মন্দির ভাঙতে এসে দেবীর পদতলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কালাপাহাড়
মন্দিরটির স্থাপত্যও অসাধারণ। দেওয়ালজুড়ে আছে টেরাকোটার অলংকরণ। মন্দিরের অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য এতটাই নয়নমনোহর, যে সাধারণ মানুষ এই মন্দিরকে 'বিশ্বকর্মার নির্মাণ' বলে উল্লেখ করেন।
বর্গভীমা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা, ভারতের অন্যতম জাগ্রত একটি প্রধান সতীপীঠ তথা শক্তিপীঠ। পীঠ-নির্ণায়ক তত্ত্বানুযায়ী এটি ৫১ সতীপীঠের প্রথম পীঠ। এখানে দেবী ভীমরূপা কালীরূপে (মতান্তরে উগ্রতারা) বিরাজমান। প্রাচীন বঙ্গদেশের ঐতিহাসিক বন্দরনগরী 'তাম্রলিপ্ত' শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই সুপ্রাচীন মন্দিরটি ধ্রুপদী বাংলা মাতৃকা উপাসনা ও শক্তি আরাধনার চিহ্ন বহন করে চলেছে। বহু বিপ্লবী এই মন্দিরে মাতৃমূর্তির সামনে সত্য ও ধর্মের পথে চলা এবং দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন করার শপথ নিয়েছিলেন।বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এখানে পুজো করতে আসতেন বলে জানা যায়। এই মন্দিরে দেবীর নিত্যপুজোয় শোল মাছ বাধ্যতামূলক। প্রত্যহ বলি বন্ধ হয়ে গেলেও বছরে একবার এখনও এখানে ছাগবলি হয়।
বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শহর ঐতিহাসিক তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের মধ্যমণি মা বর্গভীমা। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম প্রথম সতীপীঠ। এখানে দেবী সতীর 'বাম গোড়ালি' পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী মা ভীমরূপা কালিকা। দেবী এখানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পুজিত হন। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী। জনশ্রুতি আছে, বাংলার ১২৬০ সালে দেউলটি তৈরি করিয়েছিলেন লাহোরের মগলুরিয়া চৌধুরী। এখানে গর্ভগৃহের ভেতর বেদির ওপর স্থাপিত দেবী মা চতুর্ভূজা। তাঁর ডান হাতে রয়েছে খড়গ, নিচের ডান হস্তে রয়েছে ত্রিশূল, বাম হস্তে রয়েছে খর্পর এবং নিচের বাম হস্তে নরমুণ্ড। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে দেবী বর্গভীমা হলেন কপালিনী, তাঁর ভৈরব কপালি বা সর্বানন্দ। যোগিনী মন্ত্র ও নীল তন্ত্রানুসারে দেবী মাতার ধ্যান,পূজা ও জপ করা হয়। কথিত আছে, এই মন্দিরের পাশের পুকুরে ডুব দিয়ে পাওয়া যে কোনও বস্তু লাল সুতো দিয়ে মন্দিরের পাশের গাছে বাঁধলে, যে কোনও মনস্কামনা পূরণ হয়। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ- এই চারটি বর্গ দান করেন তাই দেবী 'বর্গভীমা'। এই দেবীকে ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক ঘটনা। এখানে মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট এবং ২৬টি সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠতে হয়।
মা বর্গভীমার মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা গল্প। একটি কাহিনি শোনা যায়। তাম্রলিপ্ত ময়ূরবংশীয় রাজাদের রাজত্ব ছিল। সেই বংশেরই একজন রাজার নাম ছিল 'তাম্রধজ'(অনেকের মতে 'গরুড়ধ্বজ')। তিনি শোল মাছ খেতে খুব ভালবাসতেন। একজন জেলে বউ প্রতিদিন রাজবাড়িতে মাছ পৌঁছে দিত। কিন্তু জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পথে মাছগুলি রোজই মরে যেত। এদিকে মহারাজার চাই জ্যান্ত মাছ। জ্যান্ত মাছ না দিতে পারলে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুদণ্ড। একদিন বনের মধ্যে বসে মরা মাছগুলিকে নিয়ে জেলে বউ কাঁদছে, এমন সময় দেখতে পেল একটি ছোট্ট মেয়ে তাকে বলছে তুমি ওই যে জলভর্তি 'কূপ' দেখছ, ওই কূপের মধ্যে মাছগুলিকে ভিজিয়ে নাও, দেখবে ওরা জ্যান্ত হয়ে উঠবে। জেলে বউ এরপর থেকে প্রতিদিনই তাই করতে থাকল, এবং আশ্চর্যজনকভাবে মাছগুলি বেঁচে উঠত। একদিন জেলে বউ-এর কথা মহারাজার কানে পৌঁছয়। তিনি জেলে বউকে ডেকে পাঠিয়ে প্রশ্ন করলেন যে, মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে কী করে? জেলে বউ সত্য কথাই বলল। মহারাজা তখন বনের মধ্যে সেই কুয়োর কাছে এসে দেখলেন, কুয়োর মুখেই রয়েছে একটি দেবী মূর্তি, তখন সেখানেই মহারাজা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
আরও পড়ুন: এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গ রয়েছে এই বাংলাতেই
ঐতিহাসিকদের মতে, এই মন্দিরটি একটি বৌদ্ধ সংঘ। পূর্ব ভারতের হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানে বঙ্গদেশের শক্তির আরাধকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হিন্দুদের মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই হিসেবে এই মন্দির সেন যুগে 'বল্লাল সেন'-এর আমলে তৈরি হয়। ইতিহাসের দলিল ও প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে কালাপাহাড় নামে এক দুর্ধর্ষ সিপাহসালার ছিলেন। তিনি এক মুসলিম কন্যা নদুলারী বিবিকে বিবাহ করে ধর্মান্তরিত হন। সেই কারনে বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। সেই কারণবশত তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরের সমূহ ক্ষতিসাধন করতে থাকেন। এই দুর্ধর্ষ কালাপাহাড় দেবী বর্গভীমার মন্দির ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে রূপনারানের তীরে উপস্থিত হন। নদীতটে শিবির খাটিয়ে বর্গভীমা মন্দিরের দিকে তিনি একাই এগিয়ে যান। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁবুতে না ফেরায় তাঁবুর সৈনিকরা স্তম্ভিত হন এবং মন্দির প্রাঙ্গণে এসে দেখেন কালাপাহাড় দেবী বর্গভীমার পদতলে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসকারী কালাপাহাড় জীবনে প্রথম ও একমাত্র মূর্তিকে ধ্বংস করতে এসেও ধ্বংস করতে পারেননি, সেই মূর্তি আজও তমলুকের মন্দিরে আরতির আলোকে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ্ত হয়ে ওঠে।
দেবী বর্গভীমাকে চণ্ডিকাতন্ত্রে ভীমা দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মূর্তির গঠন উগ্রতারা মূর্তির মতোই কালো পাথরে খোদাই করা। এই ধরনের মূর্তি সচরাচর দেখা যায় না। এই দেবীর ধ্যান এবং পূজা যোগিনী মন্ত্র ও নীল তন্ত্র অনুসারে সম্পাদিত হয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর 'চন্ডীমঙ্গল' ('অভয়ামঙ্গল') কাব্যে এই দেবী সম্পর্কে লিখেছেন,
গোকুলে গোমতীনামা
তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা, উত্তরে বিদিত বিশ্বকায়া।
এই মন্দিরের সঙ্গে অনেক ইতিহাসের কাহিনি জড়িয়ে আছে। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দিরের সঙ্গে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন এবং অশোক-পুত্রর সিংহল যাত্রার কাহিনিও জড়িয়ে রয়েছে।
এই মন্দিরটির স্থাপত্যও অসাধারণ। দেওয়ালজুড়ে আছে টেরাকোটার অলংকরণ। মন্দিরের অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য এতটাই নয়নমনোহর, যে সাধারণ মানুষ এই মন্দিরকে 'বিশ্বকর্মার নির্মাণ' বলে উল্লেখ করেন।
প্রতিদিন ভোরে দেবী বর্গভীমাকে স্নান করিয়ে শুরু হয় নিত্যপুজো। শীতলভোগে থাকে ছোলা, মুড়কি, ফল ও সরবৎ। এরপর দেবীকে পরানো হয় রাজবেশ। তারপর হয় মঙ্গলারতি। দুপুরে পোলাও, খিচুড়ি, সাদা অন্ন, পাঁচ রকম ভাজা, তিন রকম তরকারি ও পায়েস দেওয়া হয়। এছাড়া শোল মাছ, ইলিশ মাছ এবং চিংড়ি মাছ-সহযোগে বিশেষ ভোগ নিবেদিত হয় মায়ের উদ্দেশ্যে। সন্ধেবেলা মা বেনারসি শাড়িতে বিশেষ রাজবেশ ধারণ করেন এবং শুরু হয় সন্ধ্যা-আরতি। লুচি, আলুভাজা, পাঁচ রকম মিষ্টি, পাঁচ রকম ফল, ক্ষীর ভোগ ইত্যাদি দেওয়া হয় সন্ধ্যায়। রাতে শোল মাছ এবং পাঁঠার মাংস দিয়ে তন্ত্রমতে নিশিপুজোর আয়োজন করা হয়। ৩৬০ দিন দেবী উগ্রতারা-রূপে পূজিতা হন। চার দিন দুর্গাপুজো হয় এবং কালীপুজোর দিন মা শ্যামারূপে পূজিতা হন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, তমলুক রাজবাড়ি থেকে পাঁঠা ও খড়্গ এলে তারপর বলির মধ্য দিয়ে দেবীর পুজো আরম্ভ হয়। তমলুকের যে কোনও পূজানুষ্ঠানের আগে দেবী বর্গভীমার পুজো দিয়ে তবে সেই পুজো আরম্ভ হয়।
৫১ সতীপীঠের প্রথম সতীপীঠ দেবী 'বর্গভীমা' তবু আজও প্রচারের অন্তরালেই রয়ে গেছেন।