জাপানের কাছে ইচ্ছাকৃত হার? স্পেনের পরাজয়ে যে বিতর্ক দানা বাঁধছে বারবার
Fifa World Cup 2022: ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে থাকা সেই লা রোজাদের এভাবে আটকে দেবে মরক্কানরা, সেটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি ফুটবল ভক্তরা।
ম্যাচের পর ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। নির্ণায়ক পেনাল্টির সময় বলটা জালে জড়ানোর পর মরক্কোর তারকা ফুটবলার আশরাফ হাকিমির নাচ এখনও মনে আছে নিশ্চয়ই। সেইসঙ্গে নিশ্চয়ই মনে পড়বে গ্যালারির কথা। জাতীয় পতাকা জড়িয়ে, গালে লাল-হলুদ রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা বহু স্প্যানিশ সমর্থকদের কান্না। কোস্টারিকাকে নিয়ে ছেলেখেলা করা স্প্যানিশ আর্মাডার এমন অবস্থা তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। টিমে বুস্কেতস-জর্ডি আলবার মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের পাশে রয়েছেন গাভি, পেদ্রি, আনসু ফাতির মতো তরুণ তুর্কিরা। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে থাকা সেই লা রোজাদের এভাবে আটকে দেবে মরক্কানরা, সেটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি ফুটবল ভক্তরা।
কিন্তু ৬ ডিসেম্বর রাতের পর এটাই আপাতত সত্যি। শেষ ১৬ থেকেই বিদায় নিতে হল ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা গোলশূন্য ড্র হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ের দিকে গড়ায়। টানটান উত্তেজনার পর শেষমেশ সেখানেও গোল আসেনি। অবশেষে নির্ণায়ক পেনাল্টি শ্যুট আউটে ৩-০ গোলে জেতে মরক্কো। তৈরি হয় ইতিহাস। আরবের প্রথম দেশ হিসেবে মরক্কো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নেয়। ২০১০-এর ঘানার পর ফের একটি আফ্রিকান দেশ বিশ্বকাপের এই পর্যায়ে পা রাখল।
অবশ্য সবটাই যে ‘ফ্লুক’, তেমনটা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোনো, হাকিমি, আমরাবাত, জিয়েকের মতো খেলোয়াড়রা এবারের মরক্কোর দলে। অনেকেই ইউরোপের বড়ো বড়ো ক্লাবে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। সেখানে নিজেদের পারফর্মেন্স দিয়েই দর্শকদের নজর কেড়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি এই বিশ্বকাপে মরক্কোর ফুটবলও অনেককে আটকে দিয়েছে। বেলজিয়ামের মতো ‘কালো ঘোড়া’কে গ্রুপ পর্যায়ে ২-০ গোলে হারিয়েছে। গতবার অর্থাৎ ২০১৮ রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গেও ড্র করে। তাই মরক্কোকে হালকাভাবে নেওয়ার ভুল করা একেবারেই অন্যায় কাজ হবে।
আরও পড়ুন : স্পেন আগেই জানত, তিনি দুর্ভেদ্য! কেন মরক্কোর গোলরক্ষককে চিনতেই হবে
আর সেই অন্যায় কাজটাই করে ফেলল স্পেন। কেন এমন কথা? পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে স্পেনের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচগুলোর কথা। কোস্টারিকার জালে সাতবার বল জড়ানোর পর লা রোজাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে রাখেন অনেকে। মাঠ জুড়ে গাভি, পেদ্রিদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল অনেককেই পুরনো স্পেনের কথা মনে করিয়ে দেয়। জাভি-ইনিয়েস্তা-ভিলাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি তৈরি হয়ে গিয়েছে? এই প্রশ্নই বারবার করেছেন বিশেষজ্ঞরা। পরের ম্যাচে জার্মানির সঙ্গে ১-১ ড্র করে স্প্যানিশ আর্মাডারা। তবে যাবতীয় বিতর্কের সূত্রপাত জাপান ম্যাচটিকে ঘিরে। ওই ম্যাচে ২-১ গোলে পরাজিত হয় স্পেন।
তবে এমনটাই নাকি লুই এনরিকেদের পরিকল্পনা ছিল বলে মন্তব্য করেন ফুটবল বিশেষজ্ঞদের একাংশের। আলভারো মোরাতা থেকে গাভি, প্রত্যেকেই অবশ্য এই হারকে ‘প্রয়োজনীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, শেষ ১৬-র লড়াই শুরুর আগে এই হার দলের জন্য ভালো। এর ফলে মনোবল বাড়বে। অথচ জাপানের ম্যাচে স্পেনকে সেভাবে আক্রমণ করতে দেখা যায়নি। এদিকে এই ম্যাচটি জিতলে স্পেন গ্রুপ ই-র শীর্ষে চলে যেত। সেই ক্ষেত্রে শেষ ১৬-এ তাদের প্রতিপক্ষ হতো ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু জাপানের সঙ্গে ম্যাচ হারার ফলে দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে স্পেন। তখন তার প্রতিপক্ষ হয়ে যায় মরক্কো। ফিফা র্যা ঙ্কিংয়ে ২২ নম্বর স্থানে থাকা একটা দেশ। অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’দের খুঁজে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করা? স্পেনের পরাজয়ের পর এই পয়েন্ট ধরেই বিষোদগার শুরু করেছেন অনেকে।
আরও পড়ুন : সংকীর্ণ কাতারে মর্যাদা পাবে ভালোবাসা? এমবাপে-জিরোডের ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে দিচ্ছে যে প্রশ্ন
অবশ্য বিশ্বকাপ শুরু আগেই বিতর্ক শুরু হয়েছিল স্পেনকে নিয়ে। সৌজন্যে তাদের কোচ লুই এনরিকে এবং তাঁর বেশকিছু পরিকল্পনা। এর আগে বিশ্বকাপে স্পেনের জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী ছিলেন দুই তারকা। একজন হলেন ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের গোলরক্ষক ডেভিড দে জিয়া, অন্যজন হলেন প্রাক্তন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা সার্জিও র্যা মোস। ইংল্যান্ডের মাটিতে দে জিয়ার সাম্প্রতিক ফর্ম যে খারাপ, তা বলা যাবে না। অন্যদিকে মাঠে র্যা মোসের উপ্সথিতি বরাবর বাড়তি উদ্দীপনা তৈরি করে। কেবল ডিফেন্ডার নন, গোল তৈরি করা ও গোল করার ব্যাপারেও সিদ্ধহস্ত র্যা মোস। সেইসঙ্গে আছে নেতৃত্বদানের সহজাত ক্ষমতা। এই দুই খেলোয়াড়কে এবারের বিশ্বকাপের দলে নেওয়া হয়নি।
এ নিয়েই শুরু হয়েছিল বিতর্ক। লুই এনরিকে নিজে বার্সেলোনায় খেলেছেন, কোচিং করিয়েছেন। স্পেনের টিমে যারা আছেন, তাঁদের অনেকেই বার্সেলোনার খেলোয়াড়। সেখানকার অ্যাকাডেমি থেকে উঠে এসেছেন। তাহলে কি নিজের মডেলের, নিজের পছন্দের বার্সা লবিই এনরিকের একমাত্র অবলম্বন? ম্যাচ হারার পরও নিজের স্টাইল আর তত্ত্বের জায়গা থেকে এক চুলও নড়েননি এনরিকে। খেলোয়াড়রাও যে তাঁর সেই তত্ত্ব মেনে চলেছেন, সেই কথাও বলেছেন বারবার।
আরও পড়ুন : বিকিনিতে আটকে চোখ, কাতারের স্টেডিয়ামে ঝড় তোলা এই সুন্দরীকে চেনেন?
এদিকে ম্যাচের আগেই খেলোয়াড়দের ১০০০ বার পেনাল্টি প্র্যাকটিস করার কথা বলেছিলেন স্প্যানিশ কোচ। ফলাফল? সেটা তো চোখের সামনেই। মরক্কোর চারটে শটের মধ্যে একটা বাঁচিয়েছেন স্পেনের গোলরক্ষক উনাই সিমোন। কিন্তু স্পেনের তিনটে শট জালে জড়াতে পারেনি। প্রথম শট লাগে বার পোস্টে। বাকি দু’টি শট বাঁচিয়ে নায়ক হয়ে যান মরক্কোর গোলরক্ষক ইয়াসিন ‘বোনো’ বুনৌ। পেনাল্টির এমন অসুখ অবশ্য স্পেনের নতুন কিছু নয়। ২০২০-র ইউরোতে ইতালির বিরুদ্ধে, ২০১৮-র বিশ্বকাপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং ২০০২-র বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধেও একইরকম ঘটনা। পেনাল্টি শ্যুট আউটে পরাজয়।
ফুটবল বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, লুই এনরিকের কি আদৌ কোনও প্ল্যান বি ছিল? প্রত্যেক কোচের নিজস্ব ফুটবল দর্শন থাকে, খেলার চলন থাকে। কিন্তু এখন প্রযুক্তি আর ডেটা অ্যানালিসিসের যুগে সেই ট্যাকটিক্স বুঝে নিতে বিপক্ষের খুব একটা সময় লাগে না। সেই জায়গায় সবসময় প্ল্যান বি, সি, ডি রাখতে হয়। যুদ্ধ জেতার নানারকম ফন্দিফিকির আর কি!
বিশেষজ্ঞদের দাবি, স্পেনের কোচের কাছে সেরকম বিকল্প ছক তৈরিই ছিল না। প্রতিটা ম্যাচে পাস, পজেশন আর অ্যাকিউরেসির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, শেষরক্ষা হল না। কোস্টারিকা ম্যাচের পর এই পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করেই স্পেনকে আক্রমণ করেছিলেন গ্যারি নেভিল। তিনি যে ভুল নন, সেটা প্রমাণ করল মরক্কো।