আজও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বহন করে কুয়াশামাখা এই পাহাড়ি বাংলো

মংপুর এই বাসভূমি গুরুদেবের শেষ জীবনের আশ্রয়স্থল, যার সান্নিধ্যে এসে জোড়াসাঁকোর চৌহদ্দির আড়ালে লুকিয়ে রাখা যাবতীয় বিস্ময়কে তিনি দু' হাত ভরে আস্বাদন করতে করতে, পাড়ি দিয়েছিলেন অমৃতলোকের দিকে।

 

বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম মৃত্যুদিবস। মৃত্যুদিবস শব্দটা নেহাতই একটা উপমামাত্র, যাকে কেন্দ্র করে একটা গোটা দিন উদযাপন করা যায় রবীন্দ্রজীবনের বিস্মৃত ভান্ডারকে নতুন করে আবিষ্কার করার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, মৃত্যুকে আশ্রয় করে কীভাবে নতুন যাপন পদ্ধতিকে জানতে পারা যায় জীবনের পরতে পরতে। তাই তো অনেক আঘাত আর অনেক মৃত্যু সয়ে যাওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন, 'দুঃখ জানবার গুরুত্ব' কতখানি। এহেন উপলব্ধিই আমাদের ভরসা দেয় দুঃখকে গ্রহণ করতে, এহেন ভাবনাই আমাদের চেতনায় দুঃখবোধ আর মৃত্যুতাড়নাকে প্রশমিত করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তাই ঘুরে ফিরে আবারও স্মরণ করি সেই দুঃখজাগানিয়াকেই।

রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধকে নিজের মধ্যে চারণ করতে কত না অজানা পাহাড়-নদী-অরণ্যের কোলে ঠাঁই নিয়েছেন আজীবন। সেইসব প্রাকৃতিক সূক্ষ্মানুভূতিই তাঁর কলমকে ঋদ্ধ করেছে প্রতি মুহূর্তে। পাহাড় ছিল গুরুদেবের নিভৃত যাপনের ঠিকানা। সুযোগ পেলেই মাঝেমধ্যে তিনি দার্জিলিং, সিমলা, ডালহৌসি বেরিয়ে আসতেন। এর মধ্যে কালিম্পং বেড়াতে বেড়াতে প্রথমবার তিনি মৈত্রেয়ী দেবীর অনুরোধে মংপুতে আসেন ১৯৩৮ সালের ২১ মে। মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং ঘটনাসূত্রে তাঁর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশনের বিখ্যাত কুইনোলজিস্ট। সেই সূত্রেই মংপুতে তাঁদের কোয়ার্টারে বারংবার আমন্ত্রণ জানাতেন কবিকে মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৩৮ সালের পর ১৯৩৯ সালের ১৪ মে তিনি কয়েকদিনের জন্য এখানে আসেন। মংপুর এই সিঙ্কোনা-ঘেরা পাহাড়ি বনভূমিই তাঁকে প্রথম চিনতে শেখায় জঙ্গল আর অরণ্যর প্রভেদ। লম্বা লম্বা সব গাছ, যারা ঊর্ধ্বমুখে দণ্ডায়মান আর যার নিচে ঘন ছায়ায় কেবলই চোখে পড়ে কালো কালো অন্ধকার, তাকেই ভালবেসে 'অরণ্য' বলে আখ্যা দেন কবি। তাই অরণ্যকে আরও নিবিড় করে পেতে সেই বছরই সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে চলে আসেন তিনি মংপুর এই বাড়িতে, প্রায় দু'মাসের জন্য। এই সমস্ত সময়ই তিনি 'বাংলা ভাষা পরিচয়'-এর কাজ চালিয়ে যান প্রতিদিন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন গান ও কবিতাও রচিত হয় এই পাহাড়ি বাংলোয় বসেই, যার মধ্যে 'নবজাতক', 'আকাশপ্রদীপ', 'ক্যামেলিয়া' উল্লেখযোগ্য।

গুরুদেবের বসার ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে একটা প্রকাণ্ড anarcaria পাম গাছ দেখা যেত, আর ঠিক তার নিচেই একটা ক্যামেলিয়া গাছ সাদা ফুলে ভরিয়ে দিত তাঁর সমস্ত সকালটাকে। এমন এক দৃষ্টিনন্দিত রূপকে তিনি তাই বলতেন, 'মোমের ফুল', এবং স্বাভাবিকভাবেই কবির উৎসুক মন তাঁকে বারবার কলম থামিয়ে নিমগ্ন করত, মোমের ফুলের দৃষ্টিসৌরভের কাছে।

আরও পড়ুন: ‘আজ সকালে সে মারা গেছে’, কাছের মানুষের মৃত্যুশোক সারাজীবন তাড়া করেছে রবীন্দ্রনাথকে

সেসময় মংপু যাওয়া আজকের মতো সহজ ছিল না। কখনও সড়কপথে শিলিগুড়ি থেকে রম্ভি অথবা কখনও টয় ট্রেনে গেলিখোলা অবধি পৌঁছতে হতো তাঁকে। আর রম্ভি থেকে পালকি সহযোগে ন'কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, তবে মংপুর এই বাসভূমিতে পৌঁছতেন তিনি। তাই মাত্র চারবারের বেশি আসতে পারেননি তিনি এখানে। শেষবার আসেন ১৯৪০ সালের ২১ এপ্রিল। সেবার মহাসমারোহে পাহাড় আর শাল-সেগুন-অর্জুন গাছে ঘেরা এই মংপুতে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। সেই স্মৃতিতেই তিনি এখানে বসে লেখেন তাঁর জন্মদিন কবিতাটি। এরপর পঞ্চমবারও তিনি এখানে আসার কথা ভাবেন শরৎকালের গোড়ার দিকে। তবে কালিম্পঙে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে সত্বর কলকাতায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাটানো সময়ের নানাবিধ অভিজ্ঞতার সবটুকুই মৈত্রেয়ী দেবী লিখে গেছেন তাঁর 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইটিতে।

Mogpu Tagore residence

'দক্ষিণের বারান্দা'

গুরুদেবের মৃত্যুর তিনমাস পর এই বাংলোটিতে রবীন্দ্র সংগ্রহশালা তৈরি করা হয়, নাম দেওয়া হয় 'রবীন্দ্র ভবন'। এই বাড়ির ঠিক বিপরীতেই রয়েছে কুইনাইন কারখানার প্রধান গেট। কুইনাইনের কারখানাগুলো যেমন আজ অবহেলিত, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, তেমনই রবীন্দ্রনাথের এই বাসভবনও দীর্ঘ অনেক বছর এমনই অবহেলায় পড়েছিল। এরপর সিঙ্কোনা কর্তৃপক্ষ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রালয় ও জিটিএ-র তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিকদের দীর্ঘদিনের সম্মিলিত টানাপোড়েনের পর অবশেষে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ তকমা পায় এই বাড়িটি।

Mongpu Tagore residence

মংপুর 'রবীন্দ্র ভবন'

বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বহু বছর ধরে কাজ করছেন শিশিরকুমার রাহুত। তিনি যে একজন আদ্যোপান্ত রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ, তা তাঁর ব্যবহারে সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্র ভবনের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে থাকা, প্রতিটি দ্রষ্টব্য তিনি অবিরাম আগ্রহে দেখিয়ে যান প্রতিটি পর্যটককে। এতটুকু ক্লান্তি নেই তাঁর শরীরে। এরই মাঝে কখনও পাইনগাছের তলায় বসে গুনগুনিয়ে ওঠেন, 'কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে, সে তো আজকে নয়'।

এই বাড়ির সমস্তটা জুড়ে রবি ঠাকুরের চিরকাঙ্ক্ষিত নান্দনিকতা ছড়িয়ে রয়েছে‌। বাড়িটি ক্লাসিক ইউরোপিয়ান স্থাপত্যরীতিকে মাথায় রেখে বানানো হলেও, গৃহসজ্জার প্রতিটি ক্ষেত্রে রবীন্দ্র ভাবনার ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁর লেখার ডেস্ক, রঙের প্যালেট, বায়োকেমিক্যাল শিশির পাশাপাশি রয়েছে তাঁর আঁকা বেশ কিছু ছবি এবং মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা বেশ কিছু চিঠিপত্র। শিশিরবাবুর একটা অভিযোগ আছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে‌‌। তিনি বলেন, জীবনের ৪০ বছর পেরিয়ে যাবার পর তিনি কলমের সঙ্গে তুলি ধরলেন এবং ম্যাজিকের মতো পাহাড়কে ফুটিয়ে তুললেন তাঁর ক্যানভাসে। অথচ অর্ধেক লোক দেখলই না তাঁর আঁকা ছবি। এখনও নিয়ম করে এই বাড়ি দায়িত্ব নিয়ে পরিষ্কার করান শিশিরবাবু।

Mongpu residence

'কতই ছবি এঁকেছি যে...'

গোটা বাড়িটার মধ্যে স্নানাগারটি দেখতে অত্যন্ত চমকপ্রদ লাগে‌। লাল সিমেন্ট দেওয়া ছোট্ট দেশীয় ধাঁচের স্নানঘরে কী সুন্দর করে গরম জল ও ঠান্ডা জলের খোপকাটা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। দেখে আজকের যুগে গড়ে ওঠা পাহাড়ের কোলে থাকার বাহারি হোটেলগুলোকে বড় ক্লিশে মনে হয়।

এ বাড়ির সবটুকু জুড়ে আলোছায়া লুকোচুরি খেলে সারাদিন। এ বাড়িই কবিকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল অহরহ ধাক্কা দিয়ে যাওয়া বিরহদহন আর শোকগাঁথাকে। তাই মংপুর এই বাসভূমি গুরুদেবের শেষ জীবনের আশ্রয়স্থল, যার সান্নিধ্যে এসে জোড়াসাঁকোর চৌহদ্দির আড়ালে লুকিয়ে রাখা যাবতীয় বিস্ময়কে তিনি দু' হাত ভরে আস্বাদন করতে করতে, পাড়ি দিয়েছিলেন অমৃতলোকের দিকে।

 

More Articles