জঙ্গির আবেদন অগ্রাহ্য, বহাল মৃত্যুদণ্ডই! লালকেল্লা হামলার ত্রাস কে এই পাক জঙ্গি আরিফ?
Red Fort Attack: ২০০০ সালে লালকেল্লায় সেনা ব্যারাকে হামলার মূল চক্রী হিসেবে আগেই দোষী প্রমাণিত হয়েছে আরিফ। ডিসেম্বরের এই হামলায় তিনজন মারা যান, যাঁদের মধ্যে ২ জন জওয়ান ছিলেন।
দিল্লি শহরে মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত দুর্গ লালকেল্লা। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গটিই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। এরপর ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নির্বাসিত করলে ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এই দুর্গটিকে একটি সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমানে লালকেল্লা জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র তো বটেই, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের এক শক্তিশালী প্রতীকও। আর ঠিক এই লালকেল্লাতেই হামলা চালাতে দ্বিধা করেনি পাক জঙ্গিরা। ২০০০ সালে লালকেল্লায় হামলা চালিয়েছিল লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গি মহম্মদ আরিফ। হামলাতে মৃত্যু হয়েছিল তিনজন সেনা আধিকারিকের। সেই মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। যদিও তা পুনর্বিচারের আবেদন জানানো হয়েছিল দোষীর তরফে। জঙ্গি মহম্মদ আরিফ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল ঠিকই, তবে শেষপর্যন্ত কোনও লাভ হল না।
কোন পথে মামলা?
দিল্লির লালকেল্লায় হামলা চালানোর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত লস্কর জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। ২০০০ সালে লালকেল্লায় হামলা চালিয়েছিল লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গি মহম্মদ আরিফ। আদালতের নির্দেশ পুর্নবিবেচনার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এই লস্কর জঙ্গি। আদালত তাঁর এই আবেদন খারিজ করে আগের নির্দেশই পুর্নবহাল রেখেছে।
২২ ডিসেম্বর ২০০০-এ লালকেল্লায় ওই হামলার ঘটনায় দুই সেনা আধিকারিক সহ তিনজনের মৃত্যু হয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০০০ সালে দিল্লির লালকেল্লা হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের আগের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মহম্মদ আরিফের রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার, সুপ্রিম কোর্টে এই মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার কথা ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিত এবং বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর ডিভিশন বেঞ্চ।
আরও পড়ুন- কর্মী ছাঁটাই, ছুটি বাতিল! ক্ষমতায় এসেই টুইটার নিয়ে আসলে কী করতে চাইছেন এলন মাস্ক?
এই মামলায় ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিম্ন আদালত মহম্মদ আরিফকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। লস্কর-ই-তৈবার সদস্য মহম্মদ আরিফকে পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২০১১ সালের ১০ অগাস্ট মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় শীর্ষ আদালত। আদালতের সেই রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানায় আরিফ। কিন্তু তাঁর আবেদন খারিজ করে দিল শীর্ষ আদালত।
কে এই আরিফ?
আদতে পাকিস্তানের বাসিন্দা আরিফ এই হামলার মাস্টারমাইন্ড। বারবার পাক মদতে জঙ্গিরা এই দেশে হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন ডশিয়ারের মাধ্যমে দিল্লি তার প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সেই কথা কানে তোলেনি। লস্কর-ই-তৈবা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অন্যতম এক সন্ত্রাসবাদী দল। ১৯৯০ সালে হাফেজ মহম্মদ সঈদ, আবদুল্লাহ ইউসুফ আজম ও জাফর ইকবাল আফগানিস্তানে লস্কর-ই-তৈবা প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের কাছে মুরিদকে নামক জায়গায় এর সদর অবস্থিত। এই জঙ্গি দলটি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিভিন্ন ক্যাম্প পরিচালনা করে। এই দলের ছত্রছায়ায় থেকেই মহম্মদ আরিফের হাতেখড়ি। পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করেই লস্কর-ই-তৈবা লালকেল্লা হামলার ব্লুপ্রিন্ট রচনা করে।
সেই হামলার ঘটনায় ২০০৫ সালে দিল্লি ট্রায়াল কোর্টে আরিফকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ২০০৭ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে দিল্লি হাইকোর্ট। তারপরে সুপ্রিম কোর্টে আসে মামলা। ২০১১ সালে সেখানেও এই রায় বহাল রাখা হয়। এরপরে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হয় আরিফের তরফে। ২০১৪ সালে সেটি একবার খারিজ করা হয়। তারপরেও দেশের শীর্ষ আদালত আরিফকে মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে আবেদন করার একটা সুযোগ দেয়। ২০১৪ সালে সাংবিধানিক বেঞ্চের একটি রায়ের উপর নির্ভর করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশে বলা হয়েছিল, দোষী প্রমাণিত হয়েছে এমন বন্দির রিভিউ পিটিশন ওপেন কোর্টে শুনানি করতে হবে। আরিফের ক্ষেত্রে আগেরবারের রিভিউ পিটিশন ওপেন কোর্ট ছাড়াই খারিজ হয়েছিল।
লালকেল্লা হামলা ও আরিফের কীর্তি
২০০০ সালে লালকেল্লায় সেনা ব্যারাকে হামলার মূল চক্রী হিসেবে আগেই দোষী প্রমাণিত হয়েছে আরিফ। ডিসেম্বরের এই হামলায় তিনজন মারা যান, যাঁদের মধ্যে ২ জন জওয়ান ছিলেন। লালকেল্লায় ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগ ছিল আরিফের বিরুদ্ধে। পরে স্ত্রী রেহমানা ইউসুফ ফারুকির সঙ্গে আরিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবা। হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরেও সাড়া ফেলেছিল। আরও খারাপ হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। তাতে অবশ্য পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যকলাপ এতটুকু কমেনি। সারা বিশ্ব বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে নিন্দা করেছে। ইসলামাবাদ তাতে কর্ণপাত করেনি।
দিল্লির ট্রায়াল কোর্ট ২০০৫ সালে আরিফ-সহ মোট সাত জনকে খুন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। আরিফের মৃত্যুদণ্ড হয়, বাকিদের কারাবাসের ঘোষণা হয়। ২০০৭ সালে আরিফের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেও প্রমাণের অভাবে বাকিরা খালাস হয়ে যায়।
আরও পড়ুন- কাকে বলে টু ফিঙ্গার টেস্ট? ধর্ষণের প্রমাণে কতটা যুক্তিসম্মত এই পরীক্ষা
প্রতি বছর দেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লার লাহোরি গেট সংলগ্ন একটি স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকেন। ২০০৭ সালে লালকেল্লা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান সুবৃহৎ এই কেল্লাটির নির্মাণকার্য শুরু করেন। নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৮৪৮ সালে। প্রথম দিকে এই দুর্গের নাম ছিল ‘কিলা-ই-মুবারক’। যে দুর্গের গায়ে লেগে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, গর্ব- সেখানেও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পাকিস্তান জঙ্গি পাঠায়, গুলি চালায়, ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্ব যখন প্রেমের জোয়ারে ভাসছে, তখন কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে জঙ্গিহানায় থমকে যায় আসমুদ্র হিমাচল। শোকের ছায়া পড়ে গোটা দেশ জুড়ে। জঙ্গি হামলার কড়া নিন্দা করে সকলেই। পাকিস্তানের সমালোচনায় ফুঁসতে থাকে গোটা দেশ। ভারত ২১ দিনের মাথায় জবাব দেয়। পাকিস্তানের অন্দরে প্রবেশ করে জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মারা যায় বেশ কয়েকজন জঙ্গিনেতা। এই দেশের মাটিতে জঙ্গি কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হবে না, জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সেই বার্তাকেই যেন আরও জোরদার করল শীর্ষ আদালত।