রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে! যেভাবে মিথ্যে খবরের জাল ছিঁড়েছেন এই দু'জন
Muhammed Zubair-Pratik Sinha: নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত মহম্মদ জুবায়ের ও প্রতীক সিনহা।
৭ অক্টোবর ঘোষিত হবে নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল কমিটির ভাষায় 'যে ব্যক্তি বা সংগঠন মানবকল্যাণে নিজেদের সর্বোৎকৃষ্ট অবদান রেখেছেন তাঁকে বা তাঁদের সম্মানজ্ঞাপনেই এই পুরস্কার'। আরও ৩৪৩ জন মনোনীতর সঙ্গে এইবার সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ভারতের দুই নির্ভীক সাংবাদিক- প্রতীক সিনহা ও মহম্মদ জুবায়ের। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম টাইমসের সূত্র অনুযায়ী, ২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ২৫১ জন প্রার্থী ও ৯২টি সংগঠনের সঙ্গে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে প্রতীক ও জুবায়েরের নাম।
টাইমস-এর একটি সূত্রের মতে, বর্তমান ভারতে যেভাবে গুজব, বিকৃত তথ্য হিংসা ও দাঙ্গার জমি প্রস্তুত করছে- তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই মনোনয়ন পেয়েছেন অল্ট নিউজের কর্ণধার প্রতীক সিনহা ও মহম্মদ জুবায়ের।
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রতীক সিনহা ২০১৭ সালে তৈরি করেন অলট নিউজ। ২০১৩ সাল থেকেই ভারতের মানচিত্রে থাবা বসাতে শুরু করে ভুয়া অর্ধসত্য তথ্য। এই ব্যবহারের পুরোভাগে ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি-র সাইবার সেনা। ২০১৬ সালের গুজরাতে চার জন দলিত ছেলে গরুর মাংস কাটার অপরাধে প্রহৃত হয়। তারপরেই ২০১৭ সালে মহম্মদ জুবায়েরের সঙ্গে মিলিতভাবে অল্ট নিউজ তৈরি করেন প্রতীক সিনহা। অল্ট নিউজ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল, হিংসা ও উসকানির জন্য যে মিথ্যাকে ব্যবহার করছে বিজেপির আইটি সেল, তার বিরুদ্ধে তথ্য অনুসন্ধান ও সত্য প্রতিষ্ঠা। বিজেপি-শাসিত ভারতে সহজ ছিল না এই কাজ।
আরও পড়ুন: সরকারি রক্তচক্ষুর দাস নয় আইন, মহম্মদ জুবায়েরের জামিন যে বার্তা দিল
দুনিয়াজুড়েই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিথ্যের প্রাচীর তৈরি করছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলি। গুজব, ভুয়া খবর, অর্ধসত্য খবর ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষের বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠছিল প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১২-র শুরুর দিক থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কীভাবে মানুষের মনে নিজেদের মতাদর্শের বীজ বুনে দেওয়া যায়, তাতে প্রথম সচেষ্ট হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। তৈরি করা হয় আইটি সেল। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের মূল কাজ হলো মিথ্যে তথ্য, হিংসার জিগির সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই অভিযোগও উঠেছে, নিজেদের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই তাতে যোগ্য সঙ্গত করেছিল ফেসবুক। এই মিথ্যের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু করেছিলেন মহম্মদ জুবায়ের ও প্রতীক সিনহা।
ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিসর বিজেপি-র শাসনকালে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এঁদের মধ্যে থেকেও যাঁরা সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বারবার নেমে এসেছে রাষ্ট্রের খড়্গহস্ত। এই ভুয়া তথ্যর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই ২০২২ সালের জুন মাসে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে মহম্মদ জুবায়েরকে। তাঁর অপরাধ, ২০১৮ সালের একটি ট্যুইট। সেই ট্যুইটে তিনি ভুল তথ্য ও গুজব কীভাবে হিংসাকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেয়, তারই নমুনা তুলে ধরেছিলেন। দিল্লি পুলিশের বক্তব্য ছিল, এই ট্যুইট সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করতে পারে, তাই গ্রেফতার করা হলো জুবায়েরকে। জুবায়েরের গ্রেফতারি বিশ্বজুড়েই ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রকৃত ছবিটাকে আরেকবার বেআব্রু করে দিয়েছিল। আমেরিকার সাংবাদিক সংস্থা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, "মহম্মদ জুবায়েরের গ্রেফতারি আসলে ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপন্ন রূপেরই বহিঃপ্রকাশ। ভারত সরকার কোনওভাবেই সাংবাদিকদের কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারছে না।" এরপরে সুপ্রিম কোর্ট জামিন দেয় মহম্মদ জুবায়েরকে।
মিথ্যের বিরুদ্ধে মহম্মদ জুবায়ের ও প্রতীক সিনহার লড়াই
২০১৭ সালে যখন অল্ট নিউজ তৈরি হয়, ততদিনে ভারতে অর্ধসত্য তথ্যের শিকড় অনেক দূর ছড়িয়ে গিয়েছে। এর আগে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন থেকেই মিথ্যের ঝুলি সাজিয়ে ভোট আদায়ের রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারতীয় জনতা পার্টি, এমন অভিযোগ উঠেছে বারবার। দু'একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। ২০১৬ সালের ১৭ থেকে ২৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে বিজেপি। যার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটির নাম ছিল, 'মাই ফার্স্ট ভোট ফর মোদি', যার পিছনে খরচ হয়েছিল ৪৬.৬ লাখ টাকা। কিন্তু বিষয় হলো, এই রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোর কোনওটারই প্রকৃত আর্থিক হিসেব নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা পড়েনি। প্রতীক সিনহা ও মহম্মদ জুবায়েরের অল্ট নিউজ এই ভুয়া তথ্যের অনুসন্ধান করে দেখিয়েছিল, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন-বাবদ বিজেপি ব্যয় করেছিল প্রায় ১.৮ কোটি টাকা।
ভারতে করোনাকালে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই একাংশ 'মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে', এমন দাবিতে কিছু ভুয়া পোস্ট করতে শুরু করে। ২৭ মার্চ কতকগুলি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তাতে লেখা হয়, দেখুন আজ কলকাতার মেটিয়াবুরুজের লকডাউনের চিত্র। সেই ছবিগুলি ট্যুইটারে পোস্ট করেন মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল ও বিজেপি নেতা তথাগত রায়। অল্ট নিউজের ফ্যাক্ট চেকিংয়ে দেখা যায়, ছবিগুলি আসলে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির। কেবলমাত্র মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই ছবিগুলিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে বিজেপির সাইবার সেনা। আবার ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গার সময় একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ পেজ থেকে ভুয়া বার্তা ছড়িয়ে হিংসা ও দাঙ্গায় উসকানি দেওয়া হয়। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও মিথ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করতে এগিয়ে এসেছিল অল্ট নিউজ।
আজকের ভারতে যেভাবে মিথ্যে ও হিংসার বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে মহম্মদ জুবায়ের ও প্রতীক সিনহার সত্যি খোঁজার লড়াই অনেককেই সাহস জোগায়। এই বিদ্বেষের চক্রব্যূহ ভেদ করার লড়াই-ই মহম্মদ জুবায়ের ও প্রতীক সিনহাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দিয়েছে।