১৯৭১-এ সংসার ছেড়েছিলেন মোদি! প্রধানমন্ত্রীর বাকি পরিবারের কথা কেন জানেই না দেশ
PM Modi Family: মোদি কান্নাস্নাত গলায় বলেছিলেন, "আমি উচ্চ পদে বসার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি। আমার যা কিছু ছিল, আমার পরিবার, আমার বাড়ি... আমি তা দেশের জন্য ছেড়ে এসেছি..."।
“ঝোলা উঠাকে" বেরিয়ে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বলেছিলেন, দেশ সবার আগে, পরিবার, সম্পত্তি, বন্ধনের যাবতীয় গ্রন্থি ছিঁড়ে তাই রাষ্ট্রের সেবক হয়েছিলেন। ভারত যে প্রধানমন্ত্রীদের পেয়েছে, সকলেই যাকে বলে 'ট্রাডিশনাল ফ্যামিলি পার্সন'। রাজনীতির মধ্যে থেকেও পরিবারের সঙ্গে থেকেছেন বা কিছুক্ষেত্রে পরিবারই হয়ে উঠেছে রাজনীতির আধার। তাকে কটাক্ষ করে রাজনৈতিক নেপোটিজম বলাও হয়েছে। মোদ্দা কথা, রাজনীতির মধ্যে থেকেও থেকেছেন পরিবারের সঙ্গে। নেহরু ইন্দিরার সঙ্গে থাকতেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সন্তান ও নাতি নাতনিদের নিয়েই কাটিয়েছেন বাকি জীবন। ইন্দিরা গান্ধীও সন্তান সঞ্জয় ও রাজীব এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গেই থেকে যান। এমনকী বিয়ে থা না করেও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ছিল এক সুন্দর পরিবার। ১৯৯৮ সালে যখন তিনি ৭ রেসকোর্স রোডে চলে আসেন, তখন তাঁর দত্তক নেওয়া পরিবার, নমিতা ভট্টাচার্য এবং তাঁর স্বামী রঞ্জন থাকতেন অটলের সঙ্গেই।
তবে নরেন্দ্র মোদি পরিবার থেকে দূরে থাকতে শুরু করেছেন সেই ১৯৭১ সাল থেকে। আরএসএস মানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মতাদর্শ অনুযায়ী একজন 'প্রচারক'কে পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই হয়। অর্থাৎ সবার আগে কাজ, গার্হস্থ্য এবং পারিবারিক ঝুট ঝামেলা, মায়া থেকে মুক্ত হয়ে তবেই সবটুকু দেওয়া যাবে সংঘের মত প্রচারের জন্য। আরএসএসের বিশ্বস্ত নরেন্দ্র মোদি ১৯৭১ সাল থেকেই তাই সংসারের বাঁধন ছিন্ন করতে শুরু করেন এবং সংঘের কাজের আরও বেশি মনোযোগ দেন। তখন থেকেই নরেন্দ্র মোদি 'ব্রহ্মচারী' জীবনযাপন শুরু করেন। তাঁর রাজনৈতিক সিঁড়িভাঙা যত বেড়েছে ততই ক্ষীণ হয়েছে পারিবারিক যোগাযোগ। তবুও, যতই হোক, রক্তের আত্মীয় তো! তার উপর প্রধানমন্ত্রী, আত্মীয়রা তাঁকে বেশ গর্বের সঙ্গেই দেখেন। মোদিও একবার বলেছিলেন, "এটা সত্যিই আমার ভাই এবং আত্মীয়দের কৃতিত্ব যে তাঁরা সাধারণ জীবনযাপনই চালিয়ে গেছেন এবং আমাকে কখনই কোনও কিছুর জন্য বিরক্ত করেননি। আজকের বিশ্বে, এটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়।"
আরও পড়ুন- স্কুলে যাননি কোনওদিন, তবু চিকিৎসা করতেন! মোদির প্রয়াত মা হীরাবেনের যে জীবন অজানাই
প্রধানমন্ত্রী মোদি, দামোদরদাস এবং হিরাবেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। বাবা দামোদরদাস মুলচাঁদ মোদি সামান্য চায়ের দোকান চালাতেন এবং মা সামান্য কাজকর্ম করে সংসার চালিয়ে নিতেন। মোদির এই 'সাধারণ' ইমেজকে বরাবর দল হাতিয়ার করেছে। তাঁর 'নিঃস্বার্থ' ইমেজ ভারতের জনগণের মন জেতার জরুরি টোটকা। নোটবন্দি করার পর পর, যখন এমন 'স্বৈরাচারী' পদক্ষেপ নিয়ে দেশ বিক্ষোভ-হতাশা-আশঙ্কায় উত্তাল, একটি জনসভাতে মোদি কান্নাস্নাত গলায় বলেছিলেন, "আমি উচ্চ পদে বসার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি। আমার যা কিছু ছিল, আমার পরিবার, আমার বাড়ি... আমি তা দেশের জন্য ছেড়ে এসেছি..."।
নরেন্দ্র মোদির পরিবারের বাকিদের কথা তাই খুব একটা প্রকাশ্যে আসেওনি কোনওদিন। নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বড় দাদা হলেন সোমভাই মোদি। ভাদনগরের একটি বৃদ্ধাশ্রম চালান তিনি। নরেন্দ্র মোদির দাদা বলেছিলেন, তাঁর এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে একটা পর্দা রয়েছে। সেই পর্দাটি তিনি দেখতে পান ঠিকই কিন্তু বাকিদের কাছে অদৃশ্য। "আমি নরেন্দ্র মোদির ভাই, প্রধানমন্ত্রীর ভাই নই। প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য, আমি ভারতের ১৩৯ কোটি মানুষেরই একজন," বলেছিলেন সোমভাই।
মোদির সমস্ত পরিবারই এখনও অদ্ভুতভাবে মধ্যবিত্ত জীবনই অতিবাহিত করেন। ২০০১ সালে তাঁদের পরিবারের সদস্য প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারপর থেকে এতকাল কেটে গেলেও অবস্থা পালটায়নি। নরেন্দ্র মোদির মেজোভাই, অম্রুতভাই মোদি ২০০৫ সালেও মাস মাইনে পেতেন ১০,০০০ টাকারও কম। চাকরি করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। আহমেদাবাদের ঘাটলোদিয়া এলাকায় চার কামরার মধ্যবিত্ত বাড়িতে ছেলে সঞ্জয় এবং পুত্রবধূ আর তাঁদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে থাকেন মোদির এই দাদা। ছেলে সঞ্জয় একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। সঞ্জয়ের ছেলে নীরব ও মেয়ে নিরালি দু'জনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন। সঞ্জয় তাঁর লেদ মেশিনের দোকানে খুচরো যন্ত্রাংশ তৈরি করেন এবং মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করেন। পারিবারিক একটি চারচাকা কেনা আছে ঠিকই, কিন্তু দু'চাকাতেই যাতায়াত বেশি।
আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
সঞ্জয়ের পরিবার কখনও বিমানে চাপেননি, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মাত্র দু'বার দেখা হয়েছিল তাঁদের। ২০০৩ সালে, যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে, তিনি তাঁর গান্ধীনগরের বাড়িতে একটি পারিবারিক সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন এবং তারপরে ১৬ মে, ২০১৪ তারিখে, ফের গান্ধীনগরের বাসভবনে, যেদিন বিজেপি সেই ঐতিহাসিক লোকসভা নির্বাচন জেতে। যে আবাসনে তাঁরা থাকেন সেখানে সবাই জানেন অম্রুতভাই প্রধানমন্ত্রীর দাদা। কিন্তু শোনা যায়, সঞ্জয়ের যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে, সেই ব্যাঙ্কের আধিকারিকরা এই কথা জানেন না।
ছোটোবেলার কথা মনে করতে গেলে সঞ্জয়ের সবচেয়ে আগে মনে আসে একটি লোহার ইস্ত্রির কথা! প্রথম থেকেই ভালো করে আয়রন করা জামা কাপড় পরার প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর কাকা নরেন্দ্র মোদির। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১- আহমেদাবাদে অম্রুতভাইয়ের সঙ্গে থাকার সময় নরেন্দ্র মোদি একটি লোহার ইস্ত্রি ব্যবহার করতেন। বাবাকে কোনওদিন সেই ইস্ত্রি বিক্রি করতেও দেননি সঞ্জয়। কারণ তাঁর মনে হয়, যদি কাকা মানে নরেন্দ্র মোদি আজ এই লোহার ইস্ত্রি দেখেন, নিশ্চয়ই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়বেন। বাড়িতে প্রাচীন এক সিনি ব্র্যান্ডের টেবিল ফ্যানও রয়েছে, আহমেদাবাদের চরম গ্রীষ্মে এই পাখাই চালিয়ে শুতেন মোদি।
তবে পরিবারের সব্বাই যে মোদি-ভক্ত এমনও নয়। পরিবারের কিছু সদস্য এমনও আছেনযাঁরা মোদির বিরোধিতাও করেন। যেমন সবচেয়ে ছোট ভাই প্রহ্লাদ মোদি। রেশন দোকান চালাতেন এবং গুজরাত ফেয়ার প্রাইস শপ ডিলার্স ফেডারেশনে সহ-সভাপতি। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন পিডিএস ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার জন্য তাঁর বড় দাদা মোদির একজন সোচ্চার সমালোচক ছিলেন প্রহ্লাদ। চলতি বছরেই অগাস্ট মাসে দিল্লির যন্তর মন্তরে রেশন ব্যবসায়ীদের ধর্নায় উপস্থিত হয়েছিলেন প্রহ্লাদ মোদি। ধর্নায় বসে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। জিএসটির দাবি নিয়েও প্রতিবাদ করেছিলেন প্রহ্লাদ।
কেমন আছেন মোদির পরিবারের অন্যান্যরা? আসছে পরবর্তী লেখায়