পোলিওতে কাবু, দুই পা অসমান, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়েই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা

World Cup Football 1958: সেবারই প্রথম টিভিতে খেলা দেখানো হল। অবিশ্যি সুইডিশরাই কেবল সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পেয়েছিল, অবশিষ্ট দুনিয়া পরে রেকর্ডিং দেখেছিল।

দি স্তেফানোর গোল

১৯৫৭-র কথা বলছি, হিস্পানিরা খেলছিল বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে।

বেলজিয়ামের রক্ষণভাগের কাছে এসে মিগেল [ম্যুনিঅস] দেখল বেচারারা একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সে ডানদিক দিয়ে ওদের রক্ষণকে ছিঁড়ে ভেতরে ঢুকে এল, তারপর একটা নিখুঁত ক্রসে বলটা গোলের সামনে রাখল। এমন সময় দি স্তেফানো সেখানে চলে এল। সে সামনের দিকে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে শেষমেশ শূন্যে ভেসে থেকেই ব্যাকহিলে গোল করে দিল।

আলফ্রেদো দি স্তেফানো, সেই আরহেন্তিনীয় তারকা ফুটবলার যে স্বেচ্ছায় নিজের নাগরিকত্ব বদলে হিস্পানি দেশেই পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছিল আর সারাজীবনে বহুবার এমন আশ্চর্য সব গোল করেছে। ফাঁকা গোল দেখলেই তার মাথায় কিলবিলিয়ে উঠত শাস্তি দেবার ভূত। কারণ গোল ফাঁকা রাখা তার কাছে ক্ষমার অযোগ্য ভুল ছিল এবং যত দ্রুত সম্ভব সেই ভুলের মীমাংসা তাকেই করতে হত। পেছন থেকে ছোরা মারার মতো এই কাজে সে দুষ্টু বামনভূতের মতো দক্ষ ছিল।

দি স্তেফানো

দি স্তেফানোর পা এতটাই বড়সড় ছিল যে তার জুতোর মধ্যে অনায়াসে গোটা মাঠটা এঁটে যেতে পারত। তার পা থেকেই তো ফুটবল মাঠের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ! আলফ্রেদো দি স্তেফানো খুব দৌড়ত, দৌড়েই যেত মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, এদিকের বারপোস্ট থেকে ওই দিকের বারপোস্ট পর্যন্ত। যখন তখন দিক পালটে ফেলত, খেলার চাল পালটে দিত। কখনও মৃদু দুলকি চাল, তো কখনও অপ্রতিরোধ্য ঘূর্ণিঝড়ের দাপট। মাঝে মাঝে জায়গা তৈরি করতে কিংবা খেলা যখন গতি হারিয়ে নিরানন্দ হয়ে পড়ত, সে বল ছাড়াই মার্কারকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করত।

এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার ধাতে ছিল না। মাথাটা একটু উঁচু করেই সে বুঝি গোটা মাঠটাকে দেখে নিতে পারত, তারপর এক নিঃশ্বাসে মাঠের ওই পারে পৌঁছে গিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণের ঢাকনা খুলে জালে বল জড়িয়ে দিয়ে আসত। খেলায় সে ছিল সর্বত্রগামী। আক্রমণের শুরুতে সে, আক্রমণ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সে, আবার গোল করার সময়েও সে! আর সেসব গোল তো কুতিয়ে-কুতিয়ে করা নয়, রীতিমতো রঙিন সব গোল। লোকে তার খেলা দেখত আর প্রাণ খুলে গাইত :

দেখো রে,
ছুটল তির হাওয়ার বেগে
রুখবে কে? ঝোড়ো হাওয়াকে
বিষাক্ত তীর
দেখো রে!

প্রতিদিন খেলার শেষে দর্শকরা তাকে কাঁধে নিয়ে মাঠ ছাড়ত।

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ফুটবল দুনিয়ায় তাক লাগিয়ে দেওয়া দলগুলোর মধ্যে অন্তত তিনটে দলের ইঞ্জিন ছিল দি স্তেফানো। রিভার প্লেট, যেখানে সে পেদেরনেরার জায়গা নিয়েছিল; বোগোতার মিলোনারিওস, যেখানে সে একই দলে পেদেরনেরার পাশে ঝলসে উঠেছিল এবং রিয়াল মাদ্রিদ, যেখানে খেলে ওদেশের ঘরোয়া লিগে সে পরপর পাঁচবার সবচেয়ে বেশি গোল করে। অবসর নেওয়ার বহুকাল পরে, ১৯৯১ সালে, ফ্রান্স ফুটবল পত্রিকা বুয়েনস আইরেসের মাঠে খেলে বড় হওয়া এই ছেলেটিকে ‘সর্বকালের সেরা ইওরোপিয় ফুটবলার’-এর স্বীকৃতি দেয়।

আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

গ্যারিঞ্চার গোল

ব্রাজ়িলের জাতীয় ফুটবল দল ১৯৫৮-য় যাচ্ছিল সুইডেনে, বিশ্বকাপ খেলতে। পথে ইতালিতে তারা ফিয়োরেন্তিনা ক্লাবের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলে।

সেদিন গ্যারিঞ্চা ফিয়োরেন্তিনার পেনাল্টি এলাকায় তীব্র হানাদারি চালায়। ওদের রক্ষণের একজন থেবড়ে মাটিতে বসে পড়ে, আরেকজনকে সে আমূল কাঁপিয়ে দেয়, তারপর আরও একজনকে। শেষে গোলকিপারকেও ধোঁকা দিয়ে দেখে আর এক মক্কেল দাঁড়িয়ে আছে গোললাইনের উপর। গ্যারিঞ্চা তখন এমন ভাব করে যে মনে হয়, সে গোলে শট নিতে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে ভঙ্গি পালটে নিয়ে এমনভাবে তাকায় যেন আদৌ শট নেওয়ার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। ফের কাছের পোস্ট ঘেঁষে গোলে মারার অভিনয় করে। এবার গোললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই খেলোয়াড় আর টাল সামলাতে না পেরে পোস্টের উপর নাক ঠুকে পড়ে। ততক্ষণে গোলকিপার উঠে এসে জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। গ্যারিঞ্চা শেষপর্যন্ত গোলির দু'পায়ের ফাঁক দিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দেয়।

সব কাজ সমাধার পরে বলটাকে বগলদাবা করে ধীরে ধীরে মাঠের মাঝখানে ফেরে। সে এমনভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে এল, মনে হচ্ছিল স্লো মোশনে চার্লি চ্যাপলিনকে দেখছি। যে গোলটা দেখার জন্য গোটা ফ্লোরেন্স বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সে যেন সেই কৃতকর্মের জন্য করুণাময়ের কাছে মার্জনা চাইছিল।

১৯৫৮-র বিশ্বকাপ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাশূন্যে একটা উপগ্রহ পাঠাল। পুঁচকে একখানা চাঁদ, রাস্তায় সোভিয়েতের স্পুটনিকের সঙ্গে দেখা হলেও সে অবিশ্যি ‘কেমন আছো হে?’ বলেও সৌজন্য দেখায়নি। আর তা বলবেই বা কেমন করে, ততদিনে যে ঐহিক এবং পারত্রিক, দুই প্রান্তেই লড়াই চলছে দেড়েকষে। পরলোকের কথা ছাড়ুন, আমাদের এই ইহলোকে তখন লেবাননে গৃহযুদ্ধ লাগবে-লাগবে করছে। আলজিরিয়া জ্বলছে। ফ্রান্সও পুড়ছে এবং ছ'ফুট উচ্চতার জেনারেল দু গল আগুনের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে পরিত্রাণের রাস্তা দেখাচ্ছেন। কুবাতে স্বৈরাচারী শাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে ফিদেল কাস্ত্রোর ডাকা সাধারণ ধর্মঘট মুখ থুবড়ে পড়েছে বটে, কিন্তু ভেনেজ়ুয়েলাতে যে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল তাতে সেদেশের স্বৈরশাসক পেরেস হিমেনেস গদি ছাড়তে বাধ্য হলো। কলম্বিয়ায় এক দশকের রক্তপাতের পর দুই মেরুর বাসিন্দা কনজ়ারভেটিভ আর লিবারেলরা নিজেদের মধ্যে তাণ্ডব থামিয়ে ভাগভাগি করে দেশ চালাবার দৈবী মীমাংসায় উপনীত হয়েছে। ওদিকে লাতিন আমেরিকা সফরে রিচার্ড নিক্সনকে রাস্তার পাথর ছুঁড়ে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে। পেরুর ঔপন্যাসিক হোসে মারিয়া আর্গেদাসের নদীর অতলে প্রকাশিত হচ্ছে, একই সঙ্গে ছাপা হচ্ছে কার্লোস ফুয়েন্তেসের বাতাস যেখানে স্বচ্ছ এবং ইদেয়া ভেলারিনিয়োর প্রেমের কবিতা।

হাঙ্গেরিতে আমলাতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করায় ইমরে নাগিকে ১৯৫৬-র আন্দোলনের আরও একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে গুলি করে মারা হলো। হাইতিতেও খুনোখুনি অব্যাহত রইল। সেখানে কালাজাদুর তান্ত্রিক আর কোতোয়ালদের দু'পাশে বসিয়ে দেশ চালাচ্ছিল পাপা ডক দ্যুভালিয়ে। সেদেশের বিদ্রোহীরা পাপা ডকের প্রাসাদ আক্রমণ করলে তাদের অবলীলায় নিকেশ করে দেওয়া হয়। ত্রয়োবিংশ জন, মানে ভগবান জন আর কী, রোমে পোপের সিংহাসনে আসীন হল! যুবরাজ চার্লস ইংল্যান্ডে ভবিষ্যতের রাজা বলে স্বীকৃতি পেল। বার্বি ডল পুতুলের দুনিয়ায় নতুন পাটরানি হয়ে বসল। ব্রাজ়িলে জোয়াও আভেলাঞ্জি [জোয়াও হাভেলাঞ্জ] ফুটবল বাণিজ্যের সর্বোচ্চ আসনটি দখল করে ফেলল। ওদিকে ফুটবলের নন্দনতত্ত্বে নতুন কিছু পৃষ্ঠা জুড়ে দিতে আসরে নামল সতেরো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। বাচ্চাটিকে সবাই পেলে নামেই চেনে। শুধু চেনে না, ফুটবলের রাজা বলে ওর নামে জয়ধ্বনি দেয়।

পেলের অভিষেক হলো সুইডেনে ষষ্ঠ বিশ্বকাপের সময়। সেবার ইওরোপের বারোটা এবং লাতিন আমেরিকার চারটে দল খেলেছিল, পৃথিবীর অন্য অক্ষাংশ থেকে আর কোনও দল আসেনি। সুইডিশরা মাঠে বসে খেলা তো দেখছিলই, তার সঙ্গে ঘরে বসে খেলা দেখারও সুযোগ পেল। কেননা সেবারই প্রথম টিভিতে খেলা দেখানো হল। অবিশ্যি সুইডিশরাই কেবল সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পেয়েছিল, অবশিষ্ট দুনিয়া পরে রেকর্ডিং দেখেছিল।

সেবারই প্রথম নিজেদের মহাদেশের বাইরে গিয়ে কোনও দল বিশ্বকাপ জিতল। ’৫৮-র বিশ্বকাপের শুরুর দিকে কিন্তু ব্রাজ়িলের খেলায় তেমন কোনও ঝাঁঝ ছিল না। কিছুদিন পরে খেলোয়াড়রা কোচের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে এবং নিজেদের পছন্দসই দল নিয়ে মাঠে নেমে ছন্দ খুঁজে পায়। তারপর থেকে তাদের আর থামানো যায়নি। তখন থেকেই অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের দলে থাকা পাঁচজন ফুটবলার ব্রাজ়িল দলে নিয়মিত হয়ে যায়। পেলে তাদের মধ্যেই ছিল। গ্যারিঞ্চাও। যদিও ব্রাজ়িলে সে ততদিনে ভীষণ জনপ্রিয়, এমনকী আগের টুর্নামেন্টেও তার খেলায় আগুনের ফুলকি ছুটতে দেখা গিয়েছিল। গ্যারিঞ্চাকে কোচ বসিয়ে রেখেছিল কারণ মনোবিদের বিচারে গ্যারিঞ্চার নাকি মানসিক দৌর্বল্য ছিল! ব্রাজ়িলের নতুন দলে এত দিন প্রথম একাদশের বাইরে থাকা এই সব কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা সাদাদের পিছনে ফেলে ভোরের আলো ছড়িয়ে দিল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হল আরেক অত্যাশ্চর্য কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় ডিডি, সে নীচ থেকে ব্রাজ়িলের ইন্দ্রজালের সুতোটা নিয়ন্ত্রণ করত।

এখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে না কি মাঠে আগুন ছুটছে : লন্ডনের ওয়ার্ল্ড স্পোর্ট কাগজে লিখল চোখ কচলে বুঝতে হচ্ছে আদৌ মর্ত্যলোকের খেলা চলছে তো! কোপা আর ফঁতেন ছিল ফরাসি দলের দুই স্তম্ভ, সেমিফাইনালে ব্রাজ়িল তাদের ৫-২ হারাল। ফাইনালে হোম টিম সুইডেনকেও একই ব্যবধানে হারিয়ে দিল। সুইডেনের অধিনায়ক লিয়েড্‌হল্‌ম্‌কে ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শিল্পী বলা হয়, ফাইনালে সে প্রথমে গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু তারপর গোটা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় ভাভা, পেলে, জ়াগালোরা। এই ত্র্যহস্পর্শে সুইডেন অচিরেই নিজেদের জায়গা বুঝে নিল। বেচারা ষোড়শ শতাব্দীর সুইডিশ রাজা গুস্তাভাস অ্যাডোলফাস, স্ট্যাচু হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকানো ছাড়া তার অন্য কোনও উপায় ছিল না। ব্রাজ়িল সেবার একটা ম্যাচও হারেনি। ফাইনাল জেতার পর ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়রা ম্যাচ-বলটা তাদের আদরের অঙ্গসংবাহক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক আমেরিকোকে উপহার দেয়।

ফ্রান্স তৃতীয় স্থান পায়, পশ্চিম জার্মানি চতুর্থ। তেরোটা গোলের ঝরনা ছুটিয়ে ফ্রান্সের ফঁতেন সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়। আটটা ডান পায়ে, চারটে বাঁ-পায়ে আর একটা হেডে। তার পরেই ছিল পেলে আর জার্মানির হেলমুট রান, দু'জনেই ছ'টা করে গোল করেছিল।

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

নিউতো-র গোল

১৯৫৮-র বিশ্বকাপেই ব্রাজ়িল খেলছিল অস্ট্রিয়ার সঙ্গে। ব্রাজ়িল তখন ১-০ গোলে এগিয়েছিল।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে, ব্রাজ়িলের রক্ষণভাগের প্রধান খেলোয়াড় নিউতো স্যান্তোস, ফুটবলের ইতিহাস-ভূগোলের যাবতীয় অধ্যায়ে তার বিপুল জ্ঞান দেখে বন্ধুরা যাকে ‘বিশ্বকোষ’ বলে ডাকত, সে রক্ষণের পিছন দিক ছেড়ে সেন্টার লাইনের দিকে বলটা বাড়িয়ে অস্ট্রিয়ার দু'জন খেলোয়াড়কে ধোঁকা দিয়ে সামনের দিকে দৌড়তে লাগল। উত্তেজনায় ব্রাজ়িলের কোচ ভিসেন্তে ফেওলা নিজেও সাইডলাইন ধরে দৌড়চ্ছিল। কোচ বেচারা ঘেমে-নেয়ে একশা হয়ে শুধু চেঁচিয়ে গেল, ‘নীচে নাম নিউতো… নেমে যা বাপ আমার। গোল খেয়ে যাবি, শালা’।

কিন্তু নিউতোর মতো খেলোয়াড়কে কি আর ভাঁজ করে থাকে থাকে রাখা যায়! ও চোঁ-চাঁ দৌড় লাগাল অস্ট্রিয়ার গোলের দিকে। থপথপে চেহারার কোচ ফেওলা নিজের মাথাটাকে চেপে ধরে দু'হাতে চুল ছিঁড়তে লাগল, যদিও নিউতো তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। নিজের দলের কোনও ফরোয়ার্ডকে বল পাস না-করে গোঁয়ারের মতো এগিয়ে চলল। গোটা খেলাটা নিজেই তৈরি করে শেষ পর্যন্ত অসামান্য একখানা গোল করল।

গোলের পরে কোচ ফেওলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাশের জনকে বলল, "দেখলে, দেখলে! আমি বলিনি? ছোকরা খেলাটা জানে।"

গ্যারিঞ্চা

গ্যারিঞ্চারা অনেকগুলো ভাই ছিল, ওর দাদাদের মধ্যেই কেউ হয়তো ওকে ব্যাপটাইজ় করার সময় গ্যারিঞ্চা নামটা দেয়। ওই নামে একটা হতকুচ্ছিত-নিষ্কর্মা পাখি আছে। সে যখন ফুটবল খেলা শুরু করল তখন ডাক্তাররা প্রথমেই তার নামের পাশে একটা বড়ো ঢ্যারা এঁকে দিল। ক্ষুধা আর পোলিওর যৌথ আক্রমণের শিকার গ্যারিঞ্চার ছেলেবেলায় মুখে ভালো করে কথা সরত না, দুটো পা সমান ছিল না, মস্তিষ্কের গড়নে সে ছিল শিশুসুলভ, তার কশেরুকা ইংরেজি ‘এস’ বর্ণের মতো বাঁকা, পা দুটো একই দিকে পড়ত। সব মিলিয়ে লোকে ধরেই নিয়েছিল ওর পক্ষে খেলোয়াড় হওয়া অসম্ভব।

কিন্তু এ পৃথিবীতে তার মতো রাইট উইঙ্গার বারবার আসে না। ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে সে ছিল নিজের ক্ষমতার শিখরে, ১৯৬২-র বিশ্বকাপে তো সে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়। কিন্তু এগুলো তার পরিচয়ের ভগ্নাংশ মাত্র, খেলোয়াড় হিসেবে সে যা করেছে তা অল্প কথায় বলা যায় না। এযাবৎ ফুটবলের ইতিহাসে তার মতো কেউ আসেনি যে দর্শকের এত বাহবা কুড়িয়েছে।

সে যখন খেলত, মাঠটাকে মনে হত বুঝি সার্কাসের রিং, আর খেলা যেন এক উৎসব। ছোটো বাচ্চা যেভাবে নিজের পোষ্যটিকে চোখে হারায়, গ্যারিঞ্চাও বলকে এক মুহূর্ত একা ছেড়ে রাখত না। পায়ে বল নিয়ে সে এমন সব শয়তানি কসরৎ দেখাত যে লোকে হেসেই খুন হতো। সে বলের উপর লাফাত, বল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। বল তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলত, সে বলকে তাড়া করত, বলও কখনও তাড়া করত তাকে। বিপক্ষের খেলোয়াড় এইসব কাণ্ড দেখে মাথা ঘুরে একে অপরের গায়ে টলে পড়ে যেত, তাদের পা এমন মুচড়ে যেত যে সমুদ্রপীড়ায় কাহিল যাত্রীর মতো ভূমিশয্যা নিতে হত। গ্যারিঞ্চা তার ওইসব শয়তানি কসরৎ দেখাত মাঠের একধারে, সেন্টার থেকে অনেক দূরে ডানদিকের টাচলাইন ধরে। সে যে জন্মেছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরে শহরতলির ঝোপড়পট্টিতে, ওখানকার মাঠেঘাটে খেলেই সে বড় হয়েছে। তার ক্লাব ছিল বোতাফোগো, সেদেশের ভাষায় যার মানে ‘অগ্নিসংযোগ’। সে বোতোফোগোর দলে সত্যিকারের আগুন ছিল, দর্শকদের বুকে আগুনের বৃষ্টি ছেটাত, আগ্নেয়সম্ভব আরও যা যা করা যায় সবই করে দেখাত। মাঝে মাঝেই দলের অনুশীলন কেন্দ্রের জানলা বেয়ে সে বাইরে পালাত, কেননা দূর দূরান্তের অলি-গলি থেকে ফুটবল তাকে ‘খেলবি আয়’ বলে ডাকত। ঠিক যেমন সূরের মূর্ছনায় মানুষের পা নিজে থেকেই নেচে ওঠে, কোনও প্রোষিতভর্তৃকা একটি চুম্বনের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।

তাকে কী বলবেন, জয়ী? আমি বলি ভাগ্যবান পরাজিত। এটুকু তো বোঝেন যে ভাগ্যদেবী চিরকাল কারও উপর প্রসন্ন থাকেন না। ব্রাজ়িলে যেমন বলে, মলের যদি মূল্য থাকত, গরিবের পাছা হত না।

গ্যারিঞ্চা অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত অনুমেয় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, ততদিনে সে হতদরিদ্র, পাঁড় মাতাল, নিঃসঙ্গ।

আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

ডিডি

১৯৫৮-র বিশ্বকাপে সাংবাদিকেরা তাকেই বিশ্বসেরা ঘোষণা করেছিল।

ওর পায়েই ছিল ব্রাজ়িলের প্রাণভোমরা। ছিপছিপে চেহারা, রাজহাঁসের মতো লম্বা গলা, দাঁড়াত যেন নিজেই নিজের স্ট্যাচু। ডিডি মাঠে দাঁড়ালে মনে হতো আফ্রিকার কোনও বিগ্রহ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে সেই ঈশ্বর, সেই প্রভু। যেকোনও মুহূর্তে ফলায় বিষ মাখানো তির ছুঁড়তে পারে।

লম্বা বলের খেলায় সে ছিল রাজা। গোলের কাছে বল গেলে ঝলসে উঠত পেলে, গ্যারিঞ্চা কিংবা ভাভা। কিন্তু ডিডির খেলা অন্যরকম। সে দূর থেকে শট নিয়ে গোল করত। গোলকিপারকে এমন বোকা বানাত যে তার হাতে ‘শুকনো পাতা’ ছাড়া আর কিছু পৌঁছত না। বলটাও যেন তার পায়ের মাপসই হয়ে যেত, তার পায়ের টোকা খেয়ে সুন্দরীতমা কেবলই পাক খেত, পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে যেত, নাচতে নাচতে শুকনো ঝরা পাতার মতো হাওয়ায় এদিকে-সেদিকে উড়ে বেড়াত। তারপর গোলের সেই কোণ দিয়ে ঢুকত, যেদিকে গোলকিপার কখনই বলটাকে প্রত্যাশা করত না।

ডিডি খেলত খুব শান্ত ভঙ্গিতে। বলের দিকে দেখিয়ে বলত : ‘ওই মেয়েটাই তো দৌড়য়, আমি আর কী করব!’

ও জানত, বলের প্রাণ আছে।

বঁধুয়া

তার ভ্রূপল্লবের ডাক আমি উপেক্ষা করতে পারিনি কখনও। তাকে এড়িয়ে গেলে সে নিশ্চিত বিশ্বাসঘাতিনী হত। যখন সে কাছে আসে তাকে সোহাগ করে পাশে বসাতে হয়, তবেই না দুটো মনের কথা বলা যাবে! কখনও আনপথেও যাবে, আমি তাকে ডেকে বলব : ‘কাছে এসো, লক্ষ্মীটি!’ তারপর বাধ্য মেয়ের মতো আমার হাত মুঠোয় নিয়ে চলবে। আমি তার পায়ের ফোস্কার জ্বালায় ফুঁ দিয়ে দিই, আনমনে তার গালের আঁচিলে হাত বুলোই। ও বাচ্চা মেয়ের মতো এসে বসে। আামি তাকে ততটাই ভালোবাসি যতটা আমার স্ত্রীকে। সে বহ্নিশিখার মতো আমাকে টানে। যদি অবহেলা কিংবা উপেক্ষা করো তাকে, অকারণ রুক্ষ হও, পা ভেঙে দেওয়ার মতো কঠোর হতেও জানে। সেজন্যই তো বলি : ‘বাছারা, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। মেয়েটিকে আদরে রেখো’। তুমি তার শরীরের কোন জায়গা স্পর্শ করছ, তার ওপর নির্ভর করছে তোমার ভাগ্য।

(ডিডি-র চিরকুটটি জোগাড় করে দিয়েছেন রোবের্তো মৌরা)

More Articles