রয়্যালটি, যশ|| লিখে যতদূর যেতে চান কবি
Bengali Poetry: পুরস্কারের হাতছানি সামনে রেখে কবিতা লেখা তো দূরস্থান, প্রকাশিতব্য বইয়ের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির কাজও চালানো যায় বলে মনে হয় না।
পুরস্কার ব্যাপারটা নিরপেক্ষ না পক্ষপাতদুষ্ট, সেই চিরাচরিত বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায়— খুব গোদা অর্থেই যদি ধরি, তাহলে পুরস্কারের বৈশিষ্ট্য হলো, তা প্রাপক বা তাঁর অতি-ঘনিষ্ঠ বৃত্ত বড়জোর চিরকাল মনে রাখেন; আর যাঁরা দেন সেই পুরস্কার, তাঁদের ফাইলবন্দি নথিতে লেখা থাকে সে-কথা। এর বাইরে পুরস্কারের তালিকা স্মৃতিতে ধরে রাখেন কেবল জিকে-নিষ্ঠ মানুষজন, সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থীরা। বাকি দুনিয়া ভুলে যায়। বাংলা বাজার আর বিশ্ব বাজারে এই জায়গায় কোনও ফারাক নেই। পৃথিবীর তাবড় পুরস্কারগুলির ক্ষেত্রেও মোটের ওপরে একই ব্যাপার ঘটে। যে-কারণে, তিন-চার বছর আগে কে নোবেল কিংবা বুকার পেয়েছিলেন, তা জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশেরই মেমরি লোকাল লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। অথচ ১৯১৩ সালে যে রবীন্দ্রনাথ এই পুরস্কার পান, তা স্মরণে আনতে অন্তত একটা বড়-সংখ্যক বাঙালির বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। এর কারণ দুটো হতে পারে; হয় তাঁকে বা তাঁর সৃষ্টিকে আমাদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তেরই অংশ মনে করি অথবা ইশকুলবেলা থেকে সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে এই তথ্য পড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন কবিতা লেখে? কেন ছবি আঁকে? বরাত পেয়েই হোক বা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে, এর প্রাথমিক ও প্রধান কারণ, অন্তরের তাড়না। না লিখে, না এঁকে সে পারে না বলেই, সেই কাজে মেতে ওঠে। ভাবনার স্তরে, লিখনভঙ্গির পদ্ধতিতে প্রতিটি মানুষ আলাদা হলেও, ভিতরের ছটফটানির বিষয়ে তারা অভিন্ন। যতক্ষণ-না তার অন্তর্জগতের ভাবনাকে সে কাঙ্ক্ষিত অবয়ব দিয়ে বহির্জগতের অংশ করে তুলতে পারছে, ততক্ষণ তার মুক্তি নেই। সুতীব্র যৌন সুখের মতো এক আলোড়ক অনুভূতি ছাড়া সৃষ্টির ওই চূড়ান্ত মুহূর্তে আর কিছুই কাজ করে না— না লভ্যাংশের পাটিগণিত, না সম্মাননার আকাঙ্ক্ষা, না পুরস্কারের সমীকরণ।
রয়্যালটি আর অ্যাওয়ার্ড। অর্থমূল্য। কবি কি তাহলে এসবের থেকে দূরেই থাকবেন? পার্থিব জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য মিটিয়ে নেবেন শুধুই সৃষ্টিশীলতার অপার্থিব আনন্দে? কারও ব্যক্তিগত নির্বাচন হতেই পারে এই জীবন; কিন্তু স্রেফ কবিতা লিখেই কেউ যদি পন্টিয়াক গাড়ি চড়তে চান, অন্তত সেই চাওয়াটুকুর জন্য তাঁকে দোষারোপ করা চলে না। বিচার হতে পারে তাঁর কাজের গুণমানের নিরিখে। আবার, রয়্যালটি ও পুরস্কার— এই দুই প্রাপ্যের মধ্যেও রয়েছে মৌলিক ফারাক। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষত বইপত্রের জগতের নানা ক্ষেত্রে প্রায়শ কয়েকটি কথা শুনতে পাওয়া যায়— ‘লোকটির কাজ ভালো, কিন্তু বড্ড প্রফেশনাল’ কিংবা ‘এই কাজের জন্য ন্যূনতম পারিশ্রমিকও আমি নিইনি’ অথবা ‘অমুক তো এই দিয়ে ব্যবসা করতে চায়’। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ব্যত্যয় অবশ্যই হতে পারে, কিন্তু এই যে পারিশ্রমিক না নেওয়াকে মহৎ প্রতিপন্ন করা আর সৎ-অসৎ বিচার না করে একধারসে পেশাদারিত্ব কিংবা ব্যাবসার প্রয়াসকে খাটো করে দেখার প্রবণতা— চূড়ান্ত অপেশাদার না হলে কোনও গোষ্ঠী বা জাতির সাধারণ বয়ান এই কথা হতে পারে না।
আরও পড়ুন: সংরক্ষণ মানে অমরত্ব, কবে বুঝবে লিটল ম্যাগাজিন?
ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়। সে বই ছাপায় ও তা বিক্রির আশা করে না। এবং বিক্রির আশা করে না, তৎসত্ত্বেও বই ছাপায়! সাম্প্রতিক ‘পিওডি’ জমানার পঞ্চাশ কপি প্রিন্ট রানের স্বর্ণযুগে আমাদের এই প্রবণতা গ্রন্থের মতো ‘ভারী’ বস্তুটিকে প্রায় ‘খেলনা’ করে তুলেছে। অথচ পেশাদারিত্ব বিষয়টিকে সদর্থে গ্রহণ করতে পারলে অতিপ্রজ অবস্থান ছেড়ে হয়তো আমরা অনেক দিনই বেরিয়ে আসতে পারতাম। এত এত ছাপা পাতায় বাজার গিজগিজ করত না। এবং ভালো বই হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমত। বিক্রি বাড়ত। মাগনার সৌজন্য কপিও বিলোতে হত না। সবচেয়ে বড়ো কথা, পরিশ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক চাইতে লেখকেরও কোনো কুণ্ঠা কাজ করত না। বস্তুত, চাওয়ার প্রসঙ্গই আসত না, এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ হয়ে উঠতে পারত। তা হতে পারেনি, বিশেষত কবিতার বইপত্রের ক্ষেত্রে তো বটেই। অবশ্য তার নেপথ্যে প্রকরণগত কারণে জনসাধারণের কাছে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা কম হওয়ারও একটা দিক রয়েছে। আরও নানা কারণ থাকতে পারে; তবু এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে লেখার বিনিময়ে একজন লেখক বা কবির যে-রয়্যালটি পাওয়ার কথা, তা যত সামান্যই হোক-না-কেন, তা তাঁর হিসেবের ভিতরে থাকা প্রাপ্যই। কিন্তু কোনও লেখক, শিল্পী বা স্রষ্টার কাছে পুরস্কার হল হিসেবের অতিরিক্ত পাওয়া। পুরস্কারের হাতছানি সামনে রেখে কবিতা লেখা তো দূরস্থান, প্রকাশিতব্য বইয়ের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির কাজও চালানো যায় বলে মনে হয় না।
তবে সবকিছুর পর কেউ যদি নির্বাচিত হন কোনও পুরস্কার বা সম্মাননার জন্য, তা গ্রহণ করা-না-করা সম্পূর্ণত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনকী, পুরস্কারের খবরে কবি নির্বিকারচিত্ত থাকবেন, না কি উৎফুল্ল হবেন, তা নিয়েও কিছু বলা চলে না। এ-ও বিবেচনায় রাখা দরকার, অর্থমূল্য অত্যন্ত জরুরি ঠিকই, কিন্তু ক্ষেত্র-বিশেষে আন্তরিকতা ও প্রয়াসের গুরুত্ব এই নগদ অর্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কাউকে অধিকতর সম্মানিতও করতে পারে। অথচ সমস্যা হয়, যখন সেই প্রাপ্য সম্মানের বিচার না করেই আলোকিত মঞ্চ আর ঠুনকো পদকের মোহে আমরা লোলুপ হয়ে পড়ি। এমনকী ইদানীং এও তো শুনি, নিজেই নিজেকে পুরস্কৃত করার জন্যও নাকি গোপন আয়োজনের ঘুঁটি সাজানো হয়! দিনান্তে কী যে মেলে এইসবে, তা সে-পথের পথিকেরাই সম্যক বলতে পারবেন।
শুরুতে যে-প্রশ্নের কাছে গিয়েছিলাম, শেষে পুনরায় সেই দিকেই ফিরে আসি। কবিতা লিখে কবি কী পেতে চান? শুধুই কি অন্তরের তাড়না থেকে পরিতৃপ্তি? স্রেফ কিছু রয়্যালটি? না কি গোপন মনোবাসনায় যশ, খ্যাতি, মোটা অঙ্ক? না। সব শেষে কবির চাহিদা থাকে আসলে একটিই—তাঁর সৃষ্টির অমরত্ব। থেকে যাওয়া। কালোত্তীর্ণ হওয়া। কেউ কেউ শুধু কালি-কলমেই সে-কাজ সেরে ফেলতে পারেন। সকলে নয়। অথচ অমরত্বের প্রত্যাশা বেঁচে থাকে জিয়ল মাছের মতো। ছায়াঘন সেই আশা আর চরম অসহায়তার যুগলবন্দি থেকেই তখন জন্ম নেয় বিবিধ বাজারি ধুমচুম, হইহল্লা— যেনতেন টিকে থাকার কর্মসূচি। অথচ কবিতার সঙ্গে সেসবের সংযোগ কতটুকুই-বা! কবির জীবনধারণের জন্যও যেমন পুরস্কার বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির হয়তো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার সঙ্গে কাজের মহত্ত্বের বা কালোত্তীর্ণ হতে পারার কোনও সম্পর্ক নেই। অমরত্বের তো নেই-ই।