বড় ভোটে মোদি, ছোট ভোটে মিঠুন! এবারে কার্যসিদ্ধি হবে, না কি খালি হাতেই ফিরতে হবে

Bengal BJP: বড় ভোট নেই, মোদি-শাহ নেই। পঞ্চায়েত আবহে আবার বাংলা কাঁপাচ্ছেন মিঠুন।

বসন্তের কোকিল না পরিযায়ী পাখি! পর্যটক না স্থায়ী বাসিন্দা! বঙ্গের ভোট-রাজনীতির রাজ্যে ফের এই প্রশ্নেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি। উত্তেজনা বেড়েছে আবারও বহিরাগত আর মরশুমের অতিথি আবহে। কী হয়েছে ফের?

সম্প্রতি এ-রাজ্যে এসেছেন মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty)। বাংলায় শীতের মরশুম শুরু হতেই পা পড়েছে বর্তমানের বিজেপি নেতা, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা, রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ বলিউডের মিঠুনদার! ঘন ঘন তাঁর এই বঙ্গ-সফর নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা। একাধিক প্রশ্নের আবহের মধ্যেই রাজ্যের গেরুয়া-গৃহে কেন্দ্রের অমিত শাহ, জগৎপ্রকাশ নাড্ডাদের নির্দেশে, অমিত মালব্য-স্পর্শে জেলাসফর শুরু করেছেন তিনি।

সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীদের সহযোগে রাজ্যের রাঢ়বঙ্গে ঢুঁ মেরেছেন মিঠুন। পুরুলিয়ায় কর্মিসভা। দলের কর্মীরা ঘরে পাত পেড়ে খাওয়া থেকে শুরু করে মাটির কর্মীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কৌশল ছাড়িয়ে বাঁকুড়া। এরপর অনুব্রত মণ্ডলের গড় বীরভূম! নভেম্বরের মিঠুন-সফর অন্য মাত্রা নিয়েছে প্রথম থেকেই। একদা ব্রিগেডের মঞ্চে ''এক ছোবলেই ছবি" বা "জাত গোখরো'' স্লোগানে সরব হওয়া অভিনেতার রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফের আলোচনায় এসেছে সেই নির্বাচন।

আরও পড়ুন: পর্দার ফাটাকেষ্ট না কি তৃণমূলের শমন! এক ছোবলেই ছবি করতে পারবেন মিঠুন?

গ্রাম-নির্ভর জেলাসফর এবং মিঠুন-স্পর্শে সমস্ত সমস্যা কাটিয়ে ভোট বৈতরণী পার করতে যে 'ডিস্কো ড্যান্সার' প্রয়োজন, একথা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন বঙ্গের বিজেপি নেতারা। অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় 'দিলীপায়ন' ছাড়িয়ে মিঠুন দিয়েই ফের লক্ষ্যভেদে এগোচ্ছেন তাঁরা।

কিন্তু এই আবহেই, বাংলার সৌরভ ছাড়িয়ে, আর এক দাদা মিঠুন দিয়েই কেল্লাফতে করার অঙ্গীকারের মধ্যেই, ভোটপাখি না রাজনৈতিক লড়াইয়ের আসল বাজপাখি, এই প্রশ্ন উঠেছে আবার। আর এখানেই উঠে এসেছে নরেন্দ্র মোদির নাম।

'দিদি ও দিদি...'
২০১৯ সাল। লোকসভা নির্বাচনের আবহ। দিল্লির রাজপথে তখন ক্ষমতার-গাড়িতে ৫ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই আবার ক্ষমতায় আসার জন্য প্রয়োজন হল পশ্চিমবঙ্গ! ২০১৪-র ২টি লোকসভা আসনের জয় ছাড়িয়ে সেবার অমিত শাহদের বঙ্গ-টার্গেটে বেড়েছে আসন সংখ্যা। মোদি এলেন। বিজেপি-র একাধিক তারকা মুখের আগমনেও মুকুল রায়, কৈলাশদের বিজয়বর্গীয়-আবহে মুখরিত হলো মোদির নাম। একের পর এক জনসভায় দেখা গেল মোদিকে। প্রকল্পের উদ্বোধন থেকে শুরু করে বিরাট ভার্চুয়াল যজ্ঞে দুর্গাপুজো, সবটাই কেন্দ্রীভূত হলো তখন।

যা চলল ২০২০, ২০২১ পর্যন্ত। একাধিক সভায় বাংলা বললেন মোদী। একদিকে তৃনমূলের বহিরাগত কটাক্ষ ছাড়িয়েও একাধিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া মমতার দলকে রাজনৈতিক ফাঁদে ফেললেন মোদি। আকস্মিক ভালো ফল করে ২০১৯ চমকে দিল বিজেপি-কেও।

অনেকেই বলেন, একপ্রকার 'মোদি ম্যাজিক'-এই বিপদ বাড়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee)। একের পর ক্ষেত্রে বাংলায় মোদির আগমন এবং শাহদের নির্বাচনী-কৌশলে বিপদ সংকেতে নিমজ্জিত হয় তৃণমূল।

'কে তুমি হরিদাস পাল'
একদিকে মোদি-বিপদ! অন্যদিকে ব্যক্তিগত আক্রমণের চুল্লিতে তখন ফুটছে বাংলা। নির্বাচনী আবহেই মূল লক্ষ্য মোদিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন মমতাও। একাধিক বিজেপি নেতার মমতা-ক্ষোভের মধ্যেই সরাসরি মোদিকে তুলোধোনা করতে শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কাজের কাজ? পরিযায়ী পাখির অভিযোগ গায়ে মেখেও সেই মোদি-অস্ত্রেই একাধিক লোকসভা আসন হারাল তৃণমূল।

২০২০-২০২১
বিজেপি-র দিল্লিযাপন বাড়ল বঙ্গের আবহে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আনাগোনা বাড়ল ফের। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, প্রশান্ত কিশোর আবহ এবং শুভেন্দু বিপদের দোসরে চাপে থাকা তৃণমূলের চাপ বাড়ালেন অমিত শাহরা। মোদির আগমনে, ভার্চুয়ালে প্রচারে ঝড় তুলল বিজেপি। বড় নির্বাচনে অংশ নিতে মোদিত্ত্বেই ভরসা রাখল বিজেপি। আর বঙ্গেই নানান ভাবে উপস্থিত হলো নরেন্দ্র-প্রসঙ্গ।

২০২২
ভোট নেই! মোদি নেই! বঙ্গ বিজেপির শুভেন্দু-সক্রিয়তা এবং রাজ্য সরকারের একাধিক দুর্নীতি-ফাঁদেও প্রশ্ন উঠল মোদি-শাহদের আগমনের ঘাটতি নিয়ে। যে আনাগোনা 'বড় নির্বাচন'-কে কেন্দ্র করে দেখা যাচ্ছিল, তাই-ই যেন নির্বাচনের প্রকোপ কমতেই ক্রমশ নিম্নমুখী করল গ্রাফ। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, ভোটহীন বাংলায় মোদির আগমন কম তো বটেই, অন্যান্য তারকা বিজেপি নেতার পদচারণার হ্রাস চোখে পড়ার মতো! সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে বাম, তৃণমূল নিয়েও। অনেকের দাবি, বহিরাগত বিজেপি আসলে ভোটের সময়ের পাখি!

'জাত গোখরো'
আর ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গের ভোট-রাজনীতির প্রেক্ষাপট আলোকিত করছেন মিঠুন চক্রবর্তী। বারবার এই রাজ্যে তাঁর আগমন এই ভোটপাখি এবং বঙ্গের জন্য কাজের দ্বন্দ্বকে নিয়ে আসছে সামনে। যেখানে প্রশ্ন উঠছে একাধিক। কিন্তু বঙ্গের গেরুয়া-ঘরের মুখ হিসেবে উঠে আসছেন মিঠুন। যা আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেড়েছে আরও।

বড়-কাণ্ডে মোদি-সঙ্গ, ছোট কেসে মিঠুন!
আর মিঠুনের বঙ্গ-পর্যটন এবং বলিউডের মহাগুরু, স্লোগান-রাজ থেকে শুরু করে একাধিক জেলায় সফর, ফের তৈরি করেছেন নির্বাচনী জল্পনা। যা কেন্দ্রীভূত হয়েছে মূলত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বড় নির্বাচন অর্থাৎ দেশের লোকসভা নির্বাচন, রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির মুখদের কাজে লাগানো হলেও বিজেপি-র ব্রহ্মাস্ত্র মোদির প্রভাব বিস্তারিত হলেও এখন আর নয় কেন! ঠিক এই জল্পনার মধ্যেই দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্যের অধীনে। আর এই গ্রামবাংলার নির্বাচন খুব একটা বিরাট ভূমিকা নেয় না দেশীয় রাজনীতির রাজ্য প্রেক্ষিতে। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়েই তথাকথিত ছোট নির্বাচনে মিঠুন দিয়েই বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি। যে মিঠুনকে দিয়ে কয়েকটি সংলাপ আর খানিকটা হাততালি ছাড়া খুব একটা কাজে লাগেনি বিধানসভা নির্বাচনে, সেই মিঠুনকেই ফের পঞ্চায়েত নির্বাচনের উত্তাপে অবতীর্ণ করতে চাইছে বিজেপি।

আর ঠিক এখানেই অনেকের দাবি, রাজ্যে শুভেন্দু অধিকারীর দলীয় সংগঠন বিস্তার এবং নির্বাচনী অভিজ্ঞতার তুলনায় মিঠুন খানিকটা কম! তবুও মিঠুনের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মোক্ষম চাল দিতে চাইছে গেরুয়া-শিবির।

পরিযায়ী না স্থায়ী?
আর একাধিক কৌশল, বিতর্ক এবং নির্বাচনী রাজনীতির আবহে উঠছে প্রশ্নও। দলীয় কোন্দল আর নানা ইস্যুতে একটি বড় অংশের মানুষের সমর্থন ছাড়া কীভাবে উঠে দাঁড়াবে বঙ্গের বিজেপি, এই আশঙ্কার মধ্যেই মিঠুন-প্রভাবে উঠে আসছে ভোটপাখি, পরিযায়ী আর ভূমিপুত্রের দ্বন্দ্ব! মোদি-শাহ অথবা একাধিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আবহের বিস্তারে, অভিযোগে উঠে আসছে মিঠুনের পর্যটক সত্তার দোলাচল নিয়েও। কেউ কেউ বলছেন, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার হয়ে যাওয়ার পরে তেমন একটা এই রাজ্যে পা পড়েনি মিঠুনের। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং মমতার চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে রাজ্যে পা দিয়েছেন মিঠুন। চে গুয়েভারার মতো টুপি আর দাদাসুলভ স্টাইলে মঞ্চ মাতিয়ে দিয়েছেন মিঠুন! হাততালি পড়েছে বিস্তর। মিঠুন দেখতে জমেছে ভিড়। কিন্তু রাজনীতি? নির্বাচন? একাধিক কাজের কাজ; এর আবহে প্রশ্ন উঠেছে ভোটের পাখি, পরিযায়ী হিসেবেই কি আগমন ঘটেছে মিঠুনের? যা পঞ্চায়েতের পরেই ফের খুঁজবে বিদায় নেওয়ার পথ! অর্থাৎ ভোট মরশুম ফুরোলেই ইতিউতি না ঘুরে উটি ফিরবেন মিঠুন, একথাও ভাবছেন অনেকেই। যেখানে দাঁড়িয়ে এই তকমা ছাড়িয়ে আদৌ পঞ্চায়েত নির্বাচনে মিঠুন অস্ত্র কাজ করবে কি না, তা নিয়েও চিন্তার মুখোমুখি হচ্ছে বঙ্গের বিজেপি নেতৃত্ব।

More Articles