ভূস্বর্গের অমৃত! শতাব্দীপ্রাচীন পানীয় ভাগ্য ফিরিয়েছে এই কাশ্মীরি তরুণীর

কাশ্মীরি সমাজ-সংস্কৃতির বেশিরভাগটাই অজানা আমাদের কাছে। এমনই এক অজ্ঞাত স্বাস্থ্যকর কাশ্মীরি পানীয় শাহি শীরা।

বরফে ঢাকা সুউচ্চ পাহাড় ও সবুজে ঘেরা কাশ্মীর উপত্যকা স্বর্গের চেয়েও বেশি সুন্দর। হিমালয় ও পীর পঞ্জালের মাঝে অবস্থিত জম্মু-কাশ্মীরের সৌন্দর্য মানুষকে অভিভূত করছে যুগ যুগ ধরে। উপত্যকার রূপে মুগ্ধ আমির খসরু বলেছিলেন, "এই পৃথিবীর বুকে যদি স্বর্গ থেকে থাকে তবে তা এখানেই রয়েছে।" তবে কাশ্মীরের মানুষ এবং তাঁদের জীবনধারা সম্পর্কে ভারতবাসীর সিকিভাগও ধারণা নেই। কাশ্মীরি সমাজ-সংস্কৃতির বেশিরভাগটাই অজানা আমাদের কাছে। এমনই এক অজ্ঞাত স্বাস্থ্যকর কাশ্মীরি পানীয় শাহি শীরা। তবে আজ কাশ্মীরি এক মহিলার উদ্যোগে ভারতের যে কোনও প্রান্তের মানুষ স্বাদ পেতে পারেন এই পানীয়ের। শতাব্দীপ্রাচীন শাহি শীরা পানীয়র ব্যবসা থেকে আজ মোটা অঙ্কের অর্থও উপার্জন করছেন কাশ্মীরের রুহাব লতিফ মীর।

রুহাবের শাহি শুরুয়াত
ছোটবেলা থেকেই রুহাব তাঁর মায়ের হাতে রান্না করা বিভিন্ন সুস্বাদু কাশ্মীরি পদ খেয়ে বড় হয়েছে। সেই থেকেই তাঁর মধ্যে কাশ্মীরি রন্ধনশৈলীর প্রতি প্রবল আগ্রহ ও ভালবাসা। কিন্তু একটু বড় হতেই রুহাব বুঝতে পারেন, উপত্যকার বাইরে এই খাবারগুলির তেমন চল নেই। তাঁর কথায়, "আমি দেখি দেশের মানুষ বিদেশী বিভিন্ন পদ খেতে পছন্দ করেন। কাশ্মীরি যে খাবার পদ রান্না করা বেশ শক্ত কাজ তাই সেগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে।"

২৮ বছরের রুহাব পেশায় একজন উকিল। ২০১৮ সালে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কলেজ চত্বরে ফুড ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। উপত্যকার অন্যান্য রেঁস্তোরার সঙ্গে রুহাবও নাম দেন সেখানে। রুহাবের কথায়, "আমি ভিন্নস্বাদের খাবার মানুষের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। বহু যুগ ধরে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই অ্যাপ্রিকট (বিশেষ ধরনের ফল) দিয়ে শীরা বানানো হতো। তাই ঠিক করি মানুষের জন্য আমি এই পানীয়ই তৈরি করবো ফুড ফেস্টিভ্যালে।"

আরও পড়ুন: প্রতি পদে বিস্ময়, স্বাধীনতার ৭৫-এ বিশ্বকে ভারতের ক্ষমতা চেনাবে চেনাব সেতু

রুহাবের কথামতো তাঁর মা পরিবারের সদস্যের থেকে এই পানীয়ের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। জানা যায়, একসময় হাকিম বা চিকিৎসকেরা এই পানীয়কে ওষুধ হিসেবে খেতে বলতেন, কারণ শাহি শীরায় একাধিক গুণ রয়েছে, যা শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এই পানীয় রক্ত পরিস্রুত করে। কাশ্মীরি যে কোনও বিয়েতেও এই পানীয় দেওয়া হতো অতিথিদের। ফুড ফেস্টিভ্যালে রুহাবের তৈরি করা পানীয়র যথেষ্ট প্রশংসা করেন সকলেই। পাঁচশোরও বেশি মানুষ চেখে দেখেন রুহাবের তৈরি শাহি পোলাও শীরা।

পরের বছর এক আত্মীয়র বিয়েতেও এই পানীয় পরিবেশন করেন রুহাব। তবে অতিমারীর কারণে ব্যবসা শুরু করা নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন তরুণী। তবে স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাত্র দশ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে রুহাব।

২০২০ সালে 'খেন খোয়ারদান বাই রুহাব' নামে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি শাহি শীরার ব্যবসা শুরু করেন কাশ্মীরি তরুণী। 'খেন খোয়ারদান' কথার কাশ্মীরি অর্থ খাদ্যবস্তু। এ-বছর প্রায় একশোটিরও বেশি বিয়ের জন্য এই পানীয়ের অর্ডার পেয়েছেন রুহাব। ব্যবসায় লাভের পরিমাণও খুব খারাপ নয়। শুধু এ-বছরেই তাঁর লাভের পরিমাণ দেড় লক্ষ ছুঁইছুঁই। দু'বছরে তিন লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছে এই পানীয়।

শাহি শীরার নির্বাচন
রুহাবের কথায়, "মাংসের তৈরি বেশ কিছু কাশ্মীরি পদ এবং কাহওয়ার মতো পানীয় স্থানীয় পাচকদের হাতে বেচেঁ থাকলেও শাহি শীরা বিলুপ্তির পথে।" এমনকী, কাশ্মীরি সংস্কৃতি থেকেও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই পানীয়। শিকড়ের টানে এই পানীয়কে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাতেই এই ব্যবসা শুরু করেন রুহাব। এই পানীয় তৈরির জন্য স্থানীয় বিভিন্ন আঙুরের রস ব্যবহার করা হয়। একদিনেরও বেশি সময় লাগে এটি তৈরি করতে। হালকা, সুস্বাদু শাহি শীরার এক চুমুক আপনাকে সতেজ করে তুলবে তৎক্ষণাৎ। বাজারের কার্বন ও সুগারযুক্ত পানীয়ের যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্যকর শাহি শীরা, এমনটাই মনে করেন রুহাব।

রুহাবের পরিবারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই পদ্ধতিতেই শাহি শীরা তৈরি করে আসছেন। রুহাবে মা এই পানীয় তৈরি শেখেন তাঁর দিদার কাছে। ১০০ বছরের পুরনো পদ্ধতি মেনে আজও রমজান মাসে শাহি শীরা তৈরি করেন কাশ্মীরি এই পরিবার। রুহাবের কথায়, "সুস্বাদু পানীয় খাওয়ার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম রমজান মাসের।" ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর শাহি শীরা রক্ত পরিস্রুত করার পাশাপাশি ত্বক উজ্জ্বল করে, পেটের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে।

শাহি শীরার রকমফের
শুরুর দিন থেকেই হিট রুহাবের তৈরি শাহি শীরা। বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা এই পানীয়ের অর্ডার করতে শুরু করেন। অতিমারীর মধ্যেও উপত্যকার একশোটি বিয়ে বাড়িতে এই পানীয় পৌঁছে দিয়েছেন রুহাব। ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক হিসেবে পরিবেশন করা হলেও মাতৃত্বকালীন অবস্থাতেও এই পানীয় নির্দ্বিধায় খেতে পারেন মহিলারা।

মোট চারটি স্বাদের শাহি শীরা তৈরি করেন রুহাব- অ্যাপ্রিকট, ব্ল্যাক বেরি, রেড বেরি এবং মিক্সড বেরি। প্রতি ২০০ মিলিলিটার শাহি শীরার বোতলের দাম ১১০ টাকা। রুহাবের সঙ্গে আজ আরও পাঁচ জন রয়েছে তাঁকে সাহায্যের জন্য। ইতিমধ্যে নতুন প্রোডাক্ট কুইন্স জ্যাম নিয়ে এসেছেন রুহাব। অনলাইনেও অর্ডার নেয় এই সংস্থা। দুবাই, কুয়েত থেকে হাজার হাজার বোতলের অর্ডার এলেও সীমিত পরিকাঠামোয় যোগান দিতে ব্যর্থ রুহাব। ভবিষ্যতে শাহি শীরার ব্যবসা আরও বাড়াতে চান কাশ্মীরি তরুণী। নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষকে জানাতে উদগ্রীব বছর আঠাশের তরুণী রুহাব।

More Articles