বিদ্যাসাগরের দয়া, করুণার মধ্যেই কি লুকিয়ে ছিল প্রেমের ভাষা?

পাথর-চাপা ঝরনার এই ছবিটি চোখের সামনে রেখে দু'জন মানুষের দিকে তাকাই। খ্যাতিমান, শ্রুতকীর্তি পুরুষ তাঁরা। সমকালীন, তবে দু'-রকম দু'জনে। মধুসূদন আর বিদ্যাসাগরের কথা বলছি।

দয়াকে কি ভালবাসা বলে? করুণা কি ভালবাসা বলে বিবেচিত হয়? ভালবাসার ঝরনামুখে পাথর চাপালে কি তা দয়া আর করুণা হয়ে চাপানো পাথরের পাশ দিয়ে বাইরে আসে ধীর গতি, এবং ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দেয় আশপাশের মাটি! ঝরনাটি তীব্র একমুখী ছিল– পাথর চাপাতেই সেই জল আটকে গিয়ে ক্রমে পাথরের গা বেয়ে বাইরে এল, তুলনায় ধীরে, তারপর ছড়িয়ে পড়ল ঝরনাতলার মাটিতে, ক্রমে অনেকটা জায়গা নিয়ে।

পাথর-চাপা ঝরনার এই ছবিটি চোখের সামনে রেখে দু'জন মানুষের দিকে তাকাই। খ্যাতিমান, শ্রুতকীর্তি পুরুষ তাঁরা। সমকালীন, তবে দু'-রকম দু'জনে। মধুসূদন আর বিদ্যাসাগরের কথা বলছি। মধুসূদন রেবেকা আর তাঁর সন্তানদের মাদ্রাজে ফেলে রেখে চলে গেলেন। তখন তাঁর হৃদয়-ঝরনা ধাবমান হেনরিয়েটার দিকে। এই হেনরিয়েটার সঙ্গেই বাকি জীবনের দুঃখ-সুখ-যন্ত্রণা ভাগ করে নেবেন মাইকেল।

মাইকেল লিখেছিলেন, খুব তীব্র এক পত্র-প্রেমের কাব্য। নাম তার 'বীরাঙ্গনা'। সেই 'বীরাঙ্গনা'-য় নারীরা, ভারতীয় নারীরা, তীব্র আবেগে চাইছেন যাঁকে, সেই পুরুষের কাছে নিবেদন করেছিলেন প্রেম। সমাজের দোহাই দিয়ে হৃদয়ের ধারাপথে তাঁরা চাপাননি পাথর। যেমন বিতর্কিত পত্রকাব্যের নায়িকা তারা পরিচয়ে গুরুপত্নী। গুরুপত্নী তো মাতৃসমা হন। শিষ্য তাঁর কাছে সামাজিক বিধি অনুসারে সন্তানতুল্য। তবু যদি অবুঝ হৃদয় জাগে– প্লাবনে ভাসিয়ে দেয় সমাজের শাসন! তারা, গুরুপত্নী তারা, স্বামীর শিষ্য সোমকে ভালোবেসে লিখেছিলেন চিঠি।

আরও পড়ুন: বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ সম্পর্কের ভিয়েন, আজও অটুট রহস্য

এই আশ্চর্য প্রেমের কাব্যখানি মধুসূদন দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে। এই বই উৎসর্গ করেছিলেন করুণাসাগরকে। যখনই বেহিসেবি, খামখেয়ালি প্রতিভাবান মধুসূদন বিপদে পড়েছেন, তখনই তাঁকে সাহায্য করেছেন সেকালের ঈশ্বর। সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করা ছেলেটি বিবেচক, বাস্তববাদী, দয়াময়। বাবা ঠাকুরদাস অনেক ভেবে বিবেচনা করে ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু কলেজের পরিবর্তে পড়িয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজে। হিন্দু কলেজের ছেলেদের মতো ভারতীয় সমাজের বিধিকে ভাঙেননি তিনি প্রবল তাৎক্ষণিকতায়। মেয়েদের জন্য করেছেন অনেককিছু। সেই করার মধ্যে সমাজ ভাঙার তাৎক্ষণিক উন্মাদনা ছিল না। আবেগের ওপর, অনুভবের ওপর বিবেচনার পাথরটি চাপিয়ে কাজগুলি করেছিলেন সুবিবেচনায়, মেধাবী কৌশলে। জানেন স্বামীবিয়োগ হলে স্ত্রী-শরীর পাষাণবৎ হয়ে যায় না। আর তাই বিধবা রমণীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত বৈধব্য পালনের কঠিন অমানবিক নীতি। পরাশর সংহিতা খুঁজে ঈপ্সিত শ্লোকটি পেলেন। তারই শাস্ত্রীয় দাপটে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হল। বিধবা নারী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারেন পরাশরের বিধানে, ইংরেজ উপনিবেশের আইনে। এই বিদ্যাসাগর, যিনি এমন করে মেয়েদের শরীর-মন বোঝেন, তাঁকেই তো উৎসর্গ করা চলে 'বীরাঙ্গনা'। মধুসূদন করেছিলেন। রেবেকাকে অন্ধকারে ফেলে আসা, হেনরিয়েটার প্রতি ধাবমান মধুসূদন করেছিলেন।

কিন্তু সত্যি কি বিদ্যাসাগর প্রণয়, যাকে একমুখী মানুষের প্রতি মানুষীর ও মানুষীর প্রতি মানুষের প্রেম বলে, সেই শরীর-মন আচ্ছন্নকারী প্রণয়ের ভাষা বোঝেন কি‌ংবা যাপন করতে চান? হয়তো বোঝেন, কিন্তু যাপন?

বিদ্যাসাগর যে-সময় বঙ্গদেশে বিরাজমান, সেই সময় মহাভারতের ধর্মব্যাধের কাহিনি খুব জনপ্রিয় ছিল বঙ্গদেশে। সেই গল্পকে বলা হত কাগি-বগির গল্প, জানিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই গল্পে কাক-বককে ভস্ম করতে পারা ব্রহ্মচারী কৌশিক গিয়েছিলেন ধর্মব্যাধের কাছে, উপদেশের আশায়। ধর্মব্যাধ মহাভারতের যুগে আদর্শ পুরুষ। তিনি উপার্জন করেন, শাস্ত্রালোচনাও করেন, আবার সংসারের কর্তব্যও করেন নিখুঁত মহিমায়। সেই ধর্মব্যাধ জানিয়েছিলেন ব্রহ্মচারী কৌশিককে, "আমি বিধাতার বিহিত ধর্ম পালন করি, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করি, সত্য বলি, অসূয়া করি না, যথাশক্তি দান করি, দেবতা অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন খাই। আমি নিজে প্রাণিবধ করি না, অন্যে যে বরাহ-মহিষ মারে আমি তাই বেচি। আমি মাংস খাই না কেবল ঋতুকালে ভার্যার সহবাস করি, দিনে উপবাসী থেকে রাত্রে ভোজন করি।" সন্দেহ নেই, নিখুঁত কর্মযোগী মানুষ তিনি। তাঁর কর্মময়তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কর্মময়তার আদর্শ তুলনীয়। বিশেষ করে যথাশক্তি দান।

তবু একথার মাঝে কিন্তু থেকে যায়। দানবীর, কর্মবীর মানুষটিকে কি প্রেমিক বলা চলে কোনওভাবে? প্রাণীবধের ঈপ্সাহীন, নিরামিষভোজী মানুষটি কেবল ‘ঋতুকালে ভার্যার সঙ্গে সহবাস’ করেন। তাঁর রতিক্রিয়া উৎপাদনশীল এবং ঋতুময়ী নারীটির বাসনা-অভিভূত দেহযন্ত্রর কাছে আরামপ্রদ। আরামকে কি প্রেম বলে? না কি তা দয়াবৃত্তির, সকলের কাজে লাগে, উপকারে লাগে এমন ক্রিয়ার, প্রকাশমাত্র? ব্যাধ কি তাঁর শরীর-মনের তীব্র বাসনা, যাকে বিশেষ প্রকাশে ভালবাসা বলে, তার ওপরে কর্মের আদর্শ-পাথর চাপিয়ে আবেগটিকে কল্যাণময় করে তুললেন?

বিদ্যাসাগরের স্ত্রী দীনময়ী দেবীকে স্মরণে রেখে একটি নাটক লিখেছিলেন বনফুল। সেই নাটকে ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে, স্বামী বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে, দীনময়ীর না-পাওয়াগুলির কথা উচ্চারিত। কত আর সঙ্গ পেয়েছেন দীনময়ী বিদ্যাসাগরের! সঙ্গের কথা থাক, বিদ্যাসাগর যেভাবে নারীশিক্ষার আলোয় ও মুক্তিতে মেয়েদের সামনে খুলে দিয়েছেন পথ, সেই পথ কি কেটেছেন দীনময়ীর জন্য?

বিদ্যাসাগরের হৃদয় বৃহৎ ও সামাজিক। কত মেয়েকে আশ্চর্য মায়ায়, করুণায়, স্নেহে বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। যাকে প্রেম বলে, সেই তীব্র প্রেমের কাছে সঁপে দিতে না পারলেও মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক-পারিবারিক জীবনে স্থিতি দিতে পেরেছিলেন অনেককে। কিন্তু দীনময়ী, বিদ্যাসাগর-পত্নী দীনময়ী, কি শুধু এইটুকুই, বিদ্যাসাগর-পত্নীর পরিচয়টুকুই চেয়েছিলেন? মধুসূদন পৌরাণিক ও মহাকাব্যের নারীদের না-পাওয়া প্রেমের বিরহকথার স্পষ্টতায় সাজিয়েছিলেন তাঁর 'বীরাঙ্গনা' কাব্য। যে নারীরা সমাজ-সংসারে এই না-পাওয়ার বেদনায় ক্ষীণ, যদি লিখতেন তাঁদের কথা, যদি রবীন্দ্রনাথের মতো দীর্ঘজীবনের অধিকারী হতেন, তাহলে কি ‘বিদ্যাসাগরের প্রতি দীনময়ী’ নামে কোনও পত্রকাব্য লিখতেন তিনি?

ঝরনার মুখে পাথর চাপিয়ে সেই জলধারা মাটির ওপরে স্তিমিত বিস্তারে ছড়িয়ে দিলে যে কল্যাণময় উর্বরতা শস্য-শ্যামল করে চারপাশ, তাকে অস্বীকার করতে পারে না মানুষ। করা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগরের করুণার সজীব, সামাজিক প্রকাশ বঙ্গীয় সমাজের অশেষ উপকার করেছে। তবে সেই মাঙ্গলিক নিয়তি মেনে নিলে না-পাওয়ার বেদনা কীভাবে যাপন করে মানুষ, তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। দীনময়ী না-পাওয়াকে যাপন করেছিলেন বেদনায়, বিষাদে। কী-ই বা করবেন! বিকল্প পথ কী-ই বা ছিল তাঁর! আর বিদ্যাসাগর! শেষ জীবন কাটছে তাঁর সাঁওতালদের মধ্যে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন তাঁর স্মৃতিকথনে, এই মানুষগুলি বিদ্যাসাগরকে ঘিরে থাকেন, আবদার করেন। বিদ্যাসাগর, একা হয়ে যাওয়া বিদ্যাসাগর, তাঁদের ওষুধ দেন, খেতে দেন। বিদ্যাসাগরকে তাঁরা তুই-তোকারি করেন।

ভালবাসার ঝরনাতলায় কে যে কোন পথ বেছে নেয়! কেন যে নেয়! পাথর না-চাপালে সেই ধারা কীভাবে যেতে পারত, পাথর চাপালে কীভাবে যায়, সেকথা ভাবতে ভাবতে মনে হয় দয়া ভাল, করুণা ভাল, কিন্তু যাকে বলে অবুঝ রক্তমাংসের তীব্র প্রেম, তার দীর্ঘশ্বাস দয়াময় মানুষ-মানুষীর আধারে লেগে থাকে।

দয়াকে, করুণাকে কি প্রেম বলে! বলে না বোধহয়, আবার হয়তো বলা যায়।

More Articles