যে যে কারণে এবার ভারতের হার ছিল অনিবার্য

T20 World Cup: নকআউট ম্যাচে ব্যক্তিগত দক্ষতার শীর্ষে কেউ উঠতে না পারলে ভারতের জেতা কঠিন ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে- এই হার যন্ত্রণার হলেও ঘোরতর ক্রিকেটীয়।

রিডিকিউলাস। বিরক্তিকর। অসহ্য। একঘেয়ে। নিউজপেপার আর সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বোলাতেই এতগুলো বিশেষণ একত্রে মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ভারতের হারের পর বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার ভক্তদের পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, বাণিজ্যিক মিডিয়ার ভারতের হারের কারণ অনুসন্ধানে কোচ-ক্যাপ্টেনকে ক্রমাগত কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অবধি তাও মেনে নেওয়া যাচ্ছিল, গতকাল দেখলাম একটি বহুল-জনপ্রিয় সংবাদ সংস্থা, তাঁদের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রাইম টাইমে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের আসন্ন ফলাফল নিয়ে একটি শো করেছিল যেখানে খেলোয়াড়দের জন্মকুণ্ডলী বিচার করে, শাঁখ বাজিয়ে, বলে দেওয়া হয়েছিল যে ভারত জিতবে সেমিফাইনাল, এমনকী, ভারতের হারের পর আরও কিছু সংবাদ সংস্থা মুখরোচক খবরের আশায় সংখ্যাতত্ত্ব খাটিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন ভারতের হারের কারণ এবং কী করলে ভারত সাফল্য পেতে পারে। হায় রে দেশ!

এদেশের গড় জনতা এখনও বিশ্বাস করে না, ভারত এই ম্যাচ পারতপক্ষে জিততে পারত না, এমনকী, সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া কিংবা পাকিস্তানের মুখোমুখি হতে হলেও হারই ছিল নিয়তি। বিরাট কোহলির মতো ক্রিকেটীয় জিনিয়াস একার দক্ষতায় দলকে টেনে তুলতে পারেন, কিন্তু দলগত খেলায় ট্রফি জিততে গেলে যে টিম গেম দরকার, ভারত তা খেলতেই পারেনি। এই সমস্যা একটি টুর্নামেন্টের না, প্রায় এক দশকের।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। সেমিফাইনালে ভারত দলে নিল ঋষভ পন্থকে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বর্তমানে বাঁহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটারদের বাড়বাড়ন্তের কারণ নিঃসন্দেহে স্পিনারদের আক্রমণ করার ক্ষমতা। পাঁচ জন বোলারের মধ্যে অধিকাংশ দলেই এক কিংবা দু’জন স্পিনার থাকে প্রতিপক্ষে। ফলে কুড়ি ওভারের মধ্যে চার থেকে আটওভার বোলিং-এর দায়িত্ব থাকে স্পিনারের ওপর। এই অংশটিকে বলা যেতে পারে চান্স টেকিং অন বোথ সাইড। ব্যাটিং টিম যেমন চাইবে এই চার ওভারে সর্বোচ্চ রান তুলে নিতে, তেমনি বোলিং টিম চাইবে স্পিনারের ওভারে ব্যাটারের রিস্ক টেকিং-কে কাজে লাগিয়ে উইকেট তুলতে। একজন রিস্ট-স্পিনারের (লেগি) ইন্টালিজেন্সের পরীক্ষা হয় এই চার ওভারে। যেখানে অন্যতম সফল বোলার আদিল রশিদ।

আরও পড়ুন: সারাবছর পড়ে পরীক্ষায় ফেল! এই প্রথম নয়, বারবার যেভাবে তীরে এসে তরী ডুবেছে ভারতের

ফিরি ভারতের প্রসঙ্গে। ঋষভ ব্যাট করতে এলেন সেমিফাইনালে, যখন স্পিনারদের ওভার শেষ। ভারতীয় থিংক ট্যাঙ্কের দিকে যে প্রশ্নটি সবার আগে ধেয়ে আসে, তা হলো, স্পিন হিটার হিসেবে নেওয়া ঋষভ কেন এত পরে এলেন ব্যাটিং অর্ডারে? এই প্রশ্নের উত্তরেই কার্যত বেআব্রু হয়ে যায় ভারতীয় ক্রিকেটের কঙ্কাল। এর উত্তর একেবারে সোজাসাপটা। ঋষভ যদি হার্দিকের জায়গায় ব্যাটে নামতেন তাহলে ইংল্যান্ড লিভিংস্টোনকে বলে আনতই না, নিয়ে আসত জর্ডনকে। সেক্ষেত্রে স্লগ ওভারে লিভিংস্টোনের সামনে আসতেন অক্সর প্যাটেল বা হার্দিক, যিনি এই ম্যাচে স্পিনারের বিরুদ্ধে ১০ বল খেলে ৭ রান তুলেছেন। ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডারে যেহেতু স্পিনারদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল ব্যাটার সূর্যকুমার। বিরাট এশিয়া কাপে আফগানিস্তান ম্যাচ থেকে স্পিনের বিপক্ষে আগ্রাসী হয়েছেন, কিন্তু নিজের সেরা ব্যাটিং-এ তিনি কখনওই রিস্ট স্পিনারের বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দ নন। তাই ইংরেজদের নাগপাশ থেকে বেরোনোর একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র ছিলেন সূর্য, তাঁর মিসহিটেই ম্যাচ কার্যত বেরিয়ে গেল ভারতের হাত থেকে।

এই সম্ভাবনাতত্ত্ব ও ক্রিকেটীয় অঙ্ক থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার। ইংল্যান্ড প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ কিস্তিমাৎ করার জন্য যে মঞ্চ নির্মাণ করেছে, তা একদিনের পরিকল্পনা নয়। ভারত তা পারেনি। অনেকেই বলছেন ভারতের ওপেনিং জুটির ব্যর্থতা এই বিশ্বকাপে পরাজয়ের একমাত্র কারণ। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি তথ্য দিই। ইংল্যান্ড দলের আট-নয়-দশ নম্বর ব্যাটিং অর্ডারে ব্যাটে আসেন স্যাম কুরান-ক্রিস ওকস এবং জর্ডন যাঁদের দু’জন বোলিং অলরাউন্ডার এবং একজন হার্ড হিটার, ভারতের ছয় কিংবা সাত নম্বরেই চলে আসেন অশ্বিন কিংবা অক্সর প্যাটেল- এই যে ব্যাটিং অর্ডারের গভীরতার আকাশ-পাতাল তফাৎ- এখানেই লুকিয়ে পাওয়ার প্লে-তে খেলার গতির রহস্য। ইংল্যান্ডের বাটলার-হেলস যে সেফটি কুশনটি পান, তা রোহিত-রাহুল পান না; তাঁদের দু'জনের অফ ফর্মের কথা মাথায় রেখেও একথা সহজেই অনুমেয় যে, তাঁদের ফর্ম তুঙ্গে থাকলেও ভারত ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো অতি-আগ্রাসী মানসিকতা দেখাতে পারত না পাওয়ার প্লে-তে; তাই ভারতের ব্যাটিং স্ট্র্যাটেজি টপ হেভি নয়, বটম হেভি- অর্থাৎ উইকেট বাঁচিয়ে হার্ড হিটারদের দেরিতে ক্রিজে আনো নীতি নিয়েই ভারতকে খেলতে হয়!

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ইচ্ছেমতো প্লেয়ার কেনার সুযোগ থাকে, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে একটি দেশের হাতে থাকা খেলোয়াড়দের দক্ষতার ওপর ভর করে দল গড়তে হয়। ভারতের লক্ষ্য ছিল লোয়ার অর্ডারে রানের গতি বাড়ানো, আর এই কাজে কিন্তু তাঁরা সফল। সমীক্ষা বলছে, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলির মধ্যে ১৫-২০ ওভারে ভারতের রানের গতি সর্বোচ্চ। যেহেতু ব্যাটিং গভীরতার অভাব তাই পাওয়ার প্লে-তে উইকেট বাঁচানো ভারতের জন্য জরুরি। ইংলিশ দুই ওপেনারের ব্যাটিং যদি খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করা যায়, এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়, যে ভারতের বোলিং কোনওভাবেই সাদামাটা ছিল না, যে বলে হেলস বা বাটলার ফ্রন্টফুট মুভমেন্ট করেছেন এবং শট খেলেছেন তা অতি-আগ্রাসী। যেখানে উইকেট পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

শাঁখ বাজানো, জন্মকুণ্ডলী বিচার, ম্যাচের আগে পুজো দেয়া, ম্যাচশেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় অকথ্য গালিগালাজ- সময় কাল ভেদে এদের বিবর্তন হলেও উপমহাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে যে ব্যক্তিগত পাওয়া-না পাওয়ার অঙ্ক জড়িয়ে থাকে তা কোথাও গিয়ে আবেগের কাছে আশ্রয় চায়, যুক্তির কঠিন কোলে ফিরতে চায় না মন। মহেন্দ্র সিং ধোনির অবসরের পর আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত বারে বারে নকআউট থেকে ফিরে এসেছে। কাঙ্খিত ট্রফি হাতে আসেনি। একথা সত্য। বহুল চর্চিত।। কিন্তু এই সত্যের এক আড়াল রয়েছে যা অনালোচিত। মহেন্দ্র সিং ধোনির হোয়াইট বল ক্রিকেট কেরিয়ারে ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ সালে পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ এবং ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি রয়েছে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন ২০১৩ সালের পর মাহি এদেশের ক্রিকেট মানচিত্রে অধিনায়ক হিসেবে জোরালো বিচরণ করেছেন আরও চারবছর, সেই চারবছরে ২০১৪ ও ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৫ সালের ওডিআই বিশ্বকাপ রয়েছে যেখানে ভারত ট্রফি জিততে পারেনি। বিরাট কোহলির অধিনায়কত্বকে মাহির ট্রফিজয়ের চালচিত্রের সামনে বসিয়ে যে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয় তা কিছুটা অযৌক্তিক, অযৌক্তিক এ কারণে যে ২০১৩ সালের পর থেকে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ সাদাবলের ক্রিকেটের ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রাখার জন্য যে আধুনিকতম প্রসেস শুরু করেছিল ভারত তা করেনি।

গৌরব সুন্দরারামনের নাম অনেকে জানেন। ইএসপিএন-এর মতো বিশ্ববন্দিত স্পোর্টস সংস্থার একজন ডাটা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন সুন্দররামন। স্পোর্টস ডেটা ইঞ্জিনিয়ারের কাজ কী? একটি ম্যাচে, প্রতিটি বলের ডিটেইলস ডিজিটালি নোট করা। যেমন বলের গতি, বলের গড় বাউন্স, বলের সুইং এর পরিমাণ ইত্যাদি, সঙ্গে প্রত্যেক বলে কত রান উঠছে এবং সেই রান আসার খুঁটিনাটি। এরপর এই সমস্ত তথ্য একটি গ্রাফে ফেলে নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া যে একটি দলের ব্যাটিং লাইন আপের মূল সমস্যা কোথায়। এর ফল মেলে হাতে নাতে, ২০১৬ সালে তৎকালীন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ফিল সিমন্সের ডাটার সাহায্য নেয়ার জন্য তাঁকে বিপুল অর্থ খরচ করে দলের ডেটা এনালিস্ট হিসেবে ব্যবহার করেন; নিখুঁত গবেষণা করে তিনি বলে দিতে পেরেছিলেন প্রতিপক্ষের দূর্বলতা, যেমন কোন দল গড়ে কতগুলি সিঙ্গেলস নেয় এবং কতগুলি গড় বাউন্ডারি মারে একটি লিমিটেড ওভার ম্যাচে, সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী বোলিং করে কীভাবে প্রতিপক্ষের ডট বলের সংখ্যা বাড়ানো যায়, কোন লেংথে বল করলে গড় রানের চেয়ে কম রানে বাঁধা যায় ইত্যাদি। আর অদ্ভুতভাবে সেবছরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবছর বিশ্বকাপের আগে যেমন ডেভন কনওয়ে ও হ্যারিস রাউফ, আলেন ফিন-শাহিন শা আফ্রিদির মুখোমুখি সাক্ষাতে ব্যাটিং ও বোলিং ডেটা নিয়ে গবেষণা করে সুন্দররামণ বলে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের টপ অর্ডারের ব্যাটারদের বাঁ হাতি পেসারের বিরুদ্ধে ঠিক কোথায় দূর্বলতা- এই বিষয়টি কিন্তু খালি চোখে সহজে দৃশ্যমান নয়। কিন্তু ১০-৫০টি ম্যাচের ডেটা তুলে এনে গ্রাফে ফেললে স্পষ্ট হয়ে যায় সবটুকু। যেমন লেগস্পিনারদের ডেটা গবেষণা করে ই এস পি এন দেখিয়ে দিচ্ছে কেন আদিল রশিদ অন্যান্য লেগস্পিনারের চেয়ে বেশি কার্যকর, ওয়াহিন্দু হাসারাঙ্গা কিংবা যুজবেন্দ্র চাহালের বোলিং লেংথের সঙ্গে আদিলের বোলিং লেংথের তারতম্য ঠিক কোথায়। এই সমস্ত ডেটা এনালিস্টদের লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে চলেছে উইসডেন, ইএসপিএন, স্পোর্টসকিডার মতো সংস্থাগুলি।

২০১৩ সালের আগে অবধি ভারতের সাদাবলের ক্রিকেটে যে প্ল্যানিং ছিল তা ছিল সমসাময়িক, সঙ্গে ২০০৭ সালে আসা একাধিক তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটারের সেই ট্র্যাডিশনাল বা চিরাচরিত ছকের সঙ্গে মানিয়ে নেয়াই ছিল পরপর বড় টুর্নামেন্টে সাফল্যের কারণ। এরপর যত বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলি চালু হল, যত ডেটা এনালিসিস এল, ইয়ন মর্গানের ইংল্যান্ড, স্টিভ স্মিথের অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশ যত বেশি সাদা বলের ক্রিকেটে নিজেদের কোচিং টিমকে আধুনিক পদ্ধতিতে সজ্জিত করল, ততই বোর্ড রাজনীতি-অধিনায়ক বিতর্ক-দল নির্বাচনের মুখোরোচক কাহিনীতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলল ভারত। ২০১৪ সাল থেকে ভারত যে কটি আই সি সি টুর্নামেন্ট খেলেছে, তার নব্বইভাগেই কোনও না কোনও খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে তাঁরা নকআউট পর্যায় অবধি পৌঁছেছে, যেমন ২০১৫ সালে শিখর ধাওয়ান, ২০১৯ সালে রোহিত শর্মা, কিছুটা কুলদীপ-চাহাল এবং এই বছর বিরাট কোহলি!

তাই ইংল্যান্ড-পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারগুলি কোনও আকস্মিক বিপর্যয় নয়, প্রত্যেকবার সুসংহত দলের বিরুদ্ধে হেরেছে ভারত, নকআউট ম্যাচে ব্যক্তিগত দক্ষতার শীর্ষে কেউ উঠতে না পারলে ভারতের জেতা কঠিন ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে- এই হার যন্ত্রণার হলেও ঘোরতর ক্রিকেটীয়।

একটি ঘটনা, বহু-আলোচিত, ভারত তাঁদের মিডল অর্ডার ব্যাটিং গত ছয় বছরে একবারের জন্যেও সাজিয়ে উঠতে পারেনি।। কখনও অজিঙ্ক রাহানে, কখনও বিজয় শঙ্কর, কখনও বিরাট কোহলির অর্ডার বদল, হালফিলে কখনও ঋষভ পন্থকে, কখনও দীনেশ কার্তিককে কিংবা দীপক হুদাকে খেলানোর মতো পরীক্ষা বারে বারে করেই চলেছে ভারত। এর আগে ভারতীয় মেনস্ট্রিম মিডিয়ার বিষনজরে পড়েছিলেন তৎকালীন কোচ রবি শাস্ত্রী। তাঁর ক্রিকেটীয় বোধের বিশ্লেষণের চেয়েও জোরালো হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। এদেশের ক্রিকেটের জেন্টলম্যানহুডের পোস্টারবয় রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে এল বোর্ড কোচের আসনে। অথচ, সাদাবলের ক্রিকেটে এই মিডল অর্ডার নিয়ে নিরন্তর গবেষণা বদলাল না। আসলে এই সমস্যা কোচ-অধিনায়কে নয়, এ সমস্যার শিকড় লুকিয়ে আরও গভীরে। গত পাঁচ বছরে বড় মঞ্চে প্রতিটি সফল হোয়াইট বল ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ তাঁদের ব্যাটিং অর্ডার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুছিয়ে ফেলতে পেরেছে, তার কারণ তাঁরা একটি পদ্ধতি নির্বাচন করে সেই পদ্ধতির প্রয়োগের জন্য সাজিয়েছেন প্ল্যানিং, ভারত একজন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত রান সংগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাটসম্যান নির্বাচন করেছেন, কোনও প্ল্যানিং ছাড়াই। যে কারণে সেমিফাইনালে ঋষভ-হার্দিক-অক্সরের মতো তিনজন ব্যাটার-অলরাউন্ডারকে একসঙ্গে খেলাতে হয়, যে পরিকল্পনার কাউন্টার প্ল্যানিং বানাতে প্রতিপক্ষের কোনও সমস্যাই হয় না, যেমনটা হয়নি ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে, কিংবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।

আইপিএল-এর মতো মঞ্চকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করছেন স্টিভেন ফ্লেমিং, আন্দ্রু স্ট্রস, ম্যাথু হেডেন, ফিল সিমন্সের মতো কোচেরা। অথচ ভারতের জনতার ম্যাচ হারলেই ক্ষোভের আগুন আছড়ে পড়ছে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের ওপর। ভারতীয় খেলোয়াড়রা আই পি এলে পারফর্ম করছেন, দেশের হয়ে পারছেন না - এই খাড়া করা ফ্র্যাঞ্চাইজি বনাম দেশ তত্বটি কি আদৌ যুক্তিযুক্ত? এবারের ভারতীয় দলে আই পি এলের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছিল অর্শদীপ সিং, দীনেশ কার্তিককে। অর্শ কিংবা ডিকের পারফরমেন্সের জন্য ভারতের হার, একথা আশা করি কোনও ক্রিকেট ভক্তই মানবেন না। তেমনই এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি ব্যাটার সূর্যকুমার যাদবের উত্থানের পিছনে রয়েছে আইপিএল। দেশের এক নম্বর বোলার যশপ্রীত বুমরা উঠে এসেছেন এই টুর্নামেন্ট থেকে। ভারতের সমস্যা আইপিএল নয়, বরং আইপিএল-এর মতো মঞ্চ থেকে উঠে আসা প্রতিভাদের জন্য কোনও সঠিক সিস্টেম তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতাই হল আসল সমস্যা। আইপিএলে ভালো খেলা স্যাম কুরান কিংবা জোফ্রা আর্চারের জন্য ইংল্যান্ড যে সাজানো ছক রাখতে পেরেছিল, ঈশান কিষান-পৃথ্বী শ-শুভমান গিল-সামাদ-আবেশ খানদের মতো প্রতিভাদের ব্যবহারের জন্য ভারত কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই তৈরি করতে পারেনি; যে কারণে ফিটনেসের অভাবে ভোগা রোহিত শর্মাকে বাধ্য হয়ে আজও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওপেন করতে হয় ভারতের হয়ে!

প্রশ্ন অনেক। উত্তর খোঁজার কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। রাহুল দ্রাবিড় জানেন সবটাই, বিচক্ষণ দ্রাবিড় এও জানেন যে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া কিংবা হালে পাকিস্তান অবধি যে সেট আপ গড়েছে, ভারত তা পারেনি। তাই তাঁর ওপর দায়িত্ব অনেক। শূন্য থেকে শুরু করেছেন তিনি মাসকয়েক আগে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স দলের ডেটা অ্যানালিস্ট দেবরাজ রাউত এসেছেন ভারতের কোচিং টিমকে সাহায্য করতে, এই দেবরাজ রাউত কিন্তু দ্রাবিড়ের সঙ্গে অনুর্ধ ঊনিশ দলেও ছিলেন স্বমহিমায়- ফলাফল সকলের সামনে। যে প্রক্রিয়া অন্যান্য দল শুরু করেছে অনেক আগে, আমরা তা শুরু করলাম অনেক দেরিতে। তাই দরকার সময়। কিন্তু আমাদের অসহিষ্ণু জনতার সমস্বর চিৎকার উঠছে দ্রাবিড় হঠাও, কিংবা দিন কয়েকের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়ে যাবে গো ব্যাক দ্রাবিড় হ্যাশট্যাগ- বিসিসিআই-এর বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুলবেন না। প্রেস কনফারেন্সে তাই ভারতীয় দলের প্লেয়ারদের বিদেশে লিগ খেলতে যাওয়ার অনুমতি প্রসঙ্গে বিসিসিআই-এর কোর্টেই বল ঠেলেছেন তিনি। কিন্তু কেবলমাত্র প্লেয়ারদের বিদেশী লিগে খেলালে প্লেয়ারের গুণগত উতকর্ষতা বাড়লেও‌ দলের সাফল্য অধরা থেকে যাবে হয়তো; দ্রাবিড়কে প্রস্তুত করতে হবে মঞ্চ- আর কে না জানে, মঞ্চ-ই জন্ম দেয় আগামীর নায়কের …

More Articles