কখনও আটটি হাত, কখনও কৃষ্ণবর্ণ! যে নয়টি রূপে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়

শুক্লপক্ষের প্রথমা থেকে নবমী পর্যন্ত ন'টি রাত্রি দুর্গার ন'টি শক্তির পূজা করা হয়ে থাকে।

বাজল তোমার আলোর বেণু...

দেখতে দেখতে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ার সময় হয়ে এল। বাঙালিদের যেন আনন্দের সীমা নেই। পুরো এক বছরের অপেক্ষার অবসান শেষ হতে চলেছে। উমা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতে আসছে। চারদিকে কাশফুলের শুভ্রতা আর আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ জানান দিচ্ছে, আর বেশি সময় নেই।

দেবী দুর্গা মানেই দশভুজা, মহাশক্তি, মহামায়া। আবার দেবী দুর্গা মানেই মাতৃরূপী, শক্তিরূপী, স্নেহময়ী জননী। দেবী দুর্গা শরৎকালে পূজিত হলেও ভক্তের ডাকে দেবী মর্ত্যলোকে ভিন্নরূপে পূজিত হন। দেবীর অনেক রূপের মধ্যে নবদুর্গা রূপের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। মা দুর্গা এই নবদুর্গার রূপ সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টির রক্ষা তথা পালন এবং মঙ্গলের জন্য। শাস্ত্রে আছে যে, যারা এই নয়রূপের পূজা নয়দিন ধরে পালন করে তারা সবদিক দিয়ে জয়ী হয়। নবগ্রহকেও দেবীর এই নয়টি রূপই নিয়ন্ত্রণ করেন। বাঙালিরা যেমন শরৎকালে দুর্গাপূজা নিয়ে মেতে থাকে, সেই সময় অবাঙালিরা নবরাত্রি নিয়ে মেতে ওঠে। শুক্লপক্ষের প্রথমা থেকে নবমী পর্যন্ত ন'টি রাত্রি দুর্গার ন'টি শক্তির পূজা করা হয়ে থাকে।

মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীকবচে ব্রহ্মা দেবী দুর্গার এই ন'টি রূপের বর্ণনা করেছেন; অর্থাৎ, শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, এবং সিদ্ধিদাত্রী।

আরও পড়ুন: ৪০০ বছর ধরে বাংলায় হয় কালো দুর্গার পুজো! কোন ইতিহাস লুকিয়ে আড়ালে

শৈলপুত্রী
কূর্মপুরাণে শৈলপুত্রীর কাহিনি আছে। দক্ষের যজ্ঞে শিবের নিন্দা শুনে সতী দেহত্যাগ করলে মহাদেব দেবীকে নিয়ে তাণ্ডব করেন। অন্যদিকে দৈত্যরাজ তারকাসুরের অত্যাচারে দেবগণ অসহায় হয়ে দেবী ভগবতীর শরণাপন্ন হন। অন্যদিকে গিরিরাজ হিমালয়ও দেবীকে ধ্যানের দ্বারা তুষ্ট করছিলেন। তখন ভগবতী অভয় দিয়ে বলেন যে, তিনি পুনরায় গিরিরাজের ঘরে জন্ম নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে নিজের স্বামীরূপে বরণ করে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। হিমালয় অর্থাৎ শৈলশিখরে জন্মেছিলেন বলে তিনি শৈলপুত্রী নামে খ্যাত। এই রূপে দেবীর বাঁ-হাতে থাকে প্রস্ফুটিত পদ্ম আর ডানহাতে থাকে ত্রিশূল আর মাথায় থাকে অর্ধচন্দ্র। দেবীর বাহন বৃষ। নবরাত্রির প্রথম দিনে তাঁর পুজো করা হয়। ভোগ হিসেবে মাকে নানা ধরনের ফল, গরুর দুধের তৈরি ঘি দিয়ে প্রসাদ বানিয়ে দেওয়া হয়।

ব্রহ্মচারিণী
শিবের সঙ্গে বিয়ের আগে এই রূপে দেবী তপস্বিনী। দেবীর বাঁ-হাতে কমণ্ডলু এবং অঙ্গভূষণ রুদ্রাক্ষ। ডানহাতে পদ্মফুল। নারদের পরামর্শে শিবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি কঠিন তপস্যা করেন। তাই তাঁকে ব্রহ্মচারিণী বলা হয়। দেবী এই রূপে ভক্তদের অনন্ত ফল প্রদান করেন। তাঁর উপাসনায় মানুষের স্বভাবে ত্যাগ, বৈরাগ্য, সংযম বৃদ্ধি পায়। দুর্গাপুজোর দ্বিতীয়াতে মা ব্রহ্মচারিণীকে আচার মেনে ভোগ দেওয়া হয়। এই দিনে মিষ্টি ভোগ দেওয়া শুভ বলে ধরা হয়।

চন্দ্রঘণ্টা
চন্দ্রঘণ্টা অর্থাৎ দেবীর মুখ চাঁদের মতোই স্নিগ্ধ, সুন্দর এবং উজ্জ্বল। এই রূপে দেবীর যুদ্ধংদেহি অবতার। ভক্তদের রক্ষা করতে দশভুজা দেবী আট হাতে অস্ত্র নিয়েছেন আর বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা। তাঁর মাথায় বিরাজিত অর্ধচন্দ্র, হাতে কমণ্ডলু, তরোয়াল, গদা, ত্রিশূল, ধনুর্বাণ, পদ্ম, জপমালা এবং তাঁর শরীরের রং সোনার মতো উজ্জ্বল। দেবীর বাহন বাঘ। তৃতীয়াতে দেবীর এই রূপের পূজা হয়ে থাকে। এইদিন দেবীকে দুধের তৈরি ভোগ নিবেদন করা হয়।

কুষ্মাণ্ড
মহাপ্রলয়ের পর যখন সর্বত্র শুধু নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, সেই সময় দেবী নিজ হাসি এবং হাতের পাত্রের রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন ব্রহ্মাণ্ড। এই রূপে দেবীর গাত্রবর্ণ সূর্যকিরণের মতো উজ্জ্বল। দেবী আটটি হাতে কমণ্ডলু, ধনুক, বাণ, পদ্ম, অমৃতকলস, চক্র, গদা এবং জপমালা ধারণ করে আছেন। দেবী ত্রিনয়নী এবং তাঁর বাহন বাঘ। শাস্ত্রে কথিত আছে, বলিদানের মধ্যে কুমড়ো বলি দেবীর অত্যধিক প্রিয় ছিল। কুমড়োকে সংস্কৃতে ‘কুষ্মাণ্ড’ বলে। তাই দেবীর এরূপ নাম। নবরাত্রির চতুর্থীতে মায়ের এই রূপের পূজা হয়। এই দিনে মাকে মালপোয়ার ভোগ নিবেদন করা হয়।

স্কন্দমাতা
কার্তিকের আরেক নাম স্কন্দ। পশ্চিম ভারতে কার্তিকের মা হিসেবে এই ত্রিনয়নী, চার হাতবিশিষ্ট স্কন্দমাতা পূজিত হন। তাঁর ডানদিকে ওপরে রয়েছেন শিশু কার্তিক এবং নিচের হাতে রয়েছে প্রস্ফুটিত পদ্ম। দেবীর বাহন সিংহ। তিনি পদ্মের ওপরেও উপবিষ্ট হন। পদ্মের ওপরে উপবিষ্ট হওয়ায় তাঁকে পদ্মাসনাও বলা হয়। পঞ্চমী তিথিতে মায়ের এই রূপের পূজা হয়। এই দিন ভোগ হিসেবে মাকে কলা নৈবেদ্য দেওয়া হয়‌‌।

কাত্যায়নী
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বৈদিক যুগের ঋষি কাত্যায়নের পুত্রসন্তান থাকলেও এক কন্যাসন্তানের আশায় তিনি দেবীর তপস্যা করলে, দেবী তুষ্ট হয়ে কন্যারূপে জন্ম নিলে, তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী। আবার আরেকটি মতে, মহিষাসুরের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব ও অন্যান্য দেবতারা মিলে তাঁদের তেজ দিয়ে দেবীকে তৈরি করেন। দেবীর আটটি হাতে শত্রু নিধনের জন্য রয়েছে মারণাস্ত্র। তিনি ত্রিনয়নী এবং বাহন সিংহ। ষষ্ঠীর দিনে মায়ের এই রূপের পূজা হয় এবং ভোগ হিসেবে মধু দেওয়া হয়।

কালরাত্রি
কালরাত্রি অর্থাৎ যিনি কালের নাশ করেন। তিনি বিপদ আর প্রলয়কেও বিনাশ করেন। ভয়ংকর রূপের এই দেবীর গাত্রবর্ণ নিকষ কালো, মাথার চুল খোলা। আলুলায়িত কেশেই তিনি শত্রুর দিকে এগিয়ে যান। তাঁর গলায় বিদ্যুতের মালা। ত্রিনয়নী এই দেবীর শ্বাসপ্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা। দেবীর তিনহাতে অস্ত্র এবং একহাতে ভক্তদের প্রতি বরাভয় মুদ্রা। এই রূপেই তিনি কালী হিসেবে পূজিত হন। এই রূপেও তিনি ভক্তের শুভ করেন বলে তাঁর আরেক নাম শুভঙ্করী। দেবীর বাহন গর্দভ। সপ্তমী তিথিতে মায়ের পূজা করা হয়। এই কালরাত্রির পূজায় যে মূর্তি প্রচলিত, তা হলো শিবের তাণ্ডব মুদ্রা ধরে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। এই দিন ভোগ হিসেবে মাকে গুঁড়ের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়।

মহাগৌরী
শিবকে স্বামীরূপে কামনা করে কঠোর তপস্যা করেন দেবী পার্বতী, তাতে তাঁর গায়ের র‌ং কৃষ্ণবর্ণ হয়ে ওঠে। তখনই তাঁর নাম হয় মহাগৌরী। দেবীর হাতে থাকে ডমরু। তাঁর বাহন ষাঁড়। দেবী ত্রিনয়নী এবং চার হাতবিশিষ্ট। দেবীর একহাত বরাভয় মুদ্রায়, অন্যান্য হাতে পদ্ম, ত্রিশূল শোভা পাচ্ছে। অষ্টমী তিথিতে মায়ের এই রূপের পূজা হয়। এই দিন দেবীকে নারকেল ভোগ দেওয়া হয়।

সিদ্ধিদাত্রী
সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদি মুদ্রা। তিনি সিদ্ধি দান করেন। সবাইকে বরাভয় দেয় মায়ের এই মূর্তি। ভাগবতপুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবীকে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূজা করেছিলেন। সিদ্ধিলাভের পর দেবী মহামায়ার ইচ্ছায় শিবের দেহের অর্ধেক নারীত্ব লাভ করে, তাই শিব অর্ধনারীশ্বর বলেও পরিচিত। দেবীর মুখে সব সময় এক সন্তুষ্টির ছাপ লক্ষণীয়। নবরাত্রির নবম দিনে মায়ের এই রূপ পূজিত হয়। ভোগ হিসেবে ছোলা অর্পণ করা হয়।

More Articles