শতরঞ্জের খেল! আরও 'প্রজ্ঞা' তৈরি হচ্ছেন ভারতেই

Rameshbabu Praggnanandhaa: দাবার জগতে প্রজ্ঞানন্দের পথ চলাও খুব একটা সহজ ছিল না। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তারঁ খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ধার করতে হয়েছে বাবা-মাকে।

আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা, ১৯৮৮ সালে বিশ্বনাথন আনন্দ হয়েছিলেন বিশ্বের প্রথম ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহু তুখোড় দাবাড়ু এসেছেন ভারতে, জিতেছেন টুর্নামেন্ট, হয়েছেন গ্র্যান্ড মাস্টার। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় বিশ্বনাথন আনন্দের পর কোন ভারতীয় দাবাড়ু, বিশ্বের সবাইকে চমকে দিয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা অবশ্যই হবে রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। ২০০৫ সালের চেন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে জন্মানো এই ছেলে এখন সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। গ্র্যান্ডমাস্টার না হতে পারলেও মাত্র আঠারো বছর বয়সে ম্যাগনেস কার্লসেনের মতো খেলোয়াড়কে রীতিমতো নাকানিচোবানি খাইয়েছেন ভারতীয় এই দাবাড়ু।

আরও পড়ুন: হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও দাবা বিশ্বকাপে হার! তবু হৃদয় জিতলেন গ্র্যান্ডমাস্টার প্রজ্ঞানন্দ

না, ফাইনালে হাতের মুঠোয় আসেনি জয়। তবে আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে তরুণ প্রজ্ঞানন্দের ব্যতিক্রমী দক্ষতাকে কুর্নিশ জানিয়েছে গোটা দুনিয়া। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ প্রজ্ঞানন্দের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই কঠিন লড়াইয়ের জন্য তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন তিনি।

সহজ ছিল না এই পথটুকুও। ১৮ বছরের প্রজ্ঞানন্দকে টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠতে, ম্যাগনেস কার্লসেনের বিশ্বসেরা দাবাড়ুপ মুখোমুখি হতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ফাইনালে জায়গা করে নিতে ক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানের খেলোয়াড়দের পরাজিত করতে হয়েছে তাকে। ২০০২ সালে বিশ্বনাথে আনন্দের পর প্রজ্ঞানন্দই প্রথম ভারতীয়, যিনি জায়গা করে নিতে পেরেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে। শুধু তাই নয়, দাবা বিশ্বকাপের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে চূড়ান্ত পর্বে স্থান করে নিয়েছেন। প্রজ্ঞানন্দের এই কৃতিত্ব দাবার জগতে বিরল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করবে তাঁর এই সাফল্য। পাশাপাশি দাবার দুনিয়ায় একটি প্রজন্মগত পরিবর্তন আনতে পারে প্রজ্ঞানন্দের এই জয়, যা ভারতের জন্য হতে চলেছে বেশ ইতিবাচক।

বাবা রমেশবাবু ছিলেন ব্যাঙ্কার, দাবা নিয়ে তেমন কোন ধ্যানধারণা তাঁর কোনওদিনই ছিল না। মূলত মায়ের উৎসাহতেই দাবায় এসে পড়া প্রজ্ঞানন্দের। দিদি বৈশালীর সঙ্গে খেলতে খেলতেই দাবার প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। অচিরেই বোঝা গেল, খেলাটার ওপর প্রজ্ঞানন্দের দখল তার দিদির চেয়ে অনেক বেশি। এর প্রমাণও তিনি দিয়ে দেন খুব শীঘ্রই। মাত্র ৭ বছর বয়সে জেতেন ফিডে যুব বিশ্বকাপ। ওই একই বছর মুকুটে যোগ হয় ফিডে মাস্টার খেতাব। মাত্র ১০ বছর বয়সে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খেতাব পেয়েছিলেন তিনি। তখনই আলোচনা শুরু হয়ে যায়, দাবায় এক নতুন প্রডিজি পেয়ে গিয়েছে ভারত।

তবে শুধু প্রজ্ঞানন্দ একা নন, সদ্য অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে বিরাট আধিপত্য ছিল ভারতীয় দাবাড়ুদের। কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেওয়া আট দাবাড়ুর মধ্যে চারজন ছিলেন ভারতীয়। অর্থাৎ একক দেশ হিসেবে এই সংখ্যাটা ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি জুনিয়র দাবাড়ুদের বিশ্ব তালিকাতেও শীর্ষ ১০০ জনের মধ্যে ২১ জন ভারতীয়। সকলেরই বয়স এই মুহূর্তে ২০ বছরের নিচে। এদের মধ্যে আবার শীর্ষ দশে রয়েছেন ৪ জন আর শীর্ষ ২০-তে রয়েছেন ৭ ভারতীয়। অর্থাৎ বলাই যেতে পারে, দাবার বিশ্বে ভারত একটা অন্যতম দেশ হয়ে উঠতে চলেছে খুব শীঘ্রই।

তবে প্রজ্ঞানন্দ একা নন, তার মতোই আরও অনেক তরুণ তুর্কি আজকের দিনে হয়ে উঠেছেন ভারতের ভরসা। এই তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায় এদের কারোর বয়স ১৭, তো কারও ১৯। কিন্তু এই বয়সেই বিশ্বের বড় বড় তারকাদের মাত দিচ্ছেন তারা। এই তালিকায় সবার প্রথমে নাম নিতে হয় ডোম্মারাজু গুকেশের। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই এই বিস্ময় বালক হয়ে উঠেছেন ভারতের সেরা দাবাড়ু। গুরু বিশ্বনাথন আনন্দকে ছাপিয়ে তার ৩৬ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন এই খেলোয়াড়।

বিশ্বনাথন আনন্দ ভারতীয় দাবার মানচিত্রে এক অন্য পরিচিতি। কিন্তু তার শিষ্য যে এইভাবে তাঁর ৩৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেবেন সেটা হয়তো নিজেও বুঝতে পারেননি। বাকুতে অনুষ্ঠিত ফিড দাবা বিশ্বকাপের তৃতীয় রাউন্ডে যোগ্যতা অর্জন করার পরেই বিশ্বনাথের আনন্দের ৩৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন ১৭ বছরের গুকেশ। আজারবাইজানের মিসরাতদিন ইসকানদারোকে হারিয়ে ২৭৫৫.৯ লাইভ পয়েন্ট অর্জন করেন গুকেশ। বিশ্বনাথন আনন্দের লাইভ পয়েন্ট ২৭৫৪.০। এক কথায় বলতে গেলে এটা ছিল এক অনন্য নজির। ফলে ১৭ বছরের তরুণের এই রেকর্ড স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় দাবার একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছে বলা যায়।

২০২৩ সালে গুকেশ তার পারফরমেন্সে রীতিমতো আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। চলতি বছর দাবার ক্রমতালিকায় শীর্ষ ১০০-র মধ্যে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছেন তিনি। অন্যদিকে ফিডের মাসিক তালিকা অনুযায়ী এই মুহূর্তে তার স্থান একাদশ। লাইভ রেটিং থেকে আলাদা হলেও ম্যাচের শেষে নির্ধারণ করা এই ফলাফল অনুযায়ী বর্তমানে দেশের শীর্ষ দাবাড়ুদের মধ্যে একজন তিনি।

গুকেশের পাশাপাশি এই তালিকায় রয়েছেন নিহাল সারিন, অর্জুন ইরিগাইসির মতো কয়েকজন তারকা খেলোয়াড়। অর্জুন মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার শিরোপাটি জিতে নিয়েছিলেন। যার ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের ৩২তম সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার। অন্যদিকে, নিহাল ২০১৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জিতে নিয়েছিলেন গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব। ২৬০০ অ্যালো রেটিং অতিক্রম করে ভারতের সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

তালিকায় রয়েছেন রওনক সাধুয়ানী। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই গ্র্যান্ড মাস্টার হয়েছিলেন রওনক। ২০২১ সালের বুলেট চেস চ্যাম্পিয়নশিপে জয় এনে দেয় এই কৃতিত্ব। হিকারু নাকামুরা, আলীরেজা ফিরুজা, লেবন আরোনিনের মতো খেলোয়াড়দের পরাজিত করে রওনক জিতেছিলেন ওই শিরোপা। এছাড়াও, ২০২২ ফিরে অলিম্পিয়াডে তিনি একটি ব্রোঞ্জ পদকও জেতেন।

ফলে প্রজ্ঞানন্দ আজকে যেটা করে দেখাতে পেরেছেন, সেটা আর কয়েক বছরে ভারতের বহু দাবাড়ু করে দেখানোর ক্ষমতা রাখেন। প্রজ্ঞানন্দের এই সাফল্যে ভারতীয়দের দাবা খেলার প্রতি ঝোঁক আরও বাড়বে বলে এই বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন। গ্র্যান্ড মাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দও এই একই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন নিজে ক্ষুদে খেলোয়াড়দের নিয়ে। স্মার্টফোন ও সুলভ মূল্যে ইন্টারনেটের দৌলতে ভারতীয়রা খুব সহজেই নানা অ্যাপ্লিকেশনে দাবা খেলতে পারেন। ইন্টারনেটে চাইলেই দাবার বেসিক কিছু কোচিংও পাওয়া যায়।

আনন্দের বিশ্বকাপ জেতার ২ দশক পরেও যেভাবে ভারতীয়রা দাবার আসরে বাজিমাত করেছেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই গ্র্যান্ড মাস্টারের অধীনে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির কোনও সুযোগ ছিল না। তবুও ভারতীয়রা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বসেরা। আনন্দের বিশ্বকাপ জয় ভারতে দাবার জগতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। তবে শুধু পরিবর্তন এলেই তো হবে না, ভারতকেও এই মাইলফলক ছোঁয়ার জন্য আরও উদ্যোগী হতে হবে। ভারত সরকারকে দাবার প্রতি আরও মনোনিবেশ করতে হবে।

আরও পড়ুন: প্রজ্ঞায় মাত গোটা বিশ্ব, বিস্ময়কিশোর হারিয়েছিল বিশ্বসেরা দাবাড়ু কার্লসেনকেও!

বর্তমানে ভারতে পেশাদার দাবাড়ুদের সুযোগ-সুবিধায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। ক্ষুদে দাবাড়ুদের স্বপ্ন পূরণেও অভিভাবকদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তা সত্ত্বেও ভারতে এখনও একদল অদম্য অভিভাবক রয়েছেন যারা দাবার জগতে সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছেন। সন্তানদের স্কুলের থেকেও দাবাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা। নিজেদের বাড়ি বন্ধক রেখে ৮ থেকে ১৫ বছর বয়সী সন্তানদের সাথে টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, তাদের সন্তান একদিন দাবাতে বিশ্বজয় করবে।

দাবার জগতে প্রজ্ঞানন্দের পথ চলাও খুব একটা সহজ ছিল না। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তারঁ খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ধার করতে হয়েছে বাবা-মাকে। ২০১৬ সালে প্রজ্ঞানন্দ দাবায় বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি স্পন্সর আসতে শুরু করে। তরুণ বয়সে প্রজ্ঞানন্দের এই সাফল্য অবশ্যই ভারতীয়দের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। তার এই জয়ের পিছনে রয়েছে একটা কঠোর পরিশ্রম, দারুন প্রতিভা এবং অবশ্যই ভাগ্য। প্রজ্ঞানন্দ হয়তো ফাইনালে হেরেছেন। কিন্তু এর মধ্যে দিয়েও, তিনি ভারতীয়দের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, সব তো শুরু, এখনো ভারতের জয়যাত্রা অনেক বাকি।

More Articles