শুধু নাবালিকা নয়, প্রতিদিন যৌন নিপীড়নের শিকার কত নাবালক, চমকে দেবে এই তথ্য

Minor Male Molestation: দুনিয়াজুড়ে স্বেচ্ছাসেবীরা মনে করছেন, নাবালকদেরও যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত।

যে কোনও মানুষের জীবনে শৈশব-কৈশোরের অভিজ্ঞতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আজীবন সুস্থ মন নিয়ে বেঁচে থাকাটা আর্শীবাদই বলা যেতে পারে। ছোটবেলার নানান অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা জীবনের ভিত সৃষ্টি করে। আবার অনেকসময়ে দেখা যায় কৈশোরে কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নাবালক-নাবালিকারা হরেকরকমের তিক্ততার সম্মুখীন হয়। এ ধরনের ঘটনাগুলি তাঁদের জীবনে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। অনভিপ্রেত এই ঘটনার মধ্যে রয়েছে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা। আবিশ্ব নাবালক-নাবালিকারা যৌন নিপীড়নের শিকার। দুনিয়ার উন্নত দেশগুলিতেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সরকারিভাবে ঘটনাগুলো নথিভুক্ত হলেও যৌন নিপীড়ন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ভারতও সেই একই পথের পথিক। ভারতীয় নাগরিক কতজন নাবালক-নাবালিকা প্রতি বছর যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকারিভাবে তথ্য যদিও নথিভুক্ত করা হয়নি। ভারতে গত দু'দশকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ছাড়াও আক্রান্ত নাবালিকারা। 'পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া' দাবি করেছে, গত দু'দশকে ভারতে ধর্ষণের ঘটনা ৭০ শতাংশের চেয়ে বেশি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। এখনও অধিকাংশ মামলার নিষ্পত্তিই হয়নি।

ধর্ষণ কিংবা অন্য যে কোনও ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হলে এর প্ৰভাব পড়ে মনে। সম্প্রতি 'ল্যানসেট সাইক্রিয়াট্রি' ব্রিটেনের বাসিন্দা ৯ হাজার ৯৭১ জনের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে অংশগ্রহণকারীদের জন্ম ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী এক হাজারের বেশি তরুণী এবং ২৬০ জন তরুণ জানিয়েছেন, তাঁরা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে নাবালক-নাবালিকা থাকাকালীন। গত ১২ মাসেও ওঁদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। ফলে ওঁরা এখন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

আরও পড়ুন- বিধবার কামনায় ব্রাত্য ধন দৌলত, ঐশ্বর্য! লক্ষ্মীপুজোয় আজও একঘরে ‘স্বামীহীনা’রা

শুধু তাই নয়, 'ল্যানসেট সাইক্রিয়াট্রি'র ওই সমীক্ষায় আরও জানা গিয়েছে, যে সমস্ত নাবালক-নাবালিকা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তাঁদের ভিতর তীব্র হচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। মানসিকভাবে অনেকেই নানারকম অসুস্থতার শিকার। সমাজ থেকে যৌন নিপীড়নকে সমূলে বিনাশ করাটা জরুরি। তবে বদলের সেই কাজ গোটা বিশ্বজুড়েই বহুদূর পর্যন্ত বাকি পড়ে রয়েছে। নাবালক-নাবালিকাদের আত্মহত্যা কিংবা নিজের ক্ষতি নিজে করার প্রবণতা কমবে সুস্থ শৈশব-কৈশোরে যদি তাঁরা বেড়ে উঠতে পারে। এর দায় কেবল রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। সমাজ ও মানসিকতার পরিবর্তনের কাজ দায়িত্বশীল যে কোনও নাগরিকেরই।

ওয়াশিংটনের একটি সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, যৌন নিপীড়নের শিকার প্রতি এক লক্ষ নাবালিকার মধ্যে পাঁচ হাজার নাবালিকা আত্মহত্যা করতে চায়। শুধু নাবালিকরাই নয়, নাবালকরাও পৃথিবীর সর্বত্র যৌন নিপীড়নের শিকার। তবে ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে নাবালিকারা যৌন হেনস্থার শিকার হলে নাবালকরা ৫ শতাংশ ক্ষেত্র যৌন নিপীড়নের শিকার। ভারতে নাবালিকার ধর্ষণ ঘটনা নৈমিত্তিক। যদিও যৌনলালসা মেটাতে নাবালকদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো প্রচার হয় খুব কমক্ষেত্রেই। তবে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। নাবালকরা যৌনলালসার শিকার হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকরাই ঘটনা চেপে যান। এ ব্যাপারে 'ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান বিহেভিয়ার অ্যান্ড সায়েন্সেস'-এর সিনিয়র কনসালস্ট্যান্ট ডা. নিমেষ জি দেশাই জানিয়েছেন, নাবালক-নাবালিকারা যৌনলালসার শিকার হওয়ার পরে অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেও শাস্তি হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে আদালতে মামলা চলছে।
অনেকেরই ধারণা মেয়েরাই কেবল যৌনলালসার শিকার হয়। কিন্তু এই ধারণা ভিত্তিহীন। সারা পৃথিবীতে নাবালকরাও অনেকসময়েই যৌনলালসার শিকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতজনের মাধ্যমে তাঁরা যৌনলালসার শিকার।

এসম্পর্কে একাধিক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নাবালক-নাবালিকারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে ওঁদেরই কোনও পরিচিতজনের হাতে। এ ধরনের ঘটনা ধরা পড়লেও বহুক্ষেত্রে তা রাখঢাক করে চেপে যাওয়া হচ্ছে। বহুক্ষেত্রেই অভিভাবকরা পুলিশে বিষয়টি নিয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের করছেন না। শুধু ভারতই নয়, উন্নত যে দেশগুলিতে নাবালকরা হামেশাই যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এর মধ্যে তালিকার উপরে নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। 'ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনসন' বা সিডিসি-এর পেশ করা তথ্যানুসারে, নাবালকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক হারে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এদের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চালানো আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সেদেশের বাসিন্দা প্রতি ৪জন নাবালিকার মধ্যে একজন এবং প্রতি ১৩জন নাবালকের মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নাবালক-নাবালিকারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে চেনা কোনও মানুষের হাতে। অপরিচিত মানুষের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা নগণ্য সংখ্যক।

আরও পড়ুন- পায়রা, ঘোড়া থেকে পোস্ট অফিস! ভারতের ডাকব‍্যবস্থা যে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এল

আরেকটি ব্যাপার হল, দুনিয়াজুড়ে স্বেচ্ছাসেবীরা মনে করছেন, নাবালকদেরও যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত। যৌন নিপীড়নের ঘটনায় যুক্ত অপরাধীদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ। পৃথিবীজুড়ে যে নাবালক-নাবালিকারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তাঁদের অনেকেই নিজের ক্ষতি করার, আত্মহত্যার চিন্তা করার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলছেন। যৌনতা সম্পর্কে তাঁদের মনে আজগুবি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। যৌন নিপীড়নের ঘটনার অভিজ্ঞতা রাতের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে আক্রান্তদের একাংশের। স্কুলে যেতেও তীব্র অনীহা আক্রান্তদের।

যে সমস্ত নাবালক-নাবালিকা যৌনলালসার শিকার হয়েছে তাঁদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করা উচিত সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, আক্রান্তদের অভিযোগ ধৈর্য সহকারে গুরুত্ব দিয়ে শোনা দরকার। উচিত সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দেওয়া। আর আক্রান্তর কাছ থেকে ঘটনাটি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা শোনার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।

ভারতে নাবালিকা নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ ব্যাপক হারে জমা পড়ছে। কিছুক্ষেত্রে নাবালিকদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাও নথিভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু কোনওক্ষেত্রেই শাস্তি হচ্ছে না বছরের পর বছর। ফলে জঘন্য কাজ করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে এ ধরনের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে অপরাধীদের মধ্যে।
স্বেচ্ছাসেবী এবং সমাজকর্মীদের মতে, পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে হাঁটতে হবে মাইল মাইল পথ। যে সমস্ত কিশোর-কিশোরী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সেইসব আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীর অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাঁদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বটা বর্তাচ্ছে রাষ্ট্রের কাঁধেই। 

More Articles