তাঁর ডাকে হাজির হয়েছিলেন গঙ্গা! কালীসাধক কমলাকান্ত রয়ে গিয়েছেন আড়ালে

Kalipuja: যে সময় তিনি জন্মেছিলেন, সেই সময় রামপ্রসাদ সেন জীবিত ছিলেন। কিন্তু রামপ্রসাদ সেন যতটা পরিচিতি পেয়েছেন, কমলাকান্ত তা পাননি, পরিচিতির আড়ালে রয়ে গেছেন।

মাটি ফুঁড়ে 'মা গঙ্গা' আবির্ভূতা হয়েছিলেন বর্ধমানের মন্দিরে। কালীর পা চিরে রক্ত বার করেছিলেন, ঘোর অমানিশার রাতে পূর্ণচন্দ্র দর্শন করিয়েছিলেন- কথিত আছে, এমনই ছিল তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা।


সদানন্দময়ী কালী
মহাকালের মনমোহিনী,
তুমি আপনি নাচো আপনি গাও
তুমি আপনি নাচো আপনি গাও মা
আপনি দাও মা করতালি।

প্রাচীন বঙ্গদেশে শতকরা চুরাশি ভাগ কালী মন্দির তৈরি হয় ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর। বাংলায় তখন বৈষ্ণব আন্দোলনের জোয়ার, কালীপুজোর প্রচলন তখন খুব কমই দেখা যেত। তবে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, দুর্গাপুজোর অনেক আগেই কালীপুজো শুরু হয় বাংলায়, আবার কেউ কেউ বলেন সম্রাট শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে শাক্ত মন্দির নির্মাণের উপর বাধা আরোপ করায় কালীপুজোর অনুষ্ঠান প্রছন্নভাবেই রয়ে গিয়েছিল। আকবরের রাজত্বকালে উত্তরবঙ্গের রাজা কংসনারায়ণ মহাসমারোহে দুর্গাপুজো করেছিলেন। সেই সময় বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক চৈতন্যদেবের এক সহপাঠী ছিলেন 'কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ'। বঙ্গদেশে শক্তিসাধনার ইতিহাসে প্রথম সুপ্রসিদ্ধ নাম। বর্তমানে কালীমূর্তি যে রূপে পূজিত হয়, সেটা ছিল তাঁরই কল্পনাপ্রসূত। বাংলায় কালীপুজোর প্রচলন তাঁর হাত ধরেই হয় এবং কালীসাধনার অঙ্গ হিসেবে শ্যামাসংগীত ও গীত রচনার সূত্রপাত ও সেইসময় থেকেই।

মীরাবাঈ, নানক, তুকারাম, কবীর, আউল-বাউল, প্রত্যেকেই তাঁদের গানের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন, তাঁদের উপাস্য দেবতার উদ্দেশে। সেই ধারা প্রবাহিত হয়েছে রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্তের গানে। সপ্তদশ শতকে বঙ্গদেশে শ্যামাসংগীত রচনার জোয়ার এনেছিলেন দুই কালীসাধক- রামপ্রসাদ সেন (১৭১৮-১৭৭৫) ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৬৯-১৮২১)। কিন্তু আগমনী গান ও বিজয়ার গানের পদকর্তা হিসেবে সাধক কমলাকান্তই সর্বশ্রেষ্ঠ নিঃসন্দেহে।

আরও পড়ুন: অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জীবন কাটিয়েছেন ভবানী মায়ের সাধনায় || ভবাপাগলা আজও মানুষের মনে

বর্ধমান জেলার কালনায় বিদ্যাবাগীশ পাড়ায় সাধক কমলাকান্তের ভিটে। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই পাড়াতেই জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মহেশ্বর ও মা মহামায়া। মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। ঈশ্বরমুখী সন্তানকে সংসারমুখী করে তোলার জন্য অল্প বয়সেই তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু মন-প্রাণ যাঁর কালীর পদপ্রান্তে নিবেদিত, সে কী করে সংসারী হবে! জনশ্রুতি আছে, তিনি মাঠে-ঘাটে আত্মমগ্ন হয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন। কথিত আছে, একদিন রাত্রে এক অশরীরী তান্ত্রিক কাপালিক তাঁকে কালী নামে দীক্ষা দিয়ে যান এবং সেই মন্ত্র জপ করতে করতে আনন্দময়ী, নৃত্যরতা, স্মিত-আননা শ্যামা মায়ের দর্শন পান। এরপর তিনি চান্না গ্রামে মাতুলালয়ে চলে যান। বিবাহের কিছুকাল পরেই তাঁর মাতৃবিয়োগ ও পত্নীবিয়োগ ঘটে।শোনা যায়, পত্নীকে দাহ করার সময় চিতাগ্নির মধ্যে তিনি স্বয়ং জগদম্বাকে দর্শন করেন।


অশান্ত কমলাকান্ত
দিয়ে বলে গালাগালি,
এবার সর্বনাশী ধরে অসি
এবার সর্বনাশী ধরে অসি
ধর্মাধর্ম দুটি খেলি

চান্নার বিশালাক্ষী মন্দিরে আচার্য পদে থাকাকালীন মহারাজা তেজচাঁদ মহতাব (১৮০৯ সালে) কালনার রাজসভাগৃহে এক সাংগীতিক জলসার আয়োজন করেন। মহারাজা ছিলেন একজন সংগীতপ্রেমী মানুষ। এই সভায় আমন্ত্রিত কমলাকান্তের কন্ঠে, 'আদর করে হৃদে রাখো আদরিনী শ্যামা মা-কে' গানটি শুনে বিমুগ্ধ মহারাজা তাঁকে রাজপুরোহিত নির্বাচন করেন এবং পরবর্তীতে দীক্ষাও নেন।এই গানটি পরবর্তীকালে পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে, 'যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে'।

কমলাকান্তকে মহারাজা বর্ধমানে বোরহানের রাজবাড়ির সন্নিকটেই একটি বিশাল মন্দির স্থাপন করে দেন এবং সাধনার জন্য তৈরি করে দেন একটি পঞ্চমুন্ডির আসন। সেখানে আজও অনেক অলৌকিক কাহিনি শোনা যায়। কমলাকান্ত মহারাজাকে ভরা অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দর্শন করান। তিনি বলতেন, তাঁর 'মা' মৃন্ময়ী নন, তিনি জীবন্ত। কালীর প্রাণ আছে প্রমাণ করতে তিনি মহারাজা তেজচাঁদ মহতাবকে কালীর পা চিরে রক্ত বের করে দেখান। তেজচাঁদ মহতাব মাতৃহারা নিজ সন্তান প্রতাপচাঁদের পড়াশোনার ভার সাধক কমলাকান্তকে দেন। প্রতাপচাঁদও তন্ত্রমতে দীক্ষা নেন কমলাকান্তের কাছে। হয়তো সেই কারণেই তিনিও কিছুটা সংসারবিমুখ ছিলেন।

আরও পড়ুন- খাসি বা ইলিশ নয়! ইছামতির গলদা চিংড়ি ভোগে সন্তুষ্ট কৃষ্ণচন্দ্রের সাধের ইটিন্ডার সিদ্ধেশ্বরী কালী

বর্ধমান রাজ তেজচাঁদ মহতাবের [রাজত্বকাল:-১৮৩২-১৮৭৯ (আনুমানিক)] উদ্যোগে কমলাকান্তের গীতিসমূহের সংকলন-গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম প্রকাশনায় শিব, কৃষ্ণ এবং চৈতন্য মহাপ্রভু-সম্পর্কিত ২৪টি, উমা (দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা) সম্পর্কিত ৩২টি এবং ২১৩টি শ্যামাসংগীত, অর্থাৎ মোট ২৬৯টি গীত মুদ্রিত হয়েছিল। তাঁর রচনায় প্রথম লক্ষ্য করা যায় উমা-শ্যামার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সম্বন্বয়। তিনিই তাঁর রচনার মাধ্যমে প্রথম বলেন, উমাই শ্যামা।

মাত্র ৫২ বছর বয়সে এই মহান পুরুষ দেহত্যাগ করেন। শাক্ত পদাবলি এবং বৈষ্ণব পদাবলিতে তাঁর অমূল্য রচনা রেখে গেছেন। প্রচারবিমুখ এই ব্যক্তিত্ব মৃত্যুর সময় গঙ্গাস্নান করতে চেয়েছিলেন। আকুল মহারাজা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করতে উদ্যত হলেন, কিন্তু কমলাকান্ত তাঁর আরাধ্যা কালী মা-কে ছেড়ে যেতে চাইলেন না। তাঁর আকুল ইচ্ছায় মা গঙ্গা মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূতা হলেন, এমনই কিংবদন্তি শোনা যায়। পরবর্তীকালে বর্ধমানের বোরহাটের ওই মন্দিরে সেই স্থানটি কূয়ো হিসেবে বাঁধানো আছে।এর জল এখনও শুকিয়ে যায়নি। এর জল গঙ্গার জলের মতোই ঘোলা।

শাক্ত পদাবলি ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কমলাকান্ত। কবি রামপ্রসাদ সেনের পরেই এঁর স্থান। তাঁর ধর্মচেতনা, তাঁর তন্ত্রসাধনা, তাঁর ভক্তিগীতি এবং বর্ধমানের রাজপরিবারে তাঁর প্রতিপত্তি তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধকরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কমলাকান্তকে অস্বীকার করার অর্থ, বাংলার শক্তিচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এড়িয়ে যাওয়া। যে সময় তিনি জন্মেছিলেন, সেই সময় রামপ্রসাদ সেন জীবিত ছিলেন। কিন্তু রামপ্রসাদ সেন যতটা পরিচিতি পেয়েছেন, কমলাকান্ত তা পাননি, পরিচিতির আড়ালে রয়ে গেছেন।

[তথ্যসূত্র: জনশ্রুতি, কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অতনু ঘোষ]

More Articles