উত্তমকুমারের পায়রা ওড়ানো ও কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি
ফ্ল্যাটবাড়িতে পায়রা পোষা সম্ভব নয়, তাই পায়রা-প্রেমিকদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে আর এত সময়ও কারও নেই।
উত্তমকুমার বাড়ির ছাদে পায়রার খোপ থেকে হাতে করে একের পর এক পায়রা বের করে আকাশে ওড়াচ্ছেন আর হেমন্ত কণ্ঠে গাইছেন, 'শোন শোন গেরোবাজ/ খোপ থেকে বেরো আজ/ আকাশটা পেরো আজ/ যারে যা/ উড়ে যা'। 'মায়ামৃগ' সিনেমার এই গান একসময় উত্তর কলকাতার ভাবাবেগ মথিত করে রেডিও থেকে রেডিওতে বেজে বেড়াত দর্জিপাড়া, আহিরীটোলা, শোভাবাজার, জোড়াবাগান, পাথুরেঘাটা, গরানহাটা, বাগবাজারে।
উত্তর কলকাতায় অনেক বাড়ির ছাদে থাকত পায়রার ঘর। পায়রার ঘরের মাথায় জাহাজের মাস্তুলসদৃশ লম্বা, উল্টোনো ছাতার মতো দেখতে পায়রার ব্যোম। বিকেলবেলা উড়ে বেড়িয়ে পায়রা এসে বসে সেই ব্যোমের ওপর। ব্যোমবন্দি পায়রা সন্ধেবেলা ঘরে ঢোকে। ১৯৫৯ সালের ওই সিনেমাতেই নায়িকা সন্ধ্যার গলায় গায়িকা সন্ধ্যা পায়রা নিয়ে আরেকটি গান গেয়েছিলেন, ‘ও বক বক বক বকম বকম পায়রা তোদের রকম সকম দেখে/ মুখ টিপে যে হাসছে ভোরের আকাশটা দূর থেকে’, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে দু'টি গানই শ্যামল গুপ্তর লেখা।
তো গায়িকা সন্ধ্যার পারাবত-প্রেম এই প্রথম নয়, বলা যায় প্রথম প্রেমের সেলিব্রেশন। ১৯৫৩ সালের জুলাইতে কলকাতার বিলিতি ট্রাম কোম্পানি ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়েছিল বলে, কমিউনিস্টরা তুলকালাম আন্দোলন করে ভাড়া বৃদ্ধি রুখেছিল। ওই বছরই পুজোর সময় বিমলচন্দ্র ঘোষের লেখা, সলিল চৌধুরীর সুরে গায়িকা সন্ধ্যা 'উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা' গানটি রেকর্ড করেন। আধুনিক বাংলা গানে সম্ভবত এই প্রথম পায়রার প্রবেশ। তবে কি বামপন্থী সলিল কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক জয়ের উত্থান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে মনে রেখেই ওই অমর গানটি সৃষ্টি করেছিলেন?
আরও পড়ুন: ব্যর্থ প্রেমিক, মাতাল! বাঙালির দেবদাস কেন বারবার ফিরে আসে ভারতীয় সিনেমায়?
১৩ জুন বিশ্ব পায়রা দিবসের কথা ভেবেই এই লেখা। পায়রার কথা উঠলে মনে পড়ে, আমাদের শোভাবাজারের বাড়ির প্রায়ান্ধকার একতলার কড়ি-বরগার ফাঁকে বসে থাকা সারি সারি কালো গোলা পায়রাদের কথা। সুখী পাখি। সারাদিন বকম বকম। এর-ওর পিঠে চাপাচাপি। নিরন্তর বিষ্ঠা ত্যাগ। এসবের অবসরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে ঘুম। ডানার আড় ভাঙতে মাঝে মাঝে তারা উড়ে দোতলার বারান্দায় এসে বসত, বোধহয় রোদ মাখতে। দেখতাম, কালো হলেও ওরা সত্যিই উজ্জ্বল, রূপে।
আর শখের পায়রা পোষার কথা বলা শুরু করলে শেষ হবে না। পাশের বাড়ির কেবুদের গোটা পঁচিশ পায়রা ছিল। মুক্ষ্মী, লোটন, গেরোবাজ, লক্কা- এইসব জাতের । কেবুর কাকা রোজ বিকেলে পায়রার ঘর থেকে পায়রা বের করে ওড়াত, বাঁহাতের কবজির ওপর একটা লক্কাকে বসিয়ে, লক্কা তো এমনিতেই উড়তে পারে না। তীব্র সিটি বাজিয়ে গেরোবাজগুলোকে শূন্যে পালটি খাওয়াত। হাতিবাগানে তখন প্রতি রবিবার সকালে গৃহপালিত পশুপাখির হাট বসত। সেখানে দুখে নামে একজন পায়রাওয়ালার পায়রার খ্যাতি ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু সুখের পায়রা নয়, দুখের পায়রাও হয়।
পৃথিবীতে পায়রার প্রজাতির সংখ্যা ৩৫০। প্রজাতি-ভেদে আয়ু ৫ থেকে ১৫ বছর। ডারউইন পায়রা পছন্দ করতেন। তাঁর 'অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস' নামক মহাগ্রন্থটিতে পায়রা নিয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে। পায়রা মানবসমাজে প্রাচীনতম গৃহপালিত পাখি। ৫০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় পায়রা পুষত লোকে।
তবে পায়রা পোষার হাঙ্গামা আছে। সকালে তাদের ওড়াতে হবে। উড়ে ফিরলে তাদের চান করানো, খেতে দেওয়া, পরিষ্কার খাবার জল দেওয়া। আবার বিকেলে তাদের ওড়ার পালা। সন্ধেবেলা জোড় মিলিয়ে ঘরে ঢোকানো। পায়রারা মানবসমাজের নিয়ম মেনে চলে। তাদের নিজেদের ঠিক করা জোড়া ছাড়া তারা এক ঘরে থাকবে না। নিজের জোড়া না হলে স্ত্রী পায়রা অন্য পুরুষ পায়রাকে ঘরে ঢুকতেই দেবে না, সপ্তাহে একবার পায়রার ঘর পরিষ্কার করা। পায়রা সারা বছর বাচ্চা দেবে, এবার ছয় সপ্তাহ বয়স হলে তারা উড়তে শিখবে। মনে পড়ল, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের লেখা স্কুলপাঠ্য ‘চিত্রগ্রীবের ওড়ার শিক্ষা’, লেখাটির কথা। যার বিষয়, কীভাবে বাচ্চা পায়রা চিত্রগ্রীবকে তার মা উড়তে শেখাচ্ছে।
পায়রা পোষা মানে ফুলটাইম জব। যারা পায়রা নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকত, তাদের বলা হতো 'পায়রা-পোষা ছেলে'। বেশিরভাগ যৌথ পরিবারেই একটা না একটা পায়রা-পোষা ছেলে থাকত। এই অল্প পরিসরে বলা হলো না গরানহাটার পায়রা মল্লিকের কথা।
প্রেমাংকুর আতর্থীর আত্মজীবনী 'মহাস্থবির জাতক' গ্রন্থে উত্তরপ্রদেশের কোনও এক নবাব-বাড়িতে থাকাকালীন সেই নবাবের ছেলের পায়রা শিক্ষকের পায়রা ওড়ানোর দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। তার একটু পড়া যাক,
বড়ো মিয়া একটা লম্বা শিস দিলেন, এক ঝাঁক সাদা পায়রা ছাতার মতো গোল হয়ে উড়ছে, ঝাঁকের মাঝখানে টিপের মতো একটা কালো পায়রা উড়ছে। এরপর বড়ো মিয়া দুটো লম্বা শিস দিলেন, দেখা গেল এক ঝাঁক কালো পায়রার মাঝে একটা সাদা পায়রা উড়ছে। আবার একটা শিসে এক ঝাঁক সাদা পায়রা উড়ল যাদের ল্যাজ লাল রং করা, পরের শিসে আর এক ঝাঁক সাদা পায়রা উড়ল যাদের ল্যাজ কালো রং করা। দু ঘণ্টা ধরে পায়রা ওড়ানো চলল।
লখনউয়ের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ নাচ, গান, কবিতা এবং পায়রার সমঝদার ছিলেন। ব্রিটিশরা লখনউ দখল করলে বিতাড়িত নবাব ১৮৫৬ সালে কলকাতার গার্ডেনরিচের মেটিয়াবুরুজ এলাকায় এসে ওঠেন। নবাবি না থাকলেও উনি ২৫,০০০ টাকায় এক জোড়া পেশোয়ারি রেশমি পায়রা কেনেন। কলকাতায় ওয়াজেদ আলির প্রায় ২৪,০০০ পায়রা ছিল। গুলাম আব্বাস তখন কলকাতার এক নম্বর পায়রা-বিশারদ। তাঁর নেতৃত্বে একদল লোক নবাবের পায়রাদের দেখাশোনা করত।
শুনেছি, কলকাতায় এখন জ্যাকবিয়ান সাদা পায়রা, যাকে লোটন বলা হয়, এক জোড়ার দাম ২০,০০০ টাকা। এক জোড়া ব্ল্যাক স্যাক্সন বা মুখখি পায়রার দাম ১৮,০০০ টাকা। অবশ্য ২০০ টাকা জোড়ার সাদা পায়রাও পাওয়া যায়। পায়রা বাসা বাঁধে না, খাবার সঞ্চয় করে না- সাধু পাখি। তাই বিখ্যাত সুফি-ফকিরদের মাজারে পায়রাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। আবার পৃথিবীতে একমাত্র অসমের কামাখ্যা মন্দিরেই পায়রা বলি হয়।
বিশ্বের বহু শহুরে পায়রা চক আছে। যেমন, ভূমধ্যসাগরের কাছে ট্যুরিস্টদের প্রিয় ব্রুভভনিকের স্ত্রাদুন, ভেনিসে সান মার্কো, ম্যানচেস্টারে পিকাডিলি গার্ডেন, শিকাগোয় ডালে সেন্টার, ইস্তানবুলে ইজিপশিয়ান বাজার, গ্লাসগোয় জর্জ স্কোয়ার, সিডনিতে মার্টিন প্লেস, লন্ডনে ট্রাফালগার স্কোয়ার, মুম্বইতে ফ্লোরা ফাউন্টেন। কলকাতায় জগন্নাথ ঘাটে গেলে পায়রা দেখা যায় বটে। শিল্পী পিকাসোর প্রিয় পাখি ছিল পায়রা। তাঁর পায়রা সিরিজের বহু ছবি আছে। ঠোঁটে অলিভ ডাল নিয়ে উড়ে যাওয়া শান্তির প্রতীক কপোতটি পিকাসোর হাতেই জনপ্রিয়। ভারত সরকারেরও স্ট্যাম্প আছে পায়রার ছবি দিয়ে।
৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বে গ্রিসে প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সব প্রতিযোগীরা তাদের বাড়ির পায়রাটিকে সঙ্গে এনেছিলেন, যাতে সে জিতলে পায়রা তার গ্রামে খবরটি পৌঁছে দেয়। পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে খবর পাঠানোর সেই শুরু, তারপর বহু ইতিহাস, দুটো মহাযুদ্ধ পার করে সে খবর পাঠিয়ে চলেছে, ওড়ার গতি ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার। ১৮৫০ সালে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জার্মানিতে শেয়ারের দর ওঠানামার খবর বেলজিয়ামে পাঠাত পায়রার পায়ে কাগজ বেঁধে। উড়িষ্যায় ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ৪০০টি গ্রামীণ থানার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল পায়রা।
কলকাতার পায়রা-প্রেমিকদের ক্লাবের নাম ওয়েস্টবেঙ্গল পিজিয়ন ক্লাব। প্রতি বছর বিশ্ব পায়রা দিবসে তাদের উদ্যোগে সারা ভারতের পায়রা-প্রেমিকরা কলকাতায় জড়ো হয় তাদের পায়রা নিয়ে।
ফ্ল্যাটবাড়িতে পায়রা পোষা সম্ভব নয়, তাই পায়রা-প্রেমিকদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে আর এত সময়ও কারও নেই। বছরদশেক আগে, বাগবাজারে, সদ্য-প্রয়াত এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখি, তাদের পুরনো এজমালি বাড়ি সেদিনই ভাঙা শুরু হল, ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে বলে। প্রথমেই ভাঙা হচ্ছে ছাদের পরিত্যক্ত পায়রার ঘর।