কায়েত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠে গোঁড়া হিন্দুদের আপত্তি, তবু অমর হয়ে রইলেন বীরেন ভদ্র
Mahisashuramardini: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অব্রাহ্মণ, তিনি করবেন স্তোত্রপাঠ! আপত্তি তুলল হিন্দুরা, তারপর?
আশ্বিনের শারদপ্রাতে
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা।
আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।
বাঙালির ঘরে ঘরে একটা পুরনো রেডিও ধুলো ঝেড়ে তৈরি হয়েছে আকাশবাণীর 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনার জন্য। সামনে হয়তো ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ। শরৎ এসেছে পুরোদমে। মনটা ফুরফুরে। বাঙালি ঘরে ঘরে আন্দোলিত হলো এক কণ্ঠের জাদুতে। যাঁর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালির অবহেলিত কিংবদন্তি। আকাশবাণী-র প্রবেশদ্বারে এই 'রেডিও পুরুষ'-কেও আটকেছিল দারোয়ান। অব্রাহ্মণ বলে তাঁর চণ্ডীপাঠ নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছিল ব্রাহ্মণ সমাজ। কায়স্থর ছেলে মহালয়ার অনুষ্ঠানে মন্ত্র পড়বে- উচ্চবর্ণর হিন্দুদের অনেকেই সেটা মানতে পারেননি। কিন্তু রেডিওতে 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র সম্প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বদলে গেল, সেই অনুষ্ঠান এমনই জনপ্রিয়তা পেল যে, বাঙালি তার মহানায়ককেও ছুড়ে ফেলেছিল অবলীলায়!
বাঙালির মহালয়া মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ। কিন্তু একসময় গোঁড়া রক্ষণশীল ব্রাহ্মণসমাজ এর বিরোধিতা করে বলেছিল, "পুণ্য মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনা মহাপাপ!" রবীন্দ্রনাথ, বিধান রায়ের মৃত্যু থেকে ক্রিকেট-ফুটবল এমনকী, দুর্গাপুজোর বিসর্জনের প্রথম ধারাবিবরণীর সূত্রপাত তাঁর হাত ধরেই। কিংবদন্তি এই 'রেডিও পুরুষ' কিন্তু অপমানিত হয়েছেন নিজের রেডিও স্টেশনেই। তবু তাঁর চণ্ডীপাঠ কালজয়ী হয়ে থেকেছে। আজ রেডিও-র মহিষাসুরমর্দিনীর নামের সঙ্গে যে নাম ওতপ্রোতভাবে উচ্চারিত হয়, তা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
পরিষ্কার, ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা উড়নি, চোখে চশমা। হাতে খুব ছোট একটা থলে, পাঞ্জাবির দু’পকেটে দু’রকমের রুমাল— একটি নস্যিরঞ্জিত এবং আর একটি পরিষ্কার- এই ছিলেন বাঙালির বেতারপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
মহালয়ায় আকাশবাণী 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে এসেছে। আগে তা সম্প্রচারিত হতো ষষ্ঠীর দিন। এই কারণে বাঙালি মনে করে আসছে, মহালয়া মানেই দুর্গাপুজোর সূচনা। রেডিও অন করলে যখন শোনা যাচ্ছে, 'বাজল তোমার আলোর বেণু...', তখন বাঙালি মনও আগমনীর সুরে আন্দোলিত। উমাকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায় এইদিনই। যদিও মহালয়া একটা তিথি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিতৃতর্পণ। প্রত্যক্ষভাবে যোগ নেই দুর্গাপুজো শুরুর। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-র জনপ্রিয়তার কারণেই বেতারের অনুষ্ঠানকে অনেকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। আর অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
আরও পড়ুন- নেই দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক, মহালয়াতেই কেন তবে পিতৃতর্পণের ঢল
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর যে ধরনের চণ্ডীপাঠ আমরা এখন শুনি, প্রথমদিকে কিন্তু উনি ওইভাবে উচ্চারণ করতেন না। পুরো দলটিকে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ। এই অনুষ্ঠানটি আবার ষষ্ঠীর সকালে ফিরে এসেছিল ১৯৩৬ সালে। নাম ছিল ‘মহিষাসুর বধ’। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় যেমন হয়েছিল, তেমনই এটিকে ঘিরে বিতর্কের তুফান তুলেছিল তৎকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ। তারা বলেছিল, পুণ্য মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বি.এ পাশ করার পর বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে যোগ দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে-র ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিন বিরতি কিংবা বিকেলে একটু অবসর পেলেই বীরেন পৌঁছে যেতেন রেডিও স্টেশনে। অল্প সময়েই আসর জমিয়ে দিতে পারতেন বীরেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নৃপেন মজুমদার তাঁকে রেডিওতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর, একদিন চাকরি ছেড়ে বীরেন যোগ দিলেন রেডিওতে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর ছিল একদম স্বতন্ত্র। গবেষকরা বলছেন, তার নেপথ্য কারণ ডিপথেরিয়া। সাহেব ডাক্তার বীরেনকে প্রাণে বাঁচালেও কণ্ঠস্বর ‘নষ্ট’ হয়ে যায় তাঁর। প্রথম জীবনে রেডিওতে যখন অডিশন দিতে গিয়েছিলেন, তখন এই ভাঙা কণ্ঠের জন্যই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শুনলে অবাক লাগতে পারে, ওই ‘অদ্ভুত’ গলার জন্যই রেডিও থেকে খোঁজ পড়েছিল তাঁর। একটি বেতার-নাটকে ‘রাক্ষস'-এর কন্ঠস্বর প্রয়োজন ছিল। প্রযোজকের কাউকে মনে ধরছিল না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেই অডিশনে পাশ হলেন। আর ‘রাক্ষস'-এর কণ্ঠ নিয়ে প্রবেশ করলেন বেতারকেন্দ্রে। বাকিটা ইতিহাস।
সেদিন আকাশবাণী কলকাতার অফিসে হিন্দু সমাজের নেতারা হাজির হয়েছেন, পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে দেখা করবেন, বিরাট অভিযোগ নিয়ে এসেছেন তাঁরা। অফিসের আনাচকানাচে ফিসফাস চলছে। পঙ্কজবাবু তখন রেকর্ডিং রুমে, সেখান থেকে ডেকে আনা হলো তাঁকে। অভিযোগ পেশ করা হলো- কায়স্থর ছেলেকে দিয়ে চণ্ডীপাঠের আসর বন্ধ করতে হবে। এতে নাকি দেবীর অপমান, হিন্দু ধর্মের অপমান হয়। নেতাদের দাবি একটাই, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে বাদ দিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করানো হোক। তাহলেই আর কোনও ঝামেলা থাকবে না।
পঙ্কজ মল্লিক কঠিন মানুষ, এমন আবদারে তাঁর রাজি হওয়ার প্রশ্নই আসে না, হলেনও না। বরং হিন্দু সমাজের নেতাদের পাল্টা হুমকি দিলেন তিনি, মহালয়ার অনুষ্ঠানে মন্ত্রপাঠ যদি কেউ করে থাকে, সেটা বীরেনই করবে। সেইসঙ্গে এটাও বলে দিলেন- "আমাকে বাদ দিয়ে মহালয়া হলেও হতে পারে, কিন্ত বীরেনকে বাদ দিয়ে 'মহিষাসুরমর্দিনী' চালানো অসম্ভব!" পঙ্কজ মল্লিক সেদিন হয়তো জানতেন না, উত্তেজনার বশে বলে ফেলা তাঁর এই কথাটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রমাণ করে দেবে সাড়ে চার দশক পরেও, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সামনে ম্লান হয়ে যাবেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় এবং জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর একটি- উত্তমকুমারও!
সাল ১৯৩১, কলকাতা। সে-বছর অন্নপূর্ণা এবং বাসন্তী পুজো একদম গায়ে-গায়ে পড়েছিল। এই দুই পুজোর মাঝখানে রেডিওতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। নাম দেওয়া হয় 'দেবী বসন্তেশ্বরী'। অনুষ্ঠানটির নেতৃত্বে ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, হরিশচন্দ্র বালি- এঁরা সবাই। সম্প্রচারের পর অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল অনুষ্ঠানটি। বাঙালির মনে এতটাই জায়গা করে নেয় এই অনুষ্ঠান যে, উৎসাহিত হয়ে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, পরের বছরেই এটি চণ্ডীপাঠ হিসেবে অনুষ্ঠিত হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পরের বছর দুর্গাপুজোর বেশ খানিকটা আগেই শুরু হলো রিহার্সাল। তখনও হিন্দু সমাজের বিরোধের ঘনঘটা চলছে। রেডিওতে টুকটাক নাটক করা বীরেন ভদ্র জাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তাঁকে আটকাতে হিন্দু সমাজের নেতারা অনেক কাঠখড় পোড়ান। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, যাঁকে সমাদর করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তিনি তো এসব পাতি নেতাদের হুমকিতে দমে যাওয়ার লোক নন। কাজেই ব্যর্থমনোরথ ফিরে যেতে বাধ্য হলেন হিন্দুত্বের ঢাক-ঢোল পেটানো নেতারা, স্নান সেরে গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। লেখা হলো ইতিহাস।
১৯৩২, মহালয়ার দিন ভোররাত, আঁধারের চাদর তখনও সরেনি, শহর কলকাতায় শীতের আমেজ চলে এসেছে অবশ্য। এমনই সময়ে রেডিওতে শোনা গেল বীরেন ভদ্রর গমগমে গলা, ভেসে এল ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির...'
বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, অমন হৃদয় নিংড়ানো আওয়াজে চণ্ডীপাঠ করলেন কে? কেউ ভুলেও জানতে চাননি, যিনি মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, তিনি ব্রাহ্মণ সন্তান না কি কায়েতের ছেলে! সেদিন জিতে গিয়েছিল পঙ্কজ মল্লিকের জেদ। ভাগ্যিস! সবার অলক্ষ্যে কেউ একজন সেদিন নিজের হাতে লিখেছিলেন এক নতুন ইতিহাস। আপামর বাঙালির ভালবাসায় কালজয়ী হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠে 'মহিষাসুরমর্দিনী'। মহালয়ার ভোর হয়েছিল কায়েতের ছেলের চণ্ডীপাঠে। এরপর থেকে মহিষাসুরমর্দিনী যেন বাঙালীর পুজোর অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে, পুজোর সব উপকরণের মতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহালয়ার শুরুটাও হওয়া চাই- নইলে পুজোর মহিমাটা কোথাও যেন হারিয়ে যায়!
আরও পড়ুন- কোথাও গরু, কোথাও করোটি! পূর্বজদের উদ্দেশ্যে বিচিত্র তর্পণের রেওয়াজ রয়েছে বিদেশেও
পালাবদলের হাওয়া লাগল ১৯৭৬ সালে। জরুরি অবস্থা চলছে তখন দেশজুড়ে। দিল্লিতে বসে আকাশবাণীর কর্তারা ঠিক করলেন, মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হবে। তার পরিবর্তে মহালয়ায় হবে নতুন অনুষ্ঠান, নতুন সংগীতায়োজনে, স্টার কোনও ভয়েস নিয়ে। বাঙালির কাছে তখন সবচেয়ে বড় স্টার উত্তমকুমার, তাঁকে রাজি করানো হলো। উত্তম রাজি ছিলেন না শুরুতে, কারণ দিনের শেষে তিনিও তো বাঙালি, মহিষাসুরমর্দিনীর আবেদনটা তিনিও বোঝেন। তিনি ছুটে গেলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে, বীরেনবাবু সাহস দিলেন তাঁকে, রাজি হয়ে রিহার্সাল শুরু করলেন উত্তমকুমার।
ফলাও করে প্রচার চালানো হলো, মহালয়ার সকালে নতুন অনুষ্ঠান আসছে, উত্তমকুমার কণ্ঠ দেবেন তাতে, অনুষ্ঠানের নাম 'দেবী দুর্গতিহারিনী'। সবার মধ্যে আগ্রহও তৈরি হলো। উনিশশো ছিয়াত্তরের মহালয়ার সকালে বাঙালির ঘুম ভাঙল মহানায়কের কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ শুনে। তারপর যা হলো, সেটা উত্তমের কেরিয়ারের দুঃস্বপ্ন। দিকে দিকে সমালোচনা আর প্রতিবাদের ঝড় উঠল, আকাশবাণীর অফিসে চিঠির মেলা বসল, শত শত লোক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শাপশাপান্ত করতে থাকল আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষকে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা আগের রেকর্ড করা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠে মহালয়া চালাতে বাধ্য হলো আবার।
আকাশবাণী, মহালয়া, মহিষাসুরমর্দিনী আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র- সমার্থক হয়ে থাকল কাল উত্তীর্ণ করে। আজও মহালয়ার সকাল, কাশফুলের মাথা দোলানো, আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের চলাচল আর আকাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর, যেন একাকার হয়ে ঘোষণা করে আগমনী বার্তা-
বিশ্বপ্রকৃতি মহাদেবী দুর্গার চরণে চিরন্তনী ভৈরব ধ্যানরতা পূজারিণী ভৈরবীতে গীতাঞ্জলী প্রদান করে ধন্যা হলেন।
তাঁর গীতবাণী আজ অনিলে সুনীলে নবীন জননোদয়ে দিকে দিকে সঞ্চারিত।