'ও তোতা পাখি রে...' বাঙালির হাসিকান্নাকে কণ্ঠে ধরে রেখেছিলেন নির্মলা মিশ্র

যে গানগুলি কোনও দিন বাংলা গানের শ্রোতাকে ভুলতে দেবে না নির্মলা মিশ্রকে, তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়- 'এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, 'সেই একজন দিও না তাকে মন’, `বলো তো আরশি'...

 


এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না...


বাঙালির শিরায়-ধমনিতে এখনও অনুরণিত হয় তাঁর সুরেলা সফর। 'এমন একটা মানুষ খুঁজে পেলাম না, যাঁর মন আছে’, এই অন্বেষণ করেছেন গানের অলিগলিতে। কিন্তু গানের সাধনাকে নির্মলা মিশ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া এই গানটিই যেন ছিল তাঁর জীবনমন্ত্র,

গানই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা
লাগে না ফুলচন্দন, মন্ত্রতন্ত্র লাগে না

৩০ জুলাই রাতে বিদায় নিলেন 'হাসিকান্নার চিরদিনের সাথী’। বাংলা গানের ভান্ডারকে অমৃতকুম্ভ করে চলে গেলেন সুরলোকে। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। জীবনমৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে বার বার লড়াই করেছেন। তাঁর চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী জানিয়েছেন, আগে অনেকবার লড়াই করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছেন। এবার আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হলেন না। চেতলার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

পরাধীন ভারতে ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মজিলপুরে জন্মগ্রহণ করেন নির্মলা। পরে বাবার চাকরির সূত্রে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। কাশী সংগীত সমাজ তাঁর বাবাকে পণ্ডিত, সংগীতরত্ন-সহ একাধিক উপাধিতে ভূষিত করে। জন্মের পর থেকেই সংগীতের প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল তাঁর। কৈশোর থেকেই দুর্দান্ত গান গাইতেন তিনি। তখনই জানান দিয়েছিলেন, তিনি আগামীর উজ্জ্বল মুক্ত। তাঁরা সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয় আপামর বাংলা। মণিমুক্তোর মতো তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য ছড়িয়ে পড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তাই তো তাঁর শিল্পী সত্তার মৃত্যু নেই।

আরও পড়ুন: বোল পাপিহে বোল রে থেকে গাঁটছড়া, লতাকে নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন সন্ধ্যার মা…

আধুনিক বাংলা এবং ফিল্মি গানের জন্য তাঁর সময়ে তো বটেই, সময় অতিক্রম করেও দর্শক মনে তাঁর জায়গা পাকাপাকি। দক্ষিণ কলকাতার চেতলার বাসিন্দা নির্মলা মিশ্রর ডাকনাম `ঝামেলা’। সংগীতজগতের অনেকেই তাঁকে 'ঝামেলাদি’ বলে ডাকতেন।

যে গানগুলি কোনও দিন বাংলা গানের শ্রোতাকে ভুলতে দেবে না নির্মলা মিশ্রকে, তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়- 'এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, 'সেই একজন দিও না তাকে মন’, `বলো তো আরশি' `আমি তো তোমার হাসিকান্নার চিরদিনের সাথী’, 'কাগজের ফুল বলে’, `ও তোতা পাখি রে’, `উন্মনা মন স্বপ্নে মগন’। এছাড়া তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় ছায়াছবির গানগুলি হচ্ছে, `আমি হারিয়ে ফেলেছি গানের সাথীরে’, `আবিরে রাঙাল কে আমায়’। তিনি অসংখ্য নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত, দেশাত্মবোধক গান এবং লোকসংগীত গেয়েছেন। তিনি মান্না দে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু এমন অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গলা মিলিয়েছেন।

গত চার-পাঁচ বছরে বহুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এবার আর হাসপাতালে যেতে চাননি। বাড়িতেই তাঁর চিকিৎসা করছিলেন ডাক্তার কৌশিক চক্রবর্তী। এর আগে বিভিন্ন সময় তাঁর স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। অনেকবার হাসপাতালে গেছেন। বাড়িও ফিরেছেন। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। অনেক আগেই টাইফয়েডে তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, চোখে উঠেছিল হাই পাওয়ারের চশমা। শরীর দুর্বল, তাই পড়াশোনার চাপ নিতে নাজেহাল হয়ে যান। এই অবস্থায় গানকে জীবনের কাণ্ডারি, আশ্রয় করে তুলেছিলেন নির্মলা মিশ্র।

বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া মুক্তোভরা ঝিনুক তিনি, যাঁর অপর নাম তোতাপাখি, তিনি বাংলা গানে বইয়ে দিয়েছেন নির্মল জলধারা, যা প্রবাহিত হবে অনন্তকাল। বাংলা পেরিয়ে উড়িষ্যাতে তিনি স্বনামে খ্যাত। নির্মলা মিশ্র নিজেই বলতেন, "বম্বের যদি লতা মঙ্গেশকর হন, বাংলায় যদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হন, তবে ওড়িশায় প্রধান গায়িকা নির্মলা মিশ্র।" প্রচুর ওড়িয়া ছবিতে তিনি ওড়িয়া ভাষায় প্লে-ব্যাক করেছেন। বাংলার মানুষেরও তিনি বড়ই আপন। ছোটবেলার নস্ট্যালজিয়া- `ও তোতা পাখি রে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, আমার মাকে যদি এনে দাও।‘ একটা প্রজন্মকে আন্দোলিত করেছে এই গান।

নির্মলা মিশ্রর মেজদা মুরারীমোহন মিশ্র ছিলেন খুব প্রতিভাধর শিল্পী। অল্প বয়সেই ধ্রুপদ সংগীতে তাঁর খ্যাতি ভারতব্যাপী ছাড়িয়ে পড়ে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে মুরারীমোহন মারা যান। সেই সময় মুরারীমোহনের বড়দা মনোজমোহন মিশ্র মেজ ভাইয়ের নামে `মুরারী স্মৃতি সংগীত সম্মেলন’ শুরু করেন। যাঁদের সাহচর্যে এই সম্মেলন শুরু হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন নাটোরের মহারাজ, বর্ধমানের মহারাজা, পাথুরিয়াঘাটার মন্মথ ঘোষ ও কলকাতার প্রথম মেয়র চেতলার বাসিন্দা ফণী ব্রহ্ম। শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় বড় শিল্পীরা কে না এসেছেন এই সম্মেলনে। প্রতিযোগিতাও ছিল বড় মাপের। সেই প্রতিযোগিতা থেকেই উঠে এসেছেন নির্মলা নিজেও। খুব ছোট বয়সে সাফল্য পান তিনি। আরতী মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লারাও এই সম্মেলন থেকে উত্তীর্ণ। নির্মলা মিশ্র ১৯৬০ সালে সংগীতজগতে পদার্পণ করেন, যখন সংগীত পরিচালক বালকৃষ্ণ দাস তাঁকে `শ্রীলোকনাথ’ ছায়াছবির গানে কণ্ঠ দেওয়ার সুযোগ করে দেন। এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 'স্ত্রী', 'অভিনেত্রী', 'অনুতাপ'- বিভিন্ন ছবিতে তাঁর কণ্ঠের রিমিঝিমি আলোড়ন ফেলেছে।

এই বছরেই মৃত্যু হয়েছে আরও তিন প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পীর। ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ মুম্বইয়ের ব্রিচ ক‍্যান্ডি হাসপাতালে প্রয়াত হন সুরসাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। এর কয়েকদিন পরেই ১৫ ফেব্রুয়ারি মুম্বইয়ের হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল সুরকার ও সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ীর। প্রয়াত হন স‌ংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও। এত নক্ষত্রের পতন যেন সংগীতের আকাশকে ঢেকে দিয়েছিল অন্ধকারে। নির্মলা মিশ্রর মৃত্যুতে সেই অন্ধকার আরও ঘনীভূত হলো‌।

সংগীতজগৎ তাঁকে বালকৃষ্ণ দাস পদকে সম্মানিত করেছে। স্বর্ণযুগের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী নির্মলা। তিনি তাঁর ৮১ বছরের জীবনে গানে যে মণি-মুক্তো ছড়িয়েছেন, তাকে আশ্রয় করে বাংলা গানের শ্রোতারা আরও বহুকাল তৃপ্ত থাকবেন। ফলে তাঁর মৃত্যু নেই, মৃত্যু হয় না শিল্পের। বাঙালি গানে গানে খুঁজে যাবে এমন একটা মানুষ, যার মন আছে।

More Articles