অভিনয়ে বাজিমাত করল চিল, উৎপল দত্ত বললেন, 'অবিশ্বাস্য'
রেশনের ব্যাগে করে দু'টি চিল নিয়ে স্টুডিওতেও হাজির হলেন এক ভদ্রলোক। মিনমিন করে বললেন, 'একজোড়া চিল এনেছিলাম। নেবেন কি?'
'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর সেট। কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। মানে ব্যাপারটা রীতিমতো পাগলামির পর্যায় গিয়ে ঠেকেছে। একটি মাত্র বাক্যবন্ধ "কী আনন্দ!" সে আনন্দ যে এমন শাঁখের করাত হয়ে উঠবে, তা কি কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল! খেতে বসেছে সবাই। হঠাৎ ঠাকুরকে সম্বোধন করে, "ও ক্ষেত্র, ডালটা যে একেবারে নুনে পোড়া। কী আনন্দ!" অথবা শুটিং চলছে। হঠাৎ কর্মচারীদের একজন আর্তনাদ করে উঠলেন, 'চিলটা আমায় মোক্ষম ঠুকরে দিয়েছে। কী আনন্দ!" আপাতভাবে মনে হতে পারে শুটিং-এর মাঝে আনন্দের আর্তনাদ এবং চিলের ঠোক্করের মতো অবাঞ্ছিত জিনিসদু'টির অনুপ্রবেশ ঘটল কীভাবে! যোগসূত্রটাই বা কী? আছে আছে। সে যোগসূত্রের নাম তরুণ মজুমদার। সেসময় বাংলা সিনেমায় চিল নিয়ে শুটিং করার দুঃসাহস বোধহয় আর কেউ দেখাননি। তবে তার আগে 'কী আনন্দ'-র ফয়সালা দরকার।
পান্নালাল মুখুজ্যে চরিত্রটা লোভী, ওপর-চালাক এবং গবেট। উৎপল দত্তর কমিক টাইমিং বরাবরই চমৎকার। পরিচালক দেখছেন, চরিত্রটা অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলছেন উৎপল। হঠাৎ পরিচালকের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। উৎপলকে ডেকে বললেন, যদি পান্নালালের প্রত্যেকটা কথার শেষে একটা মুদ্রাদোষ দেওয়া যায়, তবে গবেট ব্যাপারটাও ফোটে ভালো আর হাস্যরসও জমে যায়। যে কোনওরকম কথার শেষেই উল্লাসধ্বনি, "কী আনন্দ!" উৎপল দত্তর ব্যাপারটা পছন্দ হল। কিন্তু তাতেই কেলেঙ্কারি। দেখা গেল শুটিংয়ে তো বটেই, তার বাইরেও যত্রতত্র ভদ্রলোক ও জিনিস বলে যাচ্ছেন। খুঁড়িয়ে হাঁটছেন একদিন। পরিচালক ডেকে বললেন, কী হয়েছে আপনার? সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল, "বাথরুমে একটু পড়ে গিয়েছিলাম। কী আনন্দ!" পরিচালকের মাথায় হাত। "সর্বনাশ! চোট পাননি তো? ডাক্তার ডাকব?" হাঁ হাঁ করে উঠলেন উৎপলবাবু। "একেবারে না। ওরা এসেই তো ক'টা ইঞ্জেকশন ঠুসবে। এই কারণেই আমার দু'চক্ষের বিষ। কী আনন্দ!" গতিক দেখে আর কথা বাড়ালেন না তরুণ মজুমদার। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল রোগটা ছোঁয়াচে। সেটের সবাই কথায় কথায় "কী আনন্দ" হেঁকে উঠছেন।
এবার চিল প্রসঙ্গ। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মূল গল্পে আর পাঁচটা চরিত্রের মতোই ছিল একটি চিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। রসিকের তখন সবে বিয়ে হয়েছে পান্নালাল মুখুজ্যের মেয়ের সঙ্গে। তা সেই প্রথম রসিক বউয়ের জন্য প্রেমপত্র লিখেছে। প্রথম চিঠি বলে কথা। ছাদে সব সাঙ্গোপাঙ্গদের জড়ো করে রসিক একবার চিঠিতে কতখানি প্রেম ঢালা হয়েছে, তা যাচাই করে নিচ্ছিল। 'হরিদাসের গুপ্তকথা' থেকে চুরি করে লেখা। কাজেই গোপনীয়। ধরা পড়লে বড়রা পিঠের ছালচামড়া গুটিয়ে দেবে। চারদিক বাঁচিয়ে নিচু গলায় বন্ধুদের সামনে সে সবে শুরু করেছে, "প্রাণাধিক প্রিয়তমা"… আর প্রিয়তমা! কোত্থেকে এক চিল এসে ছোঁ মেরে চিঠিসমেত আকাশে। ছেলেছোকরার মাথায় হাত। চিঠি না হয় আরেকখানি লিখে নেওয়া যাবে। কিন্তু খাবার নয় দেখে একটু পরেই চিঠিখানি ফেলে দেবে চিলটা। দৈবাৎ যদি সে চিঠি গুরুজনদের হাতে পড়ে… চিলের পিছনে ধাওয়া করে রসিক তার পল্টন নিয়ে। দৌড় দৌড় দৌড়। ওপরে চিল, নিচে ছেলের দল। ধানক্ষেতের কাদা মেখে, টিলা থেকে গড়িয়ে, চাষির বাড়িতে সেদ্ধ হতে থাকা ধানের পাত্র উল্টিয়ে চিঠি উদ্ধারকারী দল ছুটে চলেছে। লক্ষ— পাখির পা। হঠাৎ ঝপাস ঝপাস করে কতগুলো শব্দ ওঠে। দিঘির জলে নাকানিচোবানি খায় গোটা দলটাই। উচ্চাকাঙ্ক্ষায় অধোতল জরিপের সুযোগ পায়নি। সেই ফাঁকে চিল প্রেমপত্র নিয়ে হাওয়া।
আরও পড়ুন: রাশভারী ব্যক্তিত্ব, এদিকে মুখে অনর্গল অশ্লীল কথা? কাঁচা খিস্তির ক্লাস নিতেন কমল মিত্র ও বিকাশ রায়
এই দৃশ্য তরুণ মজুমদার রাখবেনই ছবিতে। কিন্তু চিলের ব্যবস্থা হবে কীভাবে! একটা দিয়ে তো আর কাজ হবে না। বেশ কয়েকটা চিল প্রয়োজন। একজন সুপরামর্শ দিল, ভাগাড়ের দিকে দেখতে পারেন। কয়েকদিন ধরে ভাগাড়ে চক্কর দিয়েও সুবিধা করতে পারলেন না। ধাপার মাঠের সুবাস যাকে বলে "নাকেরও ভিতর দিয়া মরমে পশিল", কিন্তু 'হায় চিল', তাঁদের পাত্তাই দেয় না। শেষে দৈনিক কাগজে বিজ্ঞাপন বেরলো,
চিল চাই
আমাদের আগামী ছবি 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এ কাজ করার জন্য বেশ কয়েকটা চিল চাই। যাঁরা সরবরাহ করতে পারবেন তাঁদের চিলপিছু ২০০্ সম্মান-দক্ষিণা দেওয়া হবে। উপরন্তু ছবির টাইটেল কার্ডে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করা হবে। চিল-সংগ্রহকারীরা নিম্নলিখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করবেন:
নিখিল সেনগুপ্ত
টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো/
টালিগঞ্জ। কলকাতা
বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগে প্রযুক্তি অত উন্নত ছিল না। শুটিং নিয়ে হাজারও গল্প রয়েছে। কিন্তু চিল চেয়ে বিজ্ঞাপন বা চিল দিয়ে শুটিংয়ের গল্প বোধহয় আর দু'টি নেই।
বিজ্ঞাপন তো হলো, কিন্তু ভবি ভোলার নয়। একদিন যায়, দু'দিন যায়, চিল আর আসে না। শেষে হপ্তাদুয়েক যখন কেটে গিয়েছে, তখন হঠাৎ প্রথম খবরটা এল। এরপর একে একে নানা জায়গা থেকে চিলের খবর আসতে শুরু করল। এমনকী, রেশনের ব্যাগে করে দু'টি চিল নিয়ে স্টুডিওতেও হাজির হলেন এক ভদ্রলোক। মিনমিন করে বললেন, 'একজোড়া চিল এনেছিলাম। নেবেন কি?' চিলজোগাড় যজ্ঞ শেষে দেখা গেল গোটা চোদ্দো চিল জোগাড় হয়েছে। তাই নিয়ে দলবল রওনা দিল ইলামবাজারের দিকে। সেখানে বাংলো বুক করা হয়েছে। পাশের একটা ফাঁকা কোয়ার্টারে খাঁচাবন্দি চিলেরা।
পরদিন ছাতের সিন শুট করা হবে। এককোণে চিলেদের খাঁচাসমেত টেকনিশিয়ান, ক্যামেরা সব। অন্য কোণে রসিকবেশী অয়ন। হাতে চিঠির খাম। তাতে ঠিকানা লেখা। চিঠির জায়গায় সাদা কাগজ। যেই সে চিঠি পড়তে যাবে ক্যামেরা এদিক থেকে একটা চিল তার হাতের উপর ছুঁড়ে দেবেন তরুণ মজুমদার। কায়দা করে তারই ফাঁকে খামটা মাটিতে ফেলে দেবে অয়ন। ক্যামেরা উড়ে যাওয়া চিলটায় ফোকাস করবে। তার পায়ে আগের থেকেই আরও একটা একই রকমের খাম ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দর্শক সিনেমায় দেখবেন, রসিকের হাত থেকে ছোঁ দিয়ে খাম নিয়ে গেল চিলে। প্রতিটা শটের জন্য এক-একটা চিল বরাদ্দ। কারণ চিল পরিচালকের নির্দেশের খুব একটা পরোয়া করে না। সে উড়বে মর্জিমতো। শট নিতে হলে কেটে কেটে চিলের ওড়ার শট নিতে হবে, আলাদা আলাদা চিল উড়িয়ে।
দস্তানা পরে চিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরিচালক। অয়ন যেই চিঠিটা পড়তে শুরু করেছে অমনি চিলটাকে তার হাতের ওপরে ছুঁড়ে দেওয়া হল। প্রথম অংশটা একদম ঠিকঠাক উতরে গেল। এবার চিলের উড়ে দূরে যাওয়ার পালা। কিন্তু বিধাতা মুচকি হাসলেন। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ক্যামেরার নজর বরাবর ওড়ার কোনও ইচ্ছেই চিলটার নেই। সে একটু এগিয়ে গিয়ে দিব্য গোঁত্তা মেরে উল্টোদিকে চলল। ক্যামেরা ঘুরিয়ে শট নেওয়ারও কোনও উপায় নেই। এদিকে চিলের তেরোটা খাঁচা, ইউনিটের সমস্ত টেকনিশিয়ান। কাজেই কাট। একটা শট পুরোপুরি হলো কি হলো না একখানা চিল খরচ হয়ে গেল। পরিচালক কিঞ্চিৎ গম্ভীর মুখে হাঁকলেন, "নেক্সট চিল হাজির করুন।" ইউনিটের নাজেহাল অবস্থা দেখে বোধহয় করুণাই হলো ঈশ্বরের। দ্বিতীয় চিশটা বেশ সোজা পথে উড়ে মিলিয়ে গেল দূরে। পারফেক্ট শট। পরেরগুলোর তোড়জোড় করছেন সবাই। তিন নম্বর চিলটাকে বের করা হয়েছে। এমন সময়, "কী আনন্দ!" তরুণের সহকারী ধ্রুব পড়ি কি মরি ছুটে এসে খবর দিল, "ফিরে এসেছে! ওই চিলটা ফিরে এসেছে আবার।" সবাই থ। দ্বিতীয় চিলটা দিব্যি ফিরে এসে বসেছে রেলিংয়ের ওপর। নির্বিঘ্নে খানিক আদরও খেল পরিচালকের কাছে। তিন নম্বর চিল বাতিল। ঠিক হলো, একে দিয়েই শুটিং হবে। পরের শটও পারফেক্ট। ফের চিল এসে বসল রেলিংয়ে। উৎপল দত্ত চমৎকৃত হয়ে বললেন, "আনবিলিভেবল্!"
এলপর নানা অ্যাঙ্গল থেকে নানান জায়গায় শট নেওয়া হলো। ইউনিটের ইলেকট্রিশিয়ান পিন্টু ওর নাম দিল ফিরু, যে ফিরে ফিরে আসে। শট দিতে দিতে একটু দূরে চলে গেলেই ডাকা হয়, ফিরু ফিরু… হাওয়ায় বাঁক নিয়ে ফিরে আসে সেই অবাক পাখি। পাখিটার সঙ্গে সবারই বেশ দোস্তি। সে আর খাঁচায় থাকে না। গোটা ক্যাম্পে রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। তদারক করে কাজকর্ম। সন্ধের পর হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে পরের দিনের পরিকল্পনা চলে। গোল হয়ে বসে আলোচনা হয়। হঠাৎ খুট খুট শব্দ। বাইরে থেকে মহারাজা ঢুকছেন। মেঝেতে নখের আওয়াজ তাই। এসে একপাশে বসে পড়ে। মন দিয়ে আলোচনা শোনাটা যেন তার খুবই দরকার।
অবশেষে শুটিং শেষ। অজয়ের ধারে এগারোটা চিলকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু ফিরুকে তখনই ছাড়া হলো না। পরদিন ক্যাম্প গুটিয়ে কলকাতায় ফেরার পথে কাঁকসার জঙ্গলে নামানো হলো তাকে। নড়ে না। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ অবধি কনভয়ের নজরে রইল, নড়ল না ফিরু।
কিন্তু পথ অফুরান। তাতে হাজারও বাঁক। প্রতি বাঁকের আড়ালে লাখো গল্প, কোটি চরিত্র। এক একটি নতুন দাগে পুরনো দাগ আপনি ঢেকে আসে। কনভয়ের গতির বাঁক এক সময় নজর থেকে মুছে ফেলল ফিরুকে। হয়তো জঙ্গলে উড়ে গিয়েছিল সে। হয়তো পথের ধারে অপেক্ষায় ছিল আরও খানিকক্ষণ। আর 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর ইউনিট? একদিক দিয়ে তারা তো বঞ্জারা-ই। সারাজীবন এ তাঁবু থেকে ও তাঁবু, এ কাজ থেকে ও কাজ, নতুন নতুন প্রাণী... মায়া সেখানে নিষিদ্ধ। ফেরার আশা বন্ধ্যা। সেখানে সঞ্চয় কেবল ছবি, ছেপে নেওয়া সীমিত অতীতটুকু।
তথ্য ঋণ:
সিনেমাপাড়া দিয়ে (দু'খণ্ড), তরুণ মজুমদার, দে'জ প্রকাশনী