সূক্ষ্ম মসলিনে স্পষ্ট হয়ে উঠত দেহ, কোথা থেকে এসেছিল এই শব্দ?
মসলিন অবলুপ্ত হলো, মসলিন শব্দটি থেকে গেল। তবে জামদানি শাড়িকে মসলিনের রকমফের বা উত্তরসূরি বলা যায়। তবে এই মসলিন শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে।
এবারের শব্দ 'মসলিন'। ঢাকাই মসলিন বললে একডাকে চেনা যায়। বস্তুত উৎকৃষ্ট মানের মসলিন তৈরি হতো ব্রহ্মপুত্র তীরে উৎপন্ন ফুটি কার্পাসের সুতোয়। মসলিন শিল্প যে অবলুপ্ত হয়েছিল একসময়, তা সকলেই জানে। বাজার অর্থনীতির যে গ্যাঁড়াকলে পড়ে মসলিন তৈরি বন্ধ করে তাঁতিরা, তাও আমাদের জানা। দেশীয় তাঁত বস্ত্রে বিপুল পরিমাণ কর চাপিয়ে, বিলেত থেকে আমদানিকৃত বস্ত্রে অত্যন্ত কম শুল্ক রেখে অত্যাচারী ইংরেজ শাসক তাঁতিদের বাধ্য করে লোকসানের কবলে পড়ে মসলিন আর না বুনতে। অনেকের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয়, যাতে তারা আর মসলিন বয়ন করতে না পারে। তবে হাতের বুড়ো আঙুল ইংরেজরা কেটেছিল, না প্রতিবাদস্বরূপ তাঁতিরা নিজেরাই কেটেছিল, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। দু'টি মতের পক্ষেই জোরালো যুক্তি আছে।
মসলিন অবলুপ্ত হলো, মসলিন শব্দটি থেকে গেল। তবে জামদানি শাড়িকে মসলিনের রকমফের বা উত্তরসূরি বলা যায়।
এই মসলিন শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ আছে, [(মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত) মোসল > ফ্রেঞ্চ. মোসসেলিন > মসলিন]। অর্থ, কোমল সূক্ষ্ণ কার্পাস-বস্ত্রবিশেষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। মসলিন শব্দটিকে বিশেষ্য ধরে তিনি ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন, [সং মসৃণ > মসৃন(?) > মসলিন]। মসলিন বিশেষ্য পদ হলেও মসৃণ কিন্তু বিশেষণ। তবে বঙ্গীয় শব্দকোষের পরিশিষ্টে প্রচলিত ব্যুৎপত্তিটিও দেওয়া হয়েছে। লেখা হয়েছে, [Mosul( the city on the Tigris ) > Mousseline > মসলিন। Babylonian name for muslin 'sindhu' (exported from Sindh)। অর্থ, সূক্ষ্ণ বস্ত্রবিশেষ। সংসদ বাংলা অভিধানে এই দু'টি ব্যুৎপত্তিই আছে, নতুন কিছু বলা হয়নি।
আরও পড়ুন: পগেয়া শব্দটি আসলে গালাগালি না প্রশংসা? বাংলা ভাষার আজব কেরামতি
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান লিখেছে, [মসৃণ > মসলিন]। ব্রহ্মপুত্র-তীরবর্তী অঞ্চলে উৎপন্ন ফুটি কার্পাস থেকে যে এই মসলিন তৈরি হত, তাও জানানো হয়েছে।
সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ 'মসলিন' শব্দটিই নেই। নেই রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা'-তেও। কেন নেই, তা বিস্মিত করে পাঠকদের। বানানভেদে 'মশলিন' হিসেবে এন্ট্রি নেই তো? না, সে গুড়েও বালি। মসলিনকে পরিত্যাগই করেছে উক্ত অভিধানদু'টি।
নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ জানাচ্ছে,–
ইংরাজ বণিকগণ মাদ্রাজপ্রেসিডেন্সীর মছলীপত্তন-বন্দর হইতে মসলিন লইয়া যাইতেন।
তাই মছলী বা মসলী বা অপভ্রংশ মসলিয়া থেকে মসলিন আসতে পারে বলে লিখেছেন তিনি। যদিও ইরাকের টাইগ্রিসতীরবর্তী মোসল বন্দরের প্রসঙ্গও রেখেছেন। তবে মসৃণ থেকে মসলিনের বন্ধুর পথে তিনি হাঁটেননি।
মসলিন শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে ভাষাবিদরা স্পষ্টতই দু'ভাগ। একদল যখন মোসল-নগরের কথা বলেছেন, একদল সংস্কৃত বা তৎসম মসৃণ থেকে মসলিন আসার কথা বলে গেছেন। যদিও মোসল বন্দরের মসলিনের কথা বিশ্ববাসীকে সর্বপ্রথম জানিয়েছিলেন দুই সাহেব, এস. সি বার্নেল ও হেনরি ইউল, তাঁদের লেখা হবসন-জবসন অভিধানে। স্বভাবতই তাঁরা বাংলার তাঁত ও তাঁতিদের উপেক্ষা করেছেন। মসলিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছেন পশ্চিম এশিয়ার মোসল বন্দরকে, সোনারগাঁওকে নয়।
মসলিন শব্দটির আর কোনও ব্যুৎপত্তি হয় কি না, ভাবতে শুরু করলাম। হাতের কাছে থাকা অভিধানই ভরসা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হল আর কোনও ব্যুৎপত্তি আছে কি না।
'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ একটি শব্দ আছে, মসিল। মসিল( মসীল) শব্দটির অর্থ পীড়ন ও পেয়াদা। আরবি থেকে শব্দটি বাংলায় এসেছে। পীড়ন করা, পেয়াদা লাগানো-র মতো লব্জর উল্লেখও আছে এই অভিধানে।জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এও আছে মসীল শব্দটি। মানে জুলুম, উৎপীড়ন। 'মসীল করিবে রাজা দিয়ে হাথে দড়ি',- কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্য থেকে উদ্ধৃতিও তিনি দিয়েছেন। তাহলে কি এই সূক্ষ্ণ কার্পাস বস্ত্রর প্রস্তুতকারক তাঁতিদের ওপর ইংরেজ পেয়াদাদের উৎপীড়ন ও অত্যাচারের সাক্ষ্য দিচ্ছে এই 'মসলিন' শব্দটি? মসিল > মসিলি > মসিলিন > মসলিন, এই পথেই কি এসেছে মসলিন? এই পেয়াদাদের নেতৃত্বেই কি কেটে নেওয়া হয়েছিল মসলিন-তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল?
মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত 'বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অভিধান'-এ 'মসলন্দি' শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, 'রাজকীয় জাঁক-জমকপূর্ণ'। মসলিন বস্ত্র বিশেষ প্রিয় ছিল দিল্লির মুঘল রাজদরবারের মহিলামহলে। সম্রাট ঔরঙ্গজেব যে তাঁর মসলিন-পরিহিত কন্যাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন কিছু না পরে থাকার জন্য, তা মসলিনের গৌরবগাথারই পরিচায়ক। এতই সূক্ষ্ম ছিল সেই খাস-মসলিন যে, রমণীদের দেহসৌষ্ঠবও দৃষ্টিগোচর হত। কন্যারত্নটি পরে কী পরিধান করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না অবশ্য। শুধু মুঘল রাজদরবার নয়, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলিতেও মসলিনের বিরাট কদর ছিল। ফরাসি সম্রাঞ্জীদের মসলিনের পোশাক-পরিহিত নয়নাভিরাম ছবি এখনও বিভিন্ন সংগ্রহশালায় দেখা যায়। রাজকীয় মহিমায় উদ্ভাসিত ছিল মসলিন। জাঁকজমকে, আড়ম্বরে কোনও শাড়িই এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না। তাই 'মসলন্দি' শব্দটি থেকে আসতে পারে মসলিন শব্দটি। মসলন্দি > মসলন্নি > মসলনি > মসলিন।
শব্দের বিবর্তন তো এভাবেই হয়। অর্থাৎ মসলিন শব্দটি নবাবি বাংলার তথা দিল্লির ও অন্যান্য রাজদরবারে বাংলার তাঁতিদের তৈরি সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্রের প্রশংসা ও সমাদরের বাহক।
আসলে দেড়শো বছর আগে অবলুপ্ত মসলিন-শিল্প অনেকগুলি প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায়। আবার কি পুনরুজ্জীবিত করা যাবে বাংলার গর্ব এই মসলিনকে? মসলিন-বয়ন যে বংশপরম্পরায় বয়ে চলা একটি সাধনা, তা সকলেই জানে। দেড়শো বছরের পরিসরে সেই পরম্পরা নষ্ট হয়ে গেছে। হাতের আঙুলের যে সূক্ষ্ম কাজে তৈরি হত এই অপরূপ বস্ত্রসম্ভার, তা কি আর কেউ শেখাতে পারবে? মিসিং লিংকটা ধরাবে কে? তবুও চেষ্টা চলছে দু'বঙ্গেই। পরীক্ষামূলক মসলিন-নির্মাণ সফল হয়েছে। এবার দেখা যাক মসলিন শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের মতো মুঘল ও নবাবি আমলের মসলিন-গরিমা ফিরিয়ে আনা যায় কি না।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়, মসলিন শব্দটিকে 'মসৃণ' শব্দজাত ভেবে আমাদের ভাষাতাত্ত্বিকরা বিশেষ্য-বিশেষণের বিশেষ ধার ধারেননি। ভাষাবিজ্ঞানে সেটা কতটা শাস্ত্রসম্মত, তা অবশ্য জানি না।