দেহ কেটে ৪২ টুকরো! মিশরের রহস্যময় শিয়াল দেবতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে ভয়াবহ গল্প!
Mystery of Egyptian God Anubis : ওসাইরিস তার ভাই সেথের স্ত্রী নেপথিসের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন। ফলে নেপথিসের গর্ভে জন্ম নেয় আনুবিস।
মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির সামনে প্রথমেই যে দেবতা হাজির হন তিনিই হলেন মৃতের জগতের অধিকর্তা আনুবিস। মারা যাওয়ার পর মৃত ব্যক্তির বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললে আনুবিস তাকে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন। তারপর সেই মৃত বাঁচতে থাকেন পরবর্তী এক জীবন! প্রাচীন মিশরীয় পুরাণের অন্যতম বিখ্যাত দেবতা এই শিয়াল মানুষ। মানে মাথাটা শেয়াল কুকুরের আর দেহটি মানুষের। প্রাচীন মিশরীয় শিল্পে শেয়াল বা কুকুরের মাথাওয়ালা মানুষের ছবি মেলে বিস্তর। রহস্যময় এই অর্ধ মানুষ অর্ধ প্রাণীই মিশরীয় দেবতা আনুবিস। আনুবিস মমি তৈরির দেবতা। আরও ভালো করে বলতে গেলে, মৃতদেহকে দীর্ঘকাল ধরে পচনরোধী করে রাখা, সুবাসিত রাখার প্রাচীন মিশরীয় কৌশলের দেবতা এই আনুবিস। তিনিই প্রথম মমি তৈরি করেছিলেন, তাও নিজের বাবার দেহের। আনুবিসের উপাসনার প্রধান কেন্দ্র ছিল কিনোপোলিসে। গ্রিক ভাষায় কিনোপোলিসের আক্ষরিক দাঁড়ায় কুকুরের শহর।
ঐতিহাসিকরা বলছেন, প্রাক-বংশীয় যুগে (৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে) মরুভূমি বরাবর মৃতদের সমাধিস্থল ছিল। এই অগভীর কবরগুলিই ছিল বন্য কুকুর এবং শেয়ালের আড্ডা। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরে ক্ষুধার্ত শিয়ালরা অগভীর মরুভূমি মধ্যে কবর খুঁড়ে পুঁতে রাখা মৃতদেহ খুঁড়ে খেয়ে পেট ভরত। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে এই শিয়াল কুকুরের মরদেহ খাওয়ার বিষয়টি ছিল বিভীষিকার মতোই। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতেন, মৃত্যুই শেষ না। মৃত্যু পরবর্তী এক জীবন রয়েছে। সেই জীবন উপভোগ করার জন্য আস্ত একটা দেহ চাই। মরার পর দেহ শেয়াল কুকুরে খেলে আর কীভাবেই বা পরপারে জীবন কাটানো যাবে মহানন্দে? তাই মৃতদেহ সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তারা। ফলস্বরূপ, প্রিয়জনদের মৃতদেহ রক্ষা করার জন্য শেয়াল দেবতার কাছেই প্রার্থনা করত মানুষ। ভয় থেকে ভক্তির সেই চিরাচিরত প্রথা! এইভাবেই বন্য শিয়াল মৃতদের সঙ্গে জুড়ে যায় মিশরীয় সংস্কৃতিতে, আনুবিস পূজিত হতে থাকেন পাতালের দেবতা হিসাবে। মিশরতত্ত্ববিদদের একাংশের মতে আবার, প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত কোনও ব্যক্তির মৃতদেহের সঙ্গে কুকুরকে সমাহিত করা হলে ওই কুকুর নাকি মৃতের হয়ে আনুবিসের কাছে সুপারিশ করবে।
আরও পড়ুন- নুন দিয়ে দেহ শুকনোর পর কী এমন মাখানো হতো দেহে? অবশেষে ফাঁস মমি তৈরির রহস্য
সে না হয় হলো, কিন্তু মৃতদেহ সংরক্ষণ করাতেই তো সব শেষ না। মানুষ মরা দেহের সর্বস্ব লুটে নিতেও ছাড়েনি, কখনই। মিশরের নিয়ম অনুযায়ী ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা মারা যাওয়ার পর তাদের প্রিয় জিনিসপত্র এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র তাদের দেহের সঙ্গেই কবর দেওয়া হতো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত ব্যক্তিরা পরবর্তী জীবনে এই বস্তুগুলি উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু মড়াদের অত কপাল কই! কবরের হানা দিতে থাকল চোররা। প্রায়ই কবর ফাঁকা করে দামী দামী জিনিস চুরি করে নিয়ে যেতে থাকল তস্করবাহিনী। এই চোর ডাকাতদের তাড়ানোর জন্য মমি কারিগররা আনুবিসের ভাস্কর্য রেখে দিতে থাকলেন কবরে, কবরের মধ্যেও খোদাই হতে থাকল আনুবিসের মূর্তি। পুরোহিতরা সমাধির দেয়ালে নানা অভিশাপ খোদাই করে রাখতে বললেন। শেয়াল দেবতাকে আহ্বান করে নানা মন্ত্রও লিখে রাখলেন। মমি তৈরি এবং সমাধি অনুষ্ঠানের সময় আনুবিসের প্রতিনিধিত্বকারী পুরোহিতরা ঈশ্বরের ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য শেয়াল-মাথার মুখোশ পরে থাকতেন।
তবে পরবর্তীকালে প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে আনুবিসের গুরুত্ব কমতে থাকে। দেবতা ওসাইরিস প্রাধান্য পেতে থাকেন এবং ধীরে ধীরে আনুবিসের জায়গায় তিনিই হয়ে ওঠেন মৃতদের শাসক। তবে মৃতদের পুরাণে আনুবিসের ভূমিকা অত্যন্ত রহস্যময়। বিশ্বাস করা হয়, মামিফিকেশন বা মমি তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিলেন তিনিই। এই প্রক্রিয়াতেই একজন মানুষ মারা গেলেও পরবর্তী জীবনে বেঁচে থাকতে পারে। মিশরীয় গল্প অনুযায়ী চাঁদের দেবতা থোথের সঙ্গে আনুবিস নাকি মৃতদের হৃদয়কে পাতালের ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতেন। মৃত মানুষদের আত্মার যোগ্যতা বিচার করা হতো এভাবেই। তবে এই মমি তৈরির নেপথ্যে রয়েছে এক জঘন্য হত্যাকাণ্ড!
আনুবিস নাকি ছিলেন দেবতা ওসাইরিসের ঘনিষ্ঠ। হয় একাংশ বলে, ওসাইরিসের পুত্র ছিলেন আনুবিস। দেবতা গেব এবং তার বোন নুট বিয়ে করেন, যাদের চার সন্তান জন্মায় আইসিস, ওসাইরিস, সেথ, ও নেপথিস। এদের মধ্যে নেপথিস সেথকে এবং আইসিস বিয়ে করেন ওসাইরিসকে। সূর্যদেবতা রা বৃদ্ধ হলে তিনি ওসাইরিসকে শাসনভার দেন। ওসাইরিসের নিজেও প্রচুর ঘুরতে ভালোবাসতেন বলে হামেশাই রাজ্যভার দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। এমনই এক ভ্রমণকালে ওসাইরিস তার ভাই সেথের স্ত্রী নেপথিসের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন। ফলে নেপথিসের গর্ভে জন্ম নেয় আনুবিস। সেথ সবটা জানতে পেরে রেগে ওসাইরিসকে হত্যা করেন। ভাইয়ের শরীর ৪২ টুকরো করেন। সেই টুকরোগুলি একটি বাক্সে ভরে সেটি নীল নদীতে ভাসিয়ে দেন সেথ। আইসিস ও নেপথিস বাজপাখির রূপ নিয়ে, পুরো মিশর খুঁজে ওসাইরিসের শরীরের ৪২টি অংশ উদ্ধার করেন। আনুবিস এই দেহখণ্ডগুলিকে জোড়েন। শরীরকে সুবাসিত করে ওসাইরিসকে পরবর্তী জীবনে বেঁচে থাকতে সক্ষম করেছিলেন আনুবিস। অর্থাৎ ওসাইরিসসের দেহকে মমি করে রেখেছিলেন আনুবিস। এভাবেই নিজের বাবার দেহকেই পৃথিবীর প্রথম মমি হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। এইভাবেই নাকি ওসাইরিস মৃত্যু পরবর্তী জীবনে পাতালে গিয়ে মৃতদের রাজা হন।
আরও পড়ুন- মমি বিক্রি হতো ফুটপাথে! কেন দলে দলে মমি খাওয়ার হিড়িক উঠেছিল বিশ্বে?
অন্যদিকে সেথ অবশ্য হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। ওসাইরিসের মৃতদেহ চুরি করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। একরাতে আনুবিসের রূপ ধারণ করে ওসাইরিসের মৃতদেহ চুরি করেন সেথ, তবে মৃতদেহ নিয়ে বেশিদূর যেতে পারেননি। আনুবিস বিষয়টা টের পেয়ে সেথকে ধাওয়া করলে প্রাণ বাঁচাতে ষাঁড়ের রূপ ধারণ করেন সেথ। তবে তাতেও ধরা পড়ে যান সেথ। আনুবিস তাকে ধরে নিয়ে নপুংসক করে বন্দি করে রাখেন। গল্প অনুযায়ী, পালানোর ফন্দি আঁটতে আঁটতেই একদিন বিশাল এক বিড়ালের রূপ ধারণ করেন তিনি। তাও আনুবিসকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারলেন না। ধরা পড়ার পর আনুবিস সেথের দেহে গরম লোহা দিয়ে ছ্যাঁকা দেন। এভাবেই নাকি চিতাবাঘের শরীরে ছোপ ছোপ দাগের জন্ম হয়েছে। এই পালাতে গিয়েই একবার ধরা পড়ে যান শেষবারের মতো। সেথের পুরো বাহিনীর শিরশ্ছেদ করেন আনুবিস।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২-২৯ শতকের প্রথম রাজবংশের সময়কালের মাস্তাবাসে (রাজকীয় সমাধি) আনুবিসের নাম পাওয়া যায়। আনুবিস পিরামিড গ্রন্থেও আনুবিসের উল্লেখ মেলে। এটিই প্রাচীনতম মিশরীয় ধর্মীয় গ্রন্থ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আনুবিসের যতগুলি ছবি দেখা গিয়েছে, সবেতেই, আনুবিসের কালো রঙ, যা মরুভূমির শেয়ালের বাদামী রঙের থেকে স্পষ্টতই আলাদা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, আনুবিসের এই কালো রঙের নেপথ্যে আছে বিশেষ প্রতীক। শেয়াল দেবতার প্রতীকের বিশ্লেষণ করে পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আনুবিসকে আঁকা হতো মূলত কালো রঙ দিয়ে। এই কালো রঙ আসলে পুনর্জন্ম এবং নীল নদের উর্বর মাটির প্রতীক। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অবশ্য বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও আনুবিসের কোনও মন্দির খুঁজে পাননি। সমাধিগুলোকেই আনুবিসের মন্দির হিসেবে ধরা হয়।