প্রথম রাজভোগ এল রাষ্ট্রপতি ভবনে, রাইসিনা হিলে কেমন কেটেছিল সাতটা দিন?
রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ, বাগিচা, আর সত্যিই অবিশ্বাস্য গ্রন্থভান্ডার , এই তিনটি ব্যাপার দেখার ও বোঝার জন্য সাতদিন যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের লাইব্রেরি।
দি প্রেসিডেন্ট অফ্ ইন্ডিয়া ইজ অন দি লাইন!
আমি সেলফোন হাতে স্তম্ভিত।
সেলফোনে যে নম্বর দেখা দিল, সেটা দিল্লির!
পরক্ষণেই তাঁরই নিশ্চিত কণ্ঠস্বর। এবং তাঁরই নির্ভুল স্টাইল।
প্রণব বলছি!
আমি নিরুত্তর। বেশ কিছুদিন আগে আমার একটি বই উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তিনি। আমাকে বলেছিলেন সব্যসাচী, কারণ আমার বাংলা ও ইংরেজি লেখা তাঁর বেশ লাগে। আমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে একটি আন্তরিক চিঠি লিখেছিলেন। এবার কী?
আমার মুখে কথা ফোটার আগেই তিনি বললেন, যেটুকু বলার জন্য তাঁর ফোন: শোনো, পরের সপ্তায় আমার এখানে চলে এসো। আমার বাড়িতে এসে দিনসাতেক কাটিয়ে যাও। কোনও কাজ নয় স্রেফ আড্ডা। তোমার আসার সব ব্যবস্থা করছি। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে। ঠিক আছে? রাখছি। লাইন কেটে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে ফোন। আমার ব্যক্তিগত ডিটেলসের জন্য। ঠিক এক হপ্তা পরে আমাকে নিয়ে প্লেন নামল দিল্লি এয়ারপোর্টে! জীবনে এই প্রথম রানওয়ের পাশেই আমার জন্য অপেক্ষায় গাড়ি। এবং সেই গাড়ি চেপে সোজা রাষ্ট্রপতির বাড়ি! রাইসিনা হিলস! ঠিক বাড়ি নয় অবশ্য। এক অনুপম প্রাসাদ! সেই প্রাসাদে আমার অপেক্ষায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: সুচিত্রা সেনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমার, উত্তরে কী বলেছিলেন মহানায়িকা?
সাতদিনের এই রূপকথা কেন ঘটল, আজও বুঝিনি। হঠাৎ আলোর ঝলকানি। এই হলো আমার একমাত্র ব্যাখ্যা। পরের দিন সকালে প্রণববাবুর মুখোমুখি আমি তাঁর বিপুল এবং বিদগ্ধ বসার ঘরে। এই ঘরটির গাম্ভীর্য, ব্যক্তিত্ব, গ্রন্থকীর্ণতা আমাকে মুগ্ধ করল।
আমি আমার বেশ কিছু বই উপহার দিলাম প্রণববাবুকে। উনি ভীষণ খুশি হলেন। শুরু হলো আলোচনা। আমি অবাক। উনি আমার বেশ কিছু বই পড়েছেন! যেমন, রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আমার বই 'প্লাতা নদীর ধারে', যেমন রবীন্দ্রনাথের দহিত দাম্পত্য নিয়ে আমার বই 'আমি রবি ঠাকুরের বউ', যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নতুন বউঠান কাদম্বরীর প্রবল প্রণয় নিয়ে আমার বই 'কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড নোট'। খুঁটিয়ে পড়েছেন তিনি। এবং মনে রেখেছেন। আমি প্রশ্ন না করে পারিনি, এত কাজের মধ্যে আপনি আমার মতো লেখকের বইও পড়তে সময় পান? প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উত্তরটি আমার চিরদিন মনে থাকবে: বই পড়া তো নিশ্বাস নেওয়ার মতো। আলাদা করে সময় বের করার দরকার হয় না। ভেবেছিলাম, উনি আমার বিতর্কিত বইগুলির জন্য আমাকে তিরস্কার করবেন। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি বললেন, তুমি যে বইগুলি লিখেছ, যে দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে দেখছ, তার প্রয়োজন আছে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ঘরে কেউ নেই। ইশ, এই কথাগুলি যদি তিনি সবাইকে শুনিয়ে বলতেন! আমি জানতাম না, আরও বড় বিস্ময় আমার প্রতীক্ষায়!
একটি বিস্ময় ভারতের রাষ্ট্রপতির আপ্যায়ন, যত্ন এবং রাজকীয় আয়োজন। আমি তাঁর রাইটার ইন রেসিডেন্স অতিথি! তার মানে কী, আমি ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলাম। যেন এক রূপকথার পাতা খুলছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ভোরের চা থেকে শুরু। আমি আছি প্রেসিডেন্টের বাড়ির অন্দরমহলের অতিথি প্রাসাদে। এতো আরামের প্লাবনে কখনও ভেসে যায়নি। এই প্রথম। এই শেষ। চা-এর পরেই ব্রেকফাস্ট বুফে। গোল টেবিলের ওপর সাজানো। ফলের রস থেকে থরে থরে সাজানো বাহারি সুখাদ্য। এইখানে একটি কথা জানানো দরকার। রাষ্ট্রপতির বাড়ির কোনও খাবার বাইরে থেকে আসে না। পাঁউরুটি, মাখন, সব তৈরি হয় প্রাসাদের মধ্যেই। আমি প্রেসিডেন্টের রান্নাঘর দেখেছি। প্রায় তিরিশ জন কাজ করছেন সেই দেখার মতো রান্নাঘরে। দুপুরের ভোজে কন্টিনেন্টাল থেকে মোগলাই, আমি যা চাই তাই পাই। অপূর্ব রান্না। আমার বারবার একটি লাইন মনে পড়ে। ভূতের রাজা দিল বর। এবং আমি একই সঙ্গে গুপি-বাঘা। টু ইন ওয়ান। আমার একটাই কাজ। জীবনের খাওয়া খেয়ে নেওয়া।
রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ, বাগিচা, আর সত্যিই অবিশ্বাস্য গ্রন্থভান্ডার , এই তিনটি ব্যাপার দেখার ও বোঝার জন্য সাতদিন যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের লাইব্রেরি। প্রণববাবুকে একদিন বলেই ফেললাম। আপনার লাইব্রেরির পাশে একটি কোনায় যদি বাকি জীবন কাটাতে পারতাম! উনি হেসেছিলেন।
ফিরে আসার আগের দিন শুধু মাত্র আমার সম্মানে প্রণববাবু একটি ডিনার পার্টি দিলেন। আমি হতবাক। আমার জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি এমন এলাহি আয়োজন করেছেন! কেন? কে নেই সেই পার্টিতে! আমার আসনটি টেবিলে প্রণববাবুর পাশেই। একের পর এক সুরম্য সুখাদ্য আসছে তো আসছেই! সব শেষে এল রাজভোগ। প্রণববাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রাষ্ট্রপতির বাড়িতে রাজভোগ আমি এনেছি। এই প্রথম। ঐতিহাসিক ঘটনা।
কিন্তু রাজভোগের চেয়ে বেশি গুরুত্বের ব্যাপার, সবাইকে শুনিয়ে তাঁর এই কথা: রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে, তাঁর জীবন নিয়ে রঞ্জন যেভাবে লিখছে, তার প্রয়োজন আছে। এই রূপকথা আমৃত্যু থেকে যাবে আমার জীবনে।
ছবি সৌজন্য: লেখক