চাঁদে বেড়াতে যাবেন? আপনার সেবায় হাজির পৃথিবীর বেওয়ারিশ শরণার্থীরা...
Moon Tourism: যুদ্ধের শরণার্থীদের নিয়ে নাজেহাল দেশের সরকারগোষ্ঠী। তাই, তারা সেই শরণার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে চাঁদে পাঠাচ্ছে।
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা-কাটা বুড়ি
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশো হাজার কুড়ি।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে,
হয় না বুনোন সারা—
পণ ছিল তার ধরবে জালে
লক্ষ কোটি তারা।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
বাঙালির শৈশবের ঘুম জুড়ে থাকে এই চাঁদের বুড়ির স্বপ্ন-কল্প-গল্প। সেই আমাদের চাঁদ দেখতে শেখা। আমাদেরই শৈশবের চাঁদ পায়ে পায়ে কৈশোর ডিঙোয়। চাঁদ নিয়ে বিস্ময় বাড়ে। বইয়ের পাতায় অল্প অল্প করে চাঁদের বুড়ির খোলস ছাড়তে থাকে, বিজ্ঞানের বর্ম পরে, যুক্তির অলঙ্কার। সেই নরম-উদাস দিনগুলোতে আকাশের জানালায় ঝিকিমিকি তারার মাঝে একফালি চাঁদ হাতছানি দেয় কোনও এক রহস্যালোকের। পৃথিবীর বাইরে আর কোনও গ্রহ, উপগ্রহ বা নক্ষত্রকে এত কাছ থেকে ভরপুর দেখার সুযোগ কই? এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে তাই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়জন হয়ে ওঠে চাঁদ। চাঁদ যখন যৌবনে, বুড়ির গল্প তোলা থাকে গোয়ালঘরের মাচায় কিংবা তেতলার চিলেকোঠায়। সেই উথাল-পাথাল সময়ে আসমান-জমিন এক করে ছাড়ে প্রিয়তমাসু চাঁদ। হৃদয়মথিত কবিতায়, গানে চাঁদের সে কী ভিড়! চাঁদই একই অঙ্গে ঝলসানো রুটি আবার বহু কাঙ্খিত প্রেম। বিচিত্র! কোনও এক সুদূর অতীত থেকেই পূর্ণিমার নিটোল চাঁদ আর তার জোছনা বিভোর করেছে আমাদের। তবে, পেয়ালায় ভরে সেই শরাবি জোছনায় চুমুক দিয়ে কতদিন আর পোষায়! চাঁদ চাই হাতের মুঠোয়। চাই তার শরীর ছানবিন করে দেখা। সেই চাঁদের লোভে মেঘ না জুটুক, মানুষ জুটেছে ঢের। আর মেঘেদের উড়ো চিঠির বদলে একের পর এক স্পেসক্র্যাফট পৌঁছে গেছে। তার মধ্যে থেকে ল্যান্ডার, রোভার ও অরবিটাররা চাঁদের মাটি ছুঁয়ে, ঘুরে বেরিয়ে, কক্ষপথে পাক খেতে খেতে খবর পাঠাচ্ছে অবিরাম।
চাঁদে পাড়ি জমানোর দৌড় শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত ধরে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত চলেছিল তাদের চন্দ্রাভিযান লুনা। এরপর আমেরিকার পালা। ১৯৬৯ এর ১৬ জুলাই চাঁদের দিকে যাত্রা করে অ্যাপোলো-১১। এই অভিযানেই মানুষ প্রথম চাঁদে পৌঁছল। অভিযাত্রী ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অল্ড্রিন। ঠিক ওই দশকগুলোতেই, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠান্ডা লড়াইকে তাতিয়ে তুলেছিল এই চাঁদ ধরার দৌড়। যাই হোক, ২০০৮ সালে চাঁদের দিকে প্রথম পা বাড়ালো ভারতের চন্দ্রযান-১। এরপর ২০১৯-এ পাঠানো হয় চন্দ্রযান-২। দিন কয়েক আগেই চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দিকে রওনা দিয়েছে।
আরও পড়ুন- চাঁদে নামার সাফল্যের হার মাত্র ৫২%, চন্দ্রযান ৩ কি পারবে ইতিহাস গড়তে?
চাঁদে অভিযান এখন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তাক লাগানো বিষয় বা বিস্ময় কোনটাই নয়। বরং চাঁদসহ মহাকাশে কার কতটা দখলদারি থাকবে, তা আজকের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরুপের তাস। সেখানে কেউই চায় না ইস্কাবনের টেক্কা হয়ে টিকে থাকতে। গত কয়েক বছরে ধরেই বিশ্বের নামিদামি তারকা থেকে শুরু করে আমাদের দেশের বিত্তওয়ালা বাবু-বিবিরা একে অপরকে চাঁদের জমি উপহার দিচ্ছেন। আগামী দশকের মধ্যেই হয়তো চাঁদনি মার্কেটে চাঁদের জমি হাঁকবে একদামে। ই-কমার্স সাইট তো আছেই। চাঁদ মুলুকে জমি কেনাই নয়, তখন শহুরে ভদ্রবিত্তের অফবিট ডেস্টিনেশনও ওটাই। খরচা পাতি নিয়ে ভাবনাই নেই, হাজার একটা ফিনান্স সার্ভিস আছে । বেশ সস্তায় ইমআই স্কিমের বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। বেশ কিছু দেশের সরকার ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার কথাও ঘোষণা করবে। চাঁদে বেড়াতে যাওয়া থেকে জমি কেনা সবটার বরাত পাচ্ছে বেসরকারি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। আসলে, চাঁদ থেকে অঢেল সিলিকন আর হিলিয়াম আনছে কোম্পানির লোকেরা। এই সিলিকন দিয়েই তৈরি হয় যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি। সেসব যন্ত্রপাতি আমাদের ঘিরে রেখেছে এই ডিজিটাল ও এআই-এর যুগে। আবার, সেগুলো চালাতে বিদ্যুৎ খরচও ব্যাপক বেড়েছে। সুতরাং, হিলিয়াম নিয়ে এসে এখন বেশ সস্তায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার তৈরি করা যাচ্ছে। এসব করে কোম্পানির ব্যবসাও চলছে রমরমিয়ে। তাই, চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে তাদের কিছু 'সাবসিডিয়ারি স্কিম'ও রয়েছে। ভর্তুকির পাশাপাশি বিভিন্ন মরসুমে ফ্ল্যাট অফার থাকছে। তেমন একটা খাসা অফার দেখে এবার বেরিয়ে পড়লেই হয়।
চাঁদে পৌঁছেই নিজেকে বেশ ফুরফুরে মনে হবে। এখানে শরীরের ওজন, পৃথিবীতে ওজনের ছয় ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। থাকার জন্য এখানে মাটির নিচে বাঙ্কার রয়েছে। চাঁদের বায়ুমণ্ডল নেই। তাই, টানা চোদ্দদিন যখন দিন, তখন তাপে ঝলসে যেতে হয়। আর, রাত হলেই হাড়গোড় সহ ঠান্ডায় জমে যেতে হবে। মাঝেমধ্যেই উল্কাপাত হয় চাঁদের মাটিতে। এত ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পেতে, বাঙ্কারে থাকাই শ্রেয়। মাটির ওপরে বেশ কিছু গ্লাস হাউসও আছে অবশ্য। বাঙ্কার কিংবা গ্লাস হাউস গুলোতে প্রয়োজনীয় মাইক্রো ক্লাইমেট তৈরি করা হয়েছে। চাঁদে জল-টল পাওয়া যায়। সেখান থেকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন তৈরির অসুবিধে নেই। নানারকম কৃত্রিম গাছপালাও তৈরি করা হয়েছে। সময় কাটানোর জন্য কেউ কেউ তাঁদের পোষ্য ল্যাব্রাডর কিংবা সাদা ইঁদুরও নিয়ে গেছেন। জিন মিউটেশন করে চাঁদে থাকার উপযুক্ত কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীতেই।
ইতিমধ্যে পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক মরসুমেই ‘ক্লাইমেট ইমারজেন্সি’ ঘোষণা করা হচ্ছে। গরমের তাপ যেমন অসহনীয়, তেমনই হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সমুদ্র উপকূল। স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সুতরাং, চাঁদে বিনিয়োগ করা বা বেড়ানো পছন্দ করছেন অনেকেই। তবে, চাঁদে থাকাকালীন দিনগুলোতে ভিগান খাবারই ভরসা। আমিষ খাবার পাওয়া যায় কিছু। তবে সে প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট। প্রি-অর্ডার করতে হয় চাঁদের টিকিট বুক করার সময়ই। আসলে, ওই খাবার তৈরি হয় পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটা ল্যাবরেটরিতে, নানা ধরনের প্রাণীর স্টেম সেল থেকে।
আরও পড়ুন- পৃথিবীর মতো অ্যালার্ম নেই, ঘড়িও না! জানেন, চাঁদে এখন ঠিক ক’টা বাজে?
চাঁদে পৌঁছে আমার-আপনার যা যা সার্ভিস দরকার তার সবটাই প্রায় অটোমেটেড। তারপরেও সেগুলো দেখভাল করার জন্য, চালানোর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ তো দরকার। তাও পাওয়া যায় সহজেই। পৃথিবীতে মুহুর্মুহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জীবিকা হারাচ্ছে মানুষ, বাড়ছে বাসস্থানের সংকট। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় খাদ্য সংকটও চরমে। এআই নির্ভর ওয়েদার প্রেডিকশন অথবা জিন মিউটেড শস্য চাষেও সামলানো যাচ্ছে না এই পরিস্থিতি। খাবার জল, শ্বাসের বায়ু কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। পাকেচক্রে, গৃহযুদ্ধও চরম পর্যায় পৌঁছেছে বহু দেশে। চলছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সামরিক টানাপোড়েন। এসবের জাঁতাকলে হাজার হাজার শরণার্থী দিশাহীন। বিভিন্ন দেশের সরকারগোষ্ঠী এই বেওয়ারিশ-বেওকুফদের বাঁচা-মরার হিসেব নিয়ে চিন্তিত নয়। এই বাজারে শরণার্থীদের কেউ কেউ বেসরকারি স্পেস কোম্পানিগুলোর ফড়ে মারফত চাঁদে চলে যাচ্ছে। শর্ত একটাই যখন-যেমন-যেভাবে চাই, সার্ভিস দাও। তাহলেই থাকা-খাওয়া টোটাল ফ্রি! চাঁদে গিয়ে সার্ভিসের জন্য, আমি-আপনি একটা কল দিলেই এরা হাজির আজ্ঞে-হুজুর বলে।
ওদিকে, গৃহযুদ্ধ, খামখেয়ালি আবহাওয়া, জনসংখ্যার চাপ, গরিবি, পানীয় জল ও খাদ্য সংকট— এসবের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে পৃথিবী বিষণ্ণ। যে গুটিকয় সবুজ মাঠ টিকে গেছে দূরে কোথাও, তেমনই কোনও মাঠ পেরিয়ে স্কুল ছুটির বিকেলে দৌরাত্ম্য করে বেড়ায় হাড়-হাভাতে শিশুর দল। সন্ধ্যে নামলে মরা আলোয় তারা এসে বসে মাঠের শেষে জল টইটই সরু এক নদীর পাড়ে। ঠেলাঠেলি করে, হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসতে হাসতেই দূরে কয়েকটা গাছের ওপর দিয়ে আকাশের দিকে চোখ যায়। চিকন পাতার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে ভরাট গোল চাঁদ। মুগ্ধতায় সকলেই চুপ। ক্রমে চাঁদের পিঠ, পিঠের ক্ষত স্পষ্ট হয়। হঠাৎ তার ভেতরেই আবছা অবয়বে ফুটে উঠে এক বুড়ি। ক্লীষ্ট, জীর্ণ চেহারা নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে সে, ন্যুব্জ। কাঁখে ভাঙা চরকা। দখলদারির এই নিলামে তাঁর মূল্য নেই, বাতিল আবেগের মতোই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে এককালের বুড়ি, এককালের বিশ্বাস। মাঠের শেষে নদীর পাড়ে সেই একঝাঁক শৈশব তখন দু’চোখ ভরে দেখছে আর ভাবছে,
“কোথা সে চলিল ভেসে!
শশির লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশিহীন দেশে!”