ভারতের সংবিধানটা হাতে লিখেছিলেন, প্রেমবিহারী নারায়ণকে মনে রাখিনি আমরা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে যেভাবে আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে, পরিমাণগত ভাবেই সাধারণতন্ত্র দিবস বা তার নেপথ্য আখ্যান নিয়ে আলোচনা কম। ৭২ বছর পরেও সংবিধান রচনার কথা উঠলেই যে নাম সবার আগে উঠে আসে, তিনি হলেন বি আর আম্বেদকর। কিন্তু ক'জনই বা জানেন ভারতীয় সংবিধানকে বর্তমান রূপ দিতে সাহায্য করেছেন যেসব মানুষ তাঁদের কথা? এই মানুষগুলো থেকে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এমনই একটি নাম প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা। ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণ নিজে হাতে লিখেছেন দিল্লির এই মানুষটা।
প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করলেও দিনটির খুঁটিনাটি অনেক ভারতীয়র কাছেই আজানা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২৮ আগস্ট সংবিধান রচনার জন্য একটি স্থায়ী ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়।এই কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন বি আর আম্বেদকর। ৪ নভেম্বর ১৯৪৭ কমিটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা দেন। এরপর ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় ধরে এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১১ বার অধিবেশন ডাকা হয়। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। ভারতের সংবিধান পৃথিবীর দীর্ঘতম, হাতে লেখা সংবিধান। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি ভারতের সংবিধান প্রেম বিহারী নামে এক ভারতীয়র হাতেই লিপিবদ্ধ হয়েছে।
আরও পড়ুন-গায়ে জাতীয় দলের জার্সি, মনে চিকিৎসার মন্ত্র, বিশ্বের বিস্ময় আফগান শরণার্থী নাদিয়া নাদিম
প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা ১৯০১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিল্লির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলাতেই বাবা - মাকে হারালে তাঁর দাদু রাম প্রসাদ ছোট্ট শিশুর দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দাদুর কাছেই মানুষ হন প্রেমবিহারী। রামপ্রসাদ ছিলেন পার্সি ও ইংরেজি ভাষার পণ্ডিত। এমনকী ব্রিটিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদেরও পার্সি শিখিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। পাশাপাশি ক্যালিগ্রাফিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। দাদুর কাছেই ক্যালিগ্রাফিতে হাতে খড়ি হয় প্রেমবিহারীর। দিল্লির স্টেন স্টিফেন্স কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরেই পুরোদমে ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু করেন প্রেমবিহারী। ধীরে ধীরে সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এক সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ডেকে পাঠান তাঁকে। নেহেরুর ডাকে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ন বিনা পারিশ্রমিকে সংবিধান লেখার কাজ শেষ করেন তিনি। ইটালিক হরফে লেখা ভারতীয় সংবিধান লিখতে তিনি মোট ৪৩২ টি পেন নিব ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। ৩০৩ নম্বর ক্যালিগ্রাফি নিব ব্যবহর করেন প্রেমবিহারী, যা ইংল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়। সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে সংবিধান লেখার কাজ শেষ হয় মাত্র ছয় মাসেই। মোট ২৫১ পাতার পার্চমেন্ট কাগজে লেখা এই সংবিধানের পাণ্ডুলিপির ওজন ৩.৭৫ কেজি। সংবিধানের ৩৯৫ টি ধারা, ৮ টি তফশিল ও প্রস্তাবনা লিখেছিলেন প্রেমবিহারী।
তবে পারিশ্রমিকের বদলে প্রেমবিহারী নেহেরুর কাছে এক অদ্ভুত শর্ত রাখেন প্রেমবিহারী। তিনি সংবিধানের প্রতি পাতায় তাঁর এবং শেষ পাতায় তাঁর দাদু রামপ্রসাদের নাম লেখার আর্জি জানান। নেহরু রাজিও হন সেই শর্তে। এরপরই নিজের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে সংবিধান লেখার কাজ শুরু করেন তিনি। সংসদ ভবনের একটি কক্ষে বসে প্রেমবিহারীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ভারতীয় সংবিধান। এই কক্ষই পরবর্তীকালে সংবিধান ক্লাব নামে পরিচিত হয়।
এছাড়াও সংবিধানের প্রতি পাতায় যে সুন্দর অলংকরণ দেখা যায় তাঁর দায়িত্বে ছিলেন শান্তিনিকেতনের শিল্পী নন্দলাল বসু ও তাঁর ছাত্ররা। ভারতীয় সংবিধান দুটি ভাষায় লেখা হয়- হিন্দি ও ইংরেজি। হিন্দি লেখার ক্ষেত্রে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন আর এক শিল্পী বসন্ত কিসান বৈদ্য। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রেমবিহারীর লেখা সংবিধানে স্বাক্ষর করেন গণপরিষদের সদস্যরা। প্রথম স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ। হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় হাতে লেখা সেই প্রথম সংবিধান আজও পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে একটি বিশেষ হিলিয়াম কেসে সংরক্ষিত রয়েছে। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন প্রেমবিহারীর মতো ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে জড়িত স্বল্পবিদিত নামকে না মনে করলে বঞ্চনা করা হবে। ভারতীয় সংবিধানের প্রতি পাতায় আজীবন বেঁচে থাকবেন প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা।