লক্ষ্মীর পাঁচালি আসলে মেয়েদের জীবনযাপনের ক্ষমাহীন নির্দেশাবলী
Modern Lakkhir Panchali : পাঁচালিটিতে যত কিছু অনাচার বা অসুবিধা, সব কিছুর দায় মেয়েদের উপরেই।
আমি ভালো মেয়ে হতে চাই না মা
আমি দুষ্টু হতে চাই
আমি খুব সাঙ্ঘাতিক কিছু করে ফেলতে চাই মা
চাই আমার শিকড়শুদ্ধু উপড়ে নিয়ে যাক ও
এই সব আপোষগন্ধী পথ, এইসব লজ্জারাঙানো চুপ
সব ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে একটা গল্প, নাটক, জমাটি কাব্যকথা
হতেই থাকবে, এমন কারুর সঙ্গে
আমি চলে যাব মা।লক্ষ্মী মেয়েটি তার মাধ্যমিক পরীক্ষার অঙ্ক প্র্যাকটিস
খাতার পেছনে লিখেছিল।
আজ খুব মনে পড়ছে সেদিনের কথা।
ক্লান্তিহীন যখন সে রঙিন জীবন দেখে চলে।
অথবা, বেরঙিন স্বামীর সঙ্গে এককালে পালিয়ে আসার
গন্ধমোছা গেঞ্জি কেচে কেচে
ইতিহাস লেখে তার ক্লান্তি খাতা খুলে।
যেভাবেই দেখো, মেয়েটি চেয়েছিল।
মেয়েটি পেয়েছে।
অকরুণ, তাই, তুমি ওর
উড়ে যাওয়া তুলো, ফেঁশো, ছেঁড়া চুল সব স্পষ্ট বোঝ!
ধী ও শ্রী – এই দুইখানি গুণের ভেতর পৃথিবীর সমস্ত আকাঙ্খা আছে, ঠিক। সুন্দর, নান্দনিক, সুষম, শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রতিসাম্যে স্থিত। শিল্প ও জীবনের আদর্শ, এইই। কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ের ভেতরে ধী ও শ্রী দেখতে চাওয়ার দাবি যেভাবে গভীর গভীরতর শিকড় চারিয়ে দিয়ে সমস্ত সমাজকে জেন্ডার নিউট্রাল না করে একপেশে করে দিয়েছে, তা মেয়েদের ওপরে কত বড় দাবি, কত বড় পেষণ, এ কথা বোঝা খুব দরকারি। দীপাবলীর দিন অলক্ষ্মী বিদায়ের মন্ত্র বলতে শেখানো হয়।
"ওঁ অলক্ষ্মীং কৃষ্ণবর্ণাং কৃষ্ণবস্ত্রপরিধানাং মুক্তকেশীং ... বিকৃতদ্রংষ্ট্রাং কলহপ্রিয়াম্"
অলক্ষ্মী? লক্ষ্মীরই সহোদরা সে। যা কিছু লক্ষ্মী নয় তাকে চিহ্নিতকরণের অত্যন্ত জটিল এক খেলা চলে মেয়েদের জীবনে, আজন্ম। এভাবে মেয়েদের জোরে কথা বলতে, জোরে হাসতে, নিজের দাবি আদায় করতে বারণ করে দেওয়া হয়। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশের খেলা চলে। মেয়েরা এই প্যাটার্নে এক সময় নিজের অজান্তেই অংশগ্রহণ করে ফেলে এবং সারা জীবনের জন্য এই লক্ষ্মী মেয়ে হবার চক্করে পড়ে যায়।
এই ধরনের জীবনপ্রণালী ও কর্মসূচি বেঁধে দেওয়ার যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র অনেক। যেমন, এক এজেন্ট হলো লক্ষ্মীপুজোর দিনে পাঠ্য লক্ষ্মীর পাঁচালি বইটি। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ কৌম জীবন থেকে উঠে আসা ব্রতকথার ঢঙে, সামাজিকভাবে সম্মানিত এক প্রথা এই পাঁচালি পাঠ। শহুরে জীবনেও তা স্থান করে নিয়েছে। মেয়েদের জীবনযাপনের আদর্শ বেঁধে দেওয়ার এ এক পদ্ধতি।
আরও পড়ুন- ম্রিয়মান পটুয়া গান! লোকসংস্কৃতির অন্তর্জলিযাত্রায় লক্ষ্মীর পট, পাঁচালির গান
সচরাচর দশকর্মা ভাণ্ডারে নানা পূজা সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গেই আসে পাঁচালিটি। একটি পাতলা ফিরফিরে কাগজে, সাদা বা ঘিয়ে রঙের উপর লাল অক্ষরে ছাপা পাঁচালি, সচরাচর সেইসব প্রেসে বা প্রকাশকের ঘরে ছাপা হয় যাকে কথ্যবাংলায় বটতলা বলি। না আছে সম্মান, না আছে অর্থবল। এইসব বইয়ের সামান্য দাম হয়, তেমনই এর লেখকরাও নাম না জানা, অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবে থাকা কোন কোন পাঁচালি কবি! লেখক বলতে, পাঁচালির কোনও আদি বা মূল লেখক আমরা পাই না। কিন্তু এও আশ্চর্যের যে, একটিই পাঁচালির অন্য অনেকগুলি ভার্সন বা ভাষ্য পাওয়া যায়। মূল কাঠামো এক থাকে, তা বাদে ছোট ছোট ডিটেলে নানা তফাত থাকে।
অন্তত একশো বছর ধরে বদলে গেছে বাঙালি মেয়ের মুখের ভাষা, বদলে গেছে ব্রত পালন আর পুজো করার রীত। পাল্টায়নি শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালির মূল সুর। যে সুর এখনও ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ। কী কী করলে লক্ষ্মী কুপিতা হন আর কী কী করতে থাকলে লক্ষ্মীকে ঘরে ধরে রাখা যাবে সেই তালিকায় কোনও পরিবর্তন চোখেই পড়ে না। মোটের উপর, বলাই যায় লক্ষ্মীর পাঁচালি এত বছর ধরে ইভলভ করেনি, তার কোনও উন্নয়ন হয়নি। এবং প্রায় পুরো ক্ষেত্রেই পাঁচালিটিতে যত কিছু অনাচার বা অসুবিধা, সব কিছুর দায় মেয়েদের উপরেই। মেয়েরাই সংসারকে ধরে রাখবেন আর তাই সংসার রসাতলে যেতে বসলে মেয়েরাই ভুলচুকের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। নারীকেন্দ্রিক এই বয়ান সোজা কথায় রীতিমতো নারী স্বাধীনতা ও লিবারাল মূল্যবোধ বিরোধী। আর তাই আপত্তি।
কোনও এক কাল্পনিক অবন্তীনগরের এক ব্যবসায়ীর বৃহৎ সংসারে গোলমাল লাগা ও তার সমাধান হবে প্রতি পাঁচালিতেই, তবে উনিশ-বিশ বাদ দিলে, শুরুর দিকটা প্রায় সব পাঁচালিতেই একইরকম। লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়বেন মূলত মহিলারাই, এটা একটা ঘরোয়া পুজো এবং সবাই তামা তুলসি হাতে নিয়ে পাঁচালি শুনবেন এমত কৌম প্রথায় আবদ্ধ আমাদের পাঁচালি পাঠের নিয়তিটুকু। এই ‘সকলের’ প্রায় প্রত্যেকেই নারী, ঘরের লক্ষ্মী বলতে যা বোঝায়… তাই মনে হয় যেন প্রব্লেমেটিকের প্রতি লক্ষ্মী যেই মুহূর্তে নজর করেন এবং অন্নহীনতার কারণ দর্শাতে শুরু করেন, সেটা হয়ে যায় প্রায় নারীদের একটি ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা ‘টু ডু লিস্ট’। কী কী বিধি ও নিষেধ তার তালিকা। যেন মেয়েদের আচার আচরণের উপরেই নির্ভরশীল দেশের অর্থনীতি, অন্ন শস্যের বাড়বৃদ্ধি।
নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা।
ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায়।
গুরুজনে অকারণে মন্দ বাক্য কয়।।
যে নারী সকালে না দেয় ছড়া।
করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া।।
গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে।
আমি যে থাকি না তাহার ঘরে।।
এঁয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে।
মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে।।
নিত্য যে না করে অবগাহন।
তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন।।
তিথি ভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায়।
হই না কভু তার ওপর সহায়।।
যে মনুষ্য ভক্তি ভরে একাদশী না করে।
নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে।।
উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে।
ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে।।
গুরুজন দেখি যারা প্রণাম নাহি করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জালে ঘরে।।
এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান।
কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান।।
আরও পড়ুন- মায়ের জাত থেকে মাদারজাত! মাতৃত্ব দিয়ে মেয়েদের আসলে ঘুষই দেওয়া হয়
ইতিহাসের অবদানই বলুন আর সময়ের দান, আজকের মেয়েরা অনেকটাই আসলে পালটে গেছেন। তাই এই লক্ষ্মীর পাঁচালিকে প্রায় আউটডেটেড মনে হচ্ছে ইদানীং। আজকের মেয়েদের জীবন আর আগের মতো নেই। তথাকথিত লক্ষ্মী মেয়েরা আজ সরস্বতীর বরপুত্রীই শুধু না, তারা কর্মে দশভুজা হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হয়েও তাকে সচেতনে পাশে সরিয়ে রেখে বলতে শিখেছেন, ‘আই অ্যাম নট পারফেক্ট’। আমার সর্বংসহা হওয়ার দায় নেই, সর্বগুণান্বিতা হওয়ার দায় নেই। আমি তোমাদেরই মতো দোষে গুণে মানুষ। আমাকে পুরে দিও না স্টিরিওটাইপের খাঁচায়।
এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা কিছু মেয়েরা লিখতে শুরু করেছিলাম নতুন একটি লক্ষ্মীর পাঁচালি। যদিও বিশাল সমুদ্রে এক ফোঁটা জল ঢালার মতোন এই প্রচেষ্টা। সেই পাঁচালিতে লেখা হয়েছিল আধুনিক কিছু ভাবনার কথা। মেয়েদের রোজকার জীবনের সঙ্গে যা যুক্ত। যা শাসন শৃঙ্খলার কথা নয় কিন্তু পরিবেশ, পরিজন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি কথা। কেউ লিখেছিলেন নিরাপদ সন্তান জন্মদানের কথা, কেউ লিখেছিলেন জল বাঁচানোর কথা। কেউ লিখেছিলাম বিখ্যাত মেয়েদের কথা, যাঁরা আমাদের স্মরণীয়া লক্ষ্মী। ম্যানুয়ালের মতো হোক নতুন পাঁচালি। কোনও ডাক্তার যদি স্বাস্থ্য নিয়ে পাঁচালি লেখেন, মেনস্ট্রুয়াল হেলথ, প্রজনন, বোন হেলথ এগুলোর ভুল ধরান, তাহলে মিথ ভাঙানো যায়। গার্হস্থ্য হিংসা বা ডোমেস্টিক অ্যাবিউজের ক্ষেত্রে কিছু আইনের কথাও এই ছলে বলাই যায়। সত্যিই কাজের কাজ হয় তবে। গ্রামে গঞ্জেও তা প্রসারিত করা যাবে। পাঁচালির মাধ্যমেই লোকশিক্ষেও তো হয়।
যেহেতু এ পাঁচালি কোনও একজনের লেখা না, তাই এর ভাষ্য বদল করাও সম্ভব বলেই মনে হয়।
“লক্ষ্মী বলেন যদি পার মেয়েগণ
পৃথিবীর তাপজ্বালা করিও মোচন।
কল খুলে রেখে দিয়ে বহায়ো না পানি
শুদ্ধ পরিষ্কৃত জল মহামূল্য জানি।
ফেলিও না বীজ কোনও প্লাস্টিকে অবুঝ
মাটিতে স্থাপন কর, বাড়াও সবুজ।”
এটুকু নমুনা রাখা গেল না হয়। লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলা হোক। অলক্ষ্মী বলে মেয়েদের দাগিয়ে দেওয়া বন্ধ হোক। দিক দিক থেকে, গ্রাম মফসসল থেকে, সাইকেল চালানো মেয়ে, স্কুটি চালানো মেয়ে, ট্রেনে-মেট্রোতে-বাসে চাপা মেয়ে, সেবা কাজ ও ঘরে ঘরে হোম ডেলিভারি দেওয়া মেয়ে... এরা সবাই এখন রাজপথের দিকেই আসছেন... ছোট বাড়ি থেকে, বস্তির ঘর থেকে, বহুতল থেকে… এরা লক্ষ্মী বা অলক্ষ্মী নন। এঁরা মানবী, লড়াই করে বেঁচে থাকা মেয়ে। মেয়েদের জীবনে একটা আলাদা জোয়ার এসেছে, তার কিছুটা তো অবশ্যই কনজিউমার মার্কেটের দান, কিছুটা হয়তো অর্থনীতির চাকায় পিষে গিয়ে নিরুপায়, আরও একটু অর্থোপার্জনের তাগিদ।
আরও পড়ুন- বিধবার কামনায় ব্রাত্য ধন দৌলত, ঐশ্বর্য! লক্ষ্মীপুজোয় আজও একঘরে ‘স্বামীহীনা’রা
দেখেছি, ভোর পাঁচটায় উঠে শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য রান্না করে, নিজের রুটি তরকারি স্টিলের টিফিন বাক্সে ভরে, তারপর ট্রেনে চেপে হাসপাতালে নার্স বা মেট্রনের চাকরি করতে আসা মহিলাকে। দেখেছি, দুপুরে ভাতঘুম না দিয়ে শাড়ির বা গয়নার ব্যবসা করা গৃহবধূকে। দেখেছি, স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কাজ করা মেয়েদের, চাষের বা পারিবারিক পেশায় অকাতরে শ্রম করা মেয়েদের। দেখেছি, অজস্র কান্নার পর মুঠো মুঠো চুল অত্যাচারী স্বামীর হাতে দান করে দেওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েকে। ঘর ছেড়ে আসা, লড়াই করা মেয়েদের। মেয়েমানুষ কত কী না করছে। সংসার ছেড়ে দিয়ে বিয়ের কারণে শেষ না হওয়া পড়া আবার পড়ে ডিগ্রি নিচ্ছে, চাকরি পাওয়ার দোষে স্বামী হাত কেটে নেওয়ার পর চাকরিতে যোগ দিয়ে সফলভাবে কাজ করছে। সুখে সংসার করছে মেয়েরা, দুঃখে ভেঙে পড়ছে না মেয়েরা, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়তে পড়তেও দাঁড়িয়ে থাকছে।
দিনশেষের ক্লান্তি ভুলতে সে তুলে নিচ্ছে যোগাসনের মুদ্রা নিজ শরীরে। অথবা জিমে যাচ্ছে নিজের দেখভাল করবে বলে। ধনীঘরের বউয়েরাও সমস্ত আপোস ভুলে সমাজসেবায় আসছে। ক্যানসার রোগীর সেবা করছে তারা বিবিধ এনজিওতে যোগ দিয়ে। নিজের চোখে দেখেছি, প্রকৃতই এরা লক্ষ্মী সরস্বতী। চিরাচরিত স্টিরিওটাইপ লক্ষ্মীপ্রতিমার খাঁচার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মেয়েরাই। সাঁতার পোশাকে নিজেদের ছবির পর ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট হয়েছে... করেছেন বিদ্রূপ। বলেছেন, ‘মাই বডি মাই রাইটস’। আমার শরীর আমার অধিকার। স্বল্পবসনা মেয়েদের স্বৈরিণী বলে দাগিয়ে দেয় আমাদের সমাজ। মেয়েদের বলে রেখেঢেকে না চললে তুমি ধর্ষিত হবে। এই সব কালিমা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো আজ। নিজের শরীরের অধিকার, নিজের মাতৃত্ব ও জরায়ুর অধিকার, নিজের সমস্ত সত্তার, ভালো থাকা ও খারাপ থাকার অধিকার নিজের হাতে নিয়ে ফেলার অঙ্গীকার।