'পাগল' নাড়ালে রক্ষে নেই, 'সাঁকো' শব্দের আড়ালে লুকিয়ে কোন রহস্য
Bengali Vocabulary: 'সাঁকো' শব্দটির উৎপত্তি কোথা থেকে
এবারের শব্দ সাঁকো। পাগলের সাঁকো নাড়ানোর অভ্যেস তো যাওয়ার নয়। ছেলেবেলায় বাঁশের সাঁকো পার হওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। প্রায় সমস্ত অভিধানে সংস্কৃত সংক্রম থেকে প্রাকৃত 'সাঙ্কম' হয়ে সাঁকো আসার কথা বলা হয়েছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালাভাষার অভিধান, সংসদ বাংলা অভিধান– সব জায়গাতেই এই ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে। বাদ নেই ঢাকার বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান ও বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানও।
তবে সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধানে সাঁকো শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে 'বাংলা প্রচলিত' বলা হয়েছে। নগেন্দনাথ বসু প্রণীত 'বিশ্বকোষ' অভিধানে শব্দটিকে 'দেশজ' বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এখানেও নানা মুনির নানা মত।
সংক্রম শব্দটির অর্থ চলন, গমন, সঞ্চরণ। সোজা রাস্তায়, হাটে-মাঠে-বাটে, পথে-প্রান্তরে সব জায়গাতেই তো চলন, গমন বা সঞ্চরণ হতে পারে। তার জন্য নদী বা খালের এপার-ওপারে মিলন ঘটানোর আয়োজন কেন? কেন এই বন্ধনের প্রয়াস? এখানে সবাই নিরুত্তর। ডাক্তারি পরিভাষায় সংক্রমণ তো একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়া বা নিজের শরীরের এক জায়গা থেকে আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া।
আরও পড়ুন: ‘উজবুক’ এসেছে উজবেকিস্তান থেকে? যে ধাঁধা লুকিয়ে এই শব্দে
সেতু শব্দটি সংস্কৃতে বহুল-ব্যবহৃত। সাঁকো-র প্রতিশব্দ হিসেবে এটাই মান্য শব্দ। রামচন্দ্রের সেতুবন্ধন বলা হয়, অসেতুসম্ভব পারস্পরিক বিদ্বেষের কথাও শোনা যায়।সুশীলকুমার দে-র বাংলা প্রবাদ বইটিতে সাঁকো নিয়ে তিনটি প্রবাদের দেখা পাচ্ছি।
১. চুলের সাঁকো ক্ষুরের ধার
(প্রয়োগদৃষ্টান্ত, 'কেশের সাঁকোয়া দিমু, ক্ষুরের ধারনি'– গোপীচন্দ্রের পাঁচালী)
২. পিরীতের কত খেলা বুঝে ওঠা ভার।
চুলের সাঁকোয় তুলে দিয়ে করায় নাগে পার। (অর্থ, অতি সংকীর্ণ ও দুর্গম)
৩. সাঁকো থেকে পড়ে, অমনি জুম্মার গোসলও করে।(অর্থ, শুক্রবারের পুণ্যস্নান)।
এই প্রসঙ্গে 'পুলসিরাত'-এর কথা মনে পড়বে। মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত 'বাংলাভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান'-এ পুলসিরাত-এর অর্থ দেওয়া হয়েছে, "পরলোকের সাঁকোবিশেষ। মুসলমানদের বিশ্বাসমতে দোজখের ওপরে অবস্থিত বিরাজমান পুল যা চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম এবং তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। ধার্মিক-পুণ্যবান ব্যক্তিগণ বিদ্যুদ্বেগে উক্ত পুল অতিক্রম করে বেহেস্তে প্রবেশ করবেন, আর পাপীরা খণ্ড বিখণ্ড হয়ে অগ্নিময় দোজখে পড়ে যাবে। [ফারসি পুল+ আরবি সিরাত]।" এই পুলসিরাত পার হওয়া হিন্দু ভক্তদের বৈতরণী পার হওয়ার মতো ব্যাপার।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রবাদের সাঁকো চুলের মতো সংকীর্ণ, দুর্গম। ওপারে যাওয়া খুব শক্ত কাজ। কিন্তু কেউ কেউ তা টপকাতে পারে নিজস্ব মুনশিয়ানায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমগ্র সাহিত্যে মোট কুড়িবার 'সাঁকো' শব্দটি লিখেছেন। 'নষ্টনীড়' উপন্যাসে আছে,
অমল কহিল, 'আর একটা ছোটোখাটো ঝিলের মতো করতে হবে, তাতে হাঁস চরবে।'
চারু সে প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া কহিল, 'আর তাতে নীল পদ্ম দেব, আমার অনেকদিন থেকে নীল পদ্ম দেখার সাধ আছে।'
অমল কহিল, 'সেই ঝিলের উপর একটি সাঁকো বেঁধে দেওয়া যাবে, আর ঘাটে একটি বেশ ছোটো ডিঙি থাকবে।
'য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারী'-তে তিনি ফ্রান্স-ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন,
চঞ্চলা নির্ঝরিণী বেঁকেচুরে ফেনিয়ে ফুলে নেচে কলরব করে পাথরগুলোকে সর্বাঙ্গ দিয়ে ঠেলে রেলগাড়ির সঙ্গে সমান দৌড় দিয়েছে। মাঝে মাঝে এক একটা লোহার সাঁকো-মুষ্টি দিয়ে তার ক্ষীণ কটিদেশ পরিমাপ করার চেষ্টা করছে।...
'জানা-অজানা' কবিতায় লিখেছেন-
চোখ-বোজা অভ্যাসের পথ দিয়ে যাই।
দেখি যাহা অনেকটা স্পষ্ট দেখি নাকো।
জানা-অজানার মাঝে সরু এক চৈতন্যের সাঁকো,
ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনা
তারি 'পরে চলে আনাগোনা।
সাঁকো যে চৈতন্যেরও হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কে জানাবেন আমাদের! তিনি জোড়াসাঁকোর সুসন্তান তো বটেই, তামাম বিশ্বেরও তিনি বরেণ্য সন্তান। মহাবিশ্বে চলে তাঁর চৈতন্যের আনাগোনা।
এখন দেখতে হবে, সাঁকো শব্দটির প্রচলিত ব্যুৎপত্তি 'সংক্রম> সাঙ্কম> সাঁকো' ছাড়াও অন্য কোনও ব্যুৎপত্তি সম্ভব কি না। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গালা অভিধান'-এ (প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ১৯২৬ সালে) কিন্তু সাঁকো শব্দটি নেই। 'সাকম্' বলে যে শব্দটি এখানে পেলাম, তার অর্থ - সহ, সঙ্গে। ব্যুৎপত্তি,– [ সহ শব্দ–অক(গমন করা)+ অম্ ক]। এই সাকম থেকে সাঁকো এসেছে কিনা ভেবে দেখা যায়।
কারণ নদীর দু'টি পার একসঙ্গে পথ চলা শুরু করে এই সাঁকো-র মাধ্যমে। সাঁকোই একপারকে অন্যপারের সহযোগী করে তোলে। সাকম্ > সাকো > সাঁকো, এই পথেও সাঁকো শব্দটি আসতে পারে। আবার, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর অভিধানে 'সাঁকাল' বলে যে শব্দটি দিয়েছেন, সেটিও ভাবায়। সাঁকাল [শৃঙ্খল > ] বি, দড়ির শিকল।
শৃঙ্খল মানেই তো বন্ধন। নদী বা খালের একপারের সঙ্গে অন্য পারের বন্ধন তৈরি করে সাঁকো। বলা চলে, দুই পারকে শৃঙ্খলিত করে এই সাঁকো। তাই সাঁকাল বা দড়ির শিকলকে বলা চলে প্রিমিটিভ সাঁকো। সাঁকাল যদি শৃঙ্খল শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়, তবে সাঁকাল থেকে সাঁকা হয়ে তা থেকে সাঁকো আসতেই পারে। এই আসাটা সংক্রম থেকে সাঙ্কম হয়ে সাঁকো আসার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। কেননা, সংক্রমে নদীর দুই পারকে মেলানোর প্রয়াস নেই, আছে শুধু চলা, সঞ্চারিত হওয়া।
সাকম্ থেকেই আসুক বা সাঁকাল থেকে আসুক, সাঁকো কিন্তু সংক্রম থেকে এসেছে বলেই অভিধানকারদের প্রচলিত বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে দূরীভূত করার ক্ষমতা আমাদের মতো কলাম-লেখকদের নেই।
সাঁকো নিয়ে এক ঐতিহাসিক নামকরণের কথা বলা যাক। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র অন্যতম প্রাণপুরুষ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম আরবি শব্দ 'জসর' থেকে অধুনা বাংলাদেশের যশোর শহরের নাম এসেছে বলে ভেবেছিলেন। কারণ আরবি ভাষায় জসর মানে সেতু। ওই নদীমাতৃক জনপদটিতে অসংখ্য সাঁকো দেখেছিলেন তিনি। তাই জসর বা যশোর তথা যশহর নাম হয়েছিল জায়গাটির, এটাই তিনি ভেবেছিলেন। সাঁকো তাহলে আমাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের মধ্যে শৃঙ্খল রচনা করছে।
শেষে একটি কথা না বললেই নয়। মুহম্মদ ফজলুর রহমানের আরবি-বাংলা অভিধানে 'শাক' শব্দের অর্থ নল বা গাছের শাখা। দু'টি জিনিসই কিন্তু সাঁকো তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই আরবি শাক থেকে সাঁকো বা গলার সাঁকি আসছে কি না, ভেবে দেখতে হবে।
শব্দের উৎস নিয়ে ভাবতে বসে কোনও ভাষাকেই ব্রাত্য করে রাখা যায় না। তলিয়ে দেখা দরকার।