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন হিন্দিভাষী সাংবাদিক ও গল্পকার পেয়ারেলালকে। অচিরেই একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন হেম। গানের গলা ভাল ছিল সেই মেয়ের। গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে বম্বে পাড়ি দিল কিশোরী প্রভাবতী।
মায়ানগরীতে এসে প্রভাবতীর সঙ্গে আলাপ হয় নামী হারমোনিয়াম বাদক ও সঙ্গীত শিক্ষক মাস্টার আলি বক্সের। প্রেম, নিকাহ্তে গড়াতে সময় লাগল না। ধর্মান্তরিত প্রভাবতীর নতুন নাম হল ইকবাল বানো। আলির গান বাজনা আর ছোটখাটো চরিত্রে ইকবালের অভিনয়, নাচ-গান। টানাটানির সংসার কোনও মতে চলে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে প্রথম সন্তানের জন্ম দিলেন ইকবাল। মেয়ে হল তাঁদের। দ্বিতীয়বারও মেয়ে হয়েছে শুনে হতাশ হলেন পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় কাতর আলি। সদ্যোজাত শিশুটিকে তিনি রেখে আসতে গেলেন বম্বের এক অনাথ আশ্রমে। ফিরে আসতে যাবেন, বাচ্চাটির তীব্র কান্নায় হুঁশ ফিরল আলির। পিছনে ফিরে দেখেন, বারান্দায় অবহেলায় পড়ে থাকা সেই একরত্তির সারা শরীর ছেঁকে ধরেছে লাল পিঁপড়ে। মায়া হল তাঁর। মেয়েকে বুকে করে ফিরে এলেন। সেই মেয়ের নাম রাখা হল মেহজবিন। জন্মমুহূর্তেই বোধহয় ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল মেয়েটির। বাকি জীবনটাও অপরিসীম দুঃখ-যন্ত্রণার সঙ্গে তাঁকে লড়ে যেতে হবে এক অসম লড়াই। জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত।
আরও পড়ুন- ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর দজ্জাল গিন্নির আড়ালে রয়ে গেলেন দুঃসাহসী মলিনা দেবী
বাবা-মায়ের সম্পর্কের অশান্তি গভীর ক্ষত ফেলেছিল ছোট্ট মেহজবিনের জীবনে। রান্নাবাটি বা পুতুল-খেলা নয়, মাত্র ৬ বছর বয়সেই কাঁধে উঠে এল সংসারের জোয়াল। সেই থেকে শুরু সিনেমায় অডিশন দেওয়ার। এসে গেল সুযোগও। বদলে গেল নাম। একের পর এক সিনেমায় শিশুশিল্পীর ভূমিকায় দেখা যেতে লাগত বেবি মীনাকে। গল্পে, উপন্যাসে বা বড়পর্দায় এমন কত চরিত্রকেই তো আমরা দেখি, যাঁদের জন্মই হয় দুর্ভাগ্যের ললাট লিখন নিয়ে। মীনা তো এমন কতশত চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন জীবনভর! যা তাঁকে অচিরেই এনে দিয়েছিল 'ট্র্য়াজেডি কুইন'-এর খেতাব। তবে কবে যে পর্দা থেকে বেরিয়ে জীবনটাকেই জড়িয়ে-জাপ্টে নিল সেই ট্র্যাজেডি, জানতেও পারলেন না মীনা। একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন বটে, তবে শুটিংয়ের চাপে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করা হল না তাঁর। হাল ছাড়েননি। বাড়িতে শিক্ষক রেখেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। বই পড়তে তিনি এতটাই ভালবাসতেন যে শুটিং ফ্লোরে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল 'রিডিং মেহজবিন'। তেরো বছর বয়সে 'বাচ্চো কা খেল' ছবির হাত ধরে দুনিয়া চিনল মীনা কুমারীকে। বলাই বাহুল্য বাকিটা ইতিহাস।
মীনা বলতেন, তিনি নয়, সিনেমাই তাঁকে বেছে নিয়েছিল। আর তা সত্যি না হলে, ওই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ওইটুকু বয়সে ক'জনই বা পেয়েছেন। অশোক কুমারের সূত্রে পরিচালক কামাল আমরোহীর সঙ্গে পরিচয় হয় মীনার। কামাল সে সময় 'আনারকলি' ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। ১৯৫১ সালে 'আনারকলি' ছবিতে সাইন করলেন মীনা। ততদিনে অনেকটা পাল্টে গিয়েছে তাঁর জীবন। পুরনো ঘর ছেড়ে উঠে এসেছেন বান্দ্রার নতুন বাড়িতে। ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে মা ইকবালকে। 'আনারকলি' ছবির শুটিং শুরুর আগে মহাবালেশ্বর থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়লেন মীনা। খবর পেয়ে ছুটে আসেন কামাল। ততক্ষণে অন্য বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গিয়েছে দু'জনের মধ্যিখানে। চার মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মীনা। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালের দরজায় এসে থামত কামালের গাড়ি। চিঠি আদানপ্রদানের ফাঁকে কখন যে হৃদয় বিনিময় সেরে ফেলেছিলেন দু'জনে, কে জানে!
স্পর্ধার অভাব কোনও দিনই ছিল না মেয়েটির। তাই 'আনারকলি'র ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাপোড়েন, আলি বক্সের হাজার বারণ সত্ত্বেও মীনা বিয়ে করলেন দুই সন্তানের পিতা কামালকে। সেই বিয়ের সাক্ষী ছিলেন কামালের ব্যক্তিগত সহকারি বাকর আলি ও মীনার বোন মধু। বাপের বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হল মীনার জন্য। কমলের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন মীনা। সেখানে প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার কমলের। তবে অদ্ভুতভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে দারুণ ভাব জমিয়ে ফেলেছিলেন মীনা। এরপর কামালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একের পর এক কাজ, সাফল্য... দিব্যি চলছিল। ততদিনে কামালের মাথায় ঘুরছে 'পাকিজা' ছবির পরিকল্পনা। ১৯৫৬ সাল নাগাদ কাজও শুরু হয়েছিল সেই ছবির। নানা জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় কাজ। বদলাতে থাকে অনেক সমীকরণও।
একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আর শর্তের নিগড়ে মীনাকে বেঁধে ফেলেছিলেন কামাল। প্রথমদিকে সেসব মেনেও নেন মীনা। কিন্তু কতদিন! এমনকী সহকারি বাকর আলিকে গুপ্তচর হিসেবেও নিয়োগ করেন কামাল। মীনার সমস্ত খবর পদে পদে তাঁকে জানাতেন বাকর। একবার মেকআপ রুমে গুলজারের সঙ্গে দেখে মীনার গালে সজোরে থাপ্পড় মারেন বাকর। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন মীনা। কামালকে জানালে আশ্চর্যভাবে তাঁর সমর্থন গিয়েছিল বাকরের দিকেই। অপমানিত মীনা কামালের কাছে আর ফিরে যাননি। তীব্র পুরুষতান্ত্রিক ইগোয় বারবার অপমান করেছেন তিনি মীনাকে। আর এসব যন্ত্রণা বুকে নিয়েই ক্রমশ মীনা ডুবছিলেন মদের নেশায়। আরও একটা নেশা অবশ্য তাঁর ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে যা এসেছিল সম্ভবত ঠাকুরবাড়ির রক্ত থেকেই। সেটা কবিতা। জীবনের সমস্ত ক্ষত তিনি ভরতে চেয়েছিলেন শায়েরি আর মদের নেশায়। শেষজীবনে উঠতি নায়ক ধর্মেন্দ্রর প্রতি দুর্বলতা জন্মেছিল মীনার। জানা যায়, সাময়িক সম্পর্কেও জড়ান তাঁরা। না, সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন মীনা। নানা জটিলতায় হৃদয় ভেঙেছে সেখানেও। আর আরও নেশায় তলিয়ে গিয়েছেন মীনা।
শেষমেশ কাল হল ওই নেশাই। সিরোসিস অব লিভার রোগে আক্রান্ত হন মীনা। তার মধ্যেও সেরেছেন 'পাকিজা' ছবির অভিনয়। এরই মধ্যে মুক্তি পায় খৈয়মের পরিচালনায় মীনার লেখা ও গাওয়া কবিতাংশের সঙ্কলন 'আই রাইট, আই রিসাইট'। 'পাকিজা' ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭২-এ। প্রথম কয়েক সপ্তাহে বক্স অফিসে একেবারেই চলেনি ছবিটি। মীনা তখন গভীর অসুখে। মীনার এই যন্ত্রণাদায়ক লড়াইকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন আরও এক জন, যাঁর শুরুটা হয়েছিল মীনার মতোই শিশুশিল্পী হয়ে। তিনি নার্গিস। ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় নায়িকা, মঞ্জুর প্রিয় 'বা-জি'। পর্দায় অভিনয়ে, সংলাপে যে বিষণ্ণতাকে বারবার ছুঁয়ে গিয়েছেন মীনাকুমারী, তা যে তাঁর জীবনোপার্জিত, তা যে ক'জন হাতে গোনা মানুষ জানতেন, তার অন্যতম ছিলেন নার্গিস। কামাল আমরোহির সঙ্গে অশান্তি, অত্যাচার এমনকী মারধর নিত্য বিব্রত করত তাঁকে। অনেকবার প্রতিবাদ করারও চেষ্টা করেছেন, তবে ফল হয়নি। একবার তো কামালের সহকারি বাকরকে গিয়ে তোপও দাগেন তিনি। নার্গিস নিজেই জানিয়েছিলেন সেই কথা।
আরও পড়ুন- স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের
১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ মাত্র ৩৮ বছর বয়সে সিরোসিস অব লিভারে মারা গেলেন মীনাকুমারী। তাঁর স্বামীর সম্মতিতে খুলে দেওয়া হল লাইফসাপোর্ট। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের তাঁর সঙ্গে দেখা হল না মীনাকুমারীর। রয়ে গেল সাদা-কালো পর্দায় তাঁর ওই মুখ, ট্র্যাজেডি কুইনের যন্ত্রণাময় জীবনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন গল্প, আর কবিতারা।
গোটা দুনিয়া যাঁর পরশ পেতে মুখিয়ে থাকত, ব্যক্তিগত জীবনে বারবার প্রিয় পুরুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন অভিনেত্রী। প্রথম জীবনে বাবা, তার পর স্বামী এবং যিনি চাইলে প্রেমিক হতে পারতেন, তাঁর কাছেও। স্ত্রী হিসেবে মীনাকে কম নম্বর দিয়েছেন এক জীবনে চার বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কামাল। ছোটবেলায় যে পাথর নিয়ে নিত্য খেলেছেন মীনা, অভিমানের সেই পাথরই আজীবন বুকে বয়ে গেলেন তিনি। 'নাজ' ছদ্মনামে সেই অভিমান তিনি গুছিয়ে রাখলেন কবিতার খাতায় কেবল। মীনার মৃত্যুর পর সেসব খণ্ড খণ্ড কবিতাকে মলাটবন্দি করেছিলেন গুলজার 'তনহা চান্দ' নামে সংকলনে।
নার্গিস পত্রিকায় লিখেছিলেন, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় বোন মীনার কথা। সেই মীনা, যে কিনা সুপারস্টার, অথচ খুদে সঞ্জয় দত্তদের সামলানোর দায়িত্ব পালন করেছেন নির্দ্বিধায়, অতবড় নায়িকা হয়েও যাঁকে ছোঁয়নি পরশ্রীকাতরতার বিষপোকা কোনওদিনও। সেই মীনার মৃত্যুতে 'মুবারক বাত' জানিয়েছিলেন নার্গিস। বলেছিলেন, এই পৃথিবী তাঁর মতো মানুষের জন্য নয়। এই রুক্ষ, রসকষহীন পৃথিবীতে বড্ড একা মীনারা।
নক্ষত্রখচিত এই গ্ল্যামার দুনিয়ায় মীনা সত্যিই বোধহয় সেই ব্যতিক্রমী 'একলা চাঁদ', যাঁর বিষাদমাখা জ্যোৎস্নায় ভারতীয় সিনেমা ভিজবে আজীবন।