নকশি কাঁথার ভারতজয়, বাংলার মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণার আরেক নাম 'পদ্মশ্রী' প্রীতিকণা

Pritikana Goswami Nakshi Kantha Padma Shri : নিজের হাতে করে লালন করে চলেছেন সোনারপুরের এই বৃদ্ধা, প্রীতিকণা গোস্বামী। অবশ্য এখন স্রেফ ‘প্রীতিকণা’ নন; তিনি ‘পদ্মশ্রী’ প্রীতিকণা।

বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি থেকেই একের পর এক ফোন ঢুকছে বাড়িতে। তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা লেগেই আছে সোনারপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এই এলাকায়। বাড়ির ভেতর একমনে সূচ সুতো নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। মাথার চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা। এক অদ্ভুত আভিজাত্য ছড়িয়ে আছে তাঁর মধ্যে। একমনে সেলাই করে চলেছেন তিনি। হাতের জাদুতে একটু একটু করে ফুটে উঠছে নকশি কাঁথার শিল্প। বাংলার আবহমান এই ঐতিহ্যকে নিজের হাতে করে লালন করে চলেছেন সোনারপুরের এই বৃদ্ধা, প্রীতিকণা গোস্বামী। অবশ্য এখন স্রেফ ‘প্রীতিকণা’ নন; তিনি ‘পদ্মশ্রী’ প্রীতিকণা।

২০২৩-এর প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রথা অনুযায়ী পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা করে ভারত সরকার। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, সার্বিকভাবে দেশের প্রতি বিশেষ অবদান রাখার জন্য এই সম্মান দেওয়া হয়। প্রতি বছর আপামর ভারতবাসীর চোখ থাকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ প্রাপকদের দিকে। এবছর সেই পদ্মশ্রী প্রাপকদের তালিকাতেই উঠে এসেছে প্রীতিকণা গোস্বামীর নাম। স্রেফ সূচ-সুতোর ওপর ভরসা করে তিনি আজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন। বাংলার নকশি কাঁথার ঐতিহ্যকে পৌঁছে দিচ্ছেন নানা জায়গায়।

আরও পড়ুন : বয়স ১০২! বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন সারিন্দা শিল্পীকে পদ্মশ্রী সম্মান দেশের

কিন্তু প্রীতিকণা গোস্বামীর এই সেলাইয়ের কাজে আসা একটু আকস্মিক। বলা ভালো, একপ্রকার বাধ্য হয়ে। ছোট থেকে সেলাই বেশ ভালোই লাগত তাঁর। মায়ের হাত ধরে শিখতে শুরু করেছিলেন একটু একটু করে। নকশি কাঁথাও এভাবেই তাঁর রক্তের ভেতর ঢুকল। কিন্তু ভবিষ্যৎ যে অন্য কথা বলছিল। অচিরেই সংসারে নেমে এল অন্ধকার। তখন প্রীতিকণাদেবী ছোট্ট কিশোরী, বাধ্য মেয়ের মতো স্কুলে যান। হঠাৎই তাঁর বাবা মারা গেলেন। একমাত্র রোজগেরে মানুষটা চলে যাওয়ায় অকূল পাথারে পড়লেন তাঁর মা। মাথায় হাত প্রীতিকণাদেবীরও। মা রয়েছে, সঙ্গে পাঁচ পাঁচটি বোন। কী করে চলবে সংসার?

শেষমেশ সাধের সেলাইকেই নিজের অস্ত্র বানিয়ে নিলেন প্রীতিকণা গোস্বামী। কাঁথা তৈরি করেই সংসার চালানোর শুরু। এখান থেকেই আসল যাত্রা আরম্ভ হয় প্রীতিকণাদেবীর। এক বান্ধবীর সুবাদে পীতাম্বরি নামের একটি সংস্থায় সেলাইয়ের কাজ পান। একটু একটু করে নকশি কাঁথার পথ চলা শুরু হয়। তারপর সেই শিল্পকেই ভালোবেসে ফেলেন প্রীতিকণা। এরপর বিয়ে, সন্তান, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সূচ সুতো বন্ধ হয়নি। এটাই যে একমাত্র পথচলা তাঁর।

আরও পড়ুন : বিশ্বের ৫ কোটি মানুষকে বাঁচিয়েছে নুন-চিনি জল! মরণোত্তর পদ্মবিভূষণে সম্মানিত দিলীপ মহলানবিশ

১৯৯০ সাল। এই বছরটা বোধহয় সারাজীবন মনে রাখবেন প্রীতিকণা গোস্বামী। ততদিনে নকশি কাঁথার কাজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। তাঁর পরিচিতিও ছড়াতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ক্রাফট কাউন্সিলের তরফ থেকে নকশি কাঁথার কাজের অর্ডার আসে। হাজার হোক, বাংলার চিরন্তন বুনন শিল্প বলে কথা। প্রীতিকণাদেবীর হাতের কাজ দেখে রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে যায় কাউন্সিলের সদস্যদের। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন তাঁরা। এখান থেকেই পরিচয় আরও বাড়তে শুরু করল প্রীতিকণাদেবীর। পরের বছর, ১৯৯১ সালে তৈরি হল নকশি কাঁথার কাজ শেখানোর একটি প্রতিষ্ঠান। নাম ‘কমলাদেবী কাঁথা সেন্টার’। দায়িত্বে খোদ প্রীতিকণা গোস্বামী।

আজও তিনি এই প্রতিষ্ঠানে অজস্র মানুষকে কাজ শেখাচ্ছেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা ছড়িয়ে পড়ছেন দেশ বিদেশে। নিজের পায়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তাঁরা। এমনকী, নিজের মেয়েকেও ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়িয়েছেন। তিনিও মায়ের তৈরি নকশি কাঁথার কাজ বিদেশে পৌঁছে দিচ্ছেন। হাতে ধরে একটা বিরাট অংশের মেয়েদের স্বনির্ভর করাতে দিনভর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রীতিকণা গোস্বামী।

স্বীকৃতি এসেছিল আগেই। ২০০১ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কারও পান। তারপর ২০২৩-এর পদ্মশ্রী। প্রীতিকণাদেবী আরও অজস্র মেয়েদের কাছে এক আবেগ, অনুপ্রেরণা। তাঁর এই স্বীকৃতি কেবল তাঁর নিজের নয়; এই জয় বাংলার নকশি কাঁথার জয়। তাঁর কাকা পণ্ডিত নিখিল ঘোষও সঙ্গীতচর্চায় অবদানের জন্য একসময় পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী। এবার ভাইঝির পালা।

More Articles