লক্ষ্য ডাক্তার হওয়া, এক পা হারিয়েও জীবনযুদ্ধ থামেনি কাশ্মীরি বালকের

সত্যি বলতে গেলে, মানসিক জেদ এবং কোনও কাজের প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠা থাকলে সবরকম বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয় মানুষ। এক বালকের জীবনকাহিনি যেন তেমনই বার্তা দিচ্ছে। জীবনযুদ্ধে হার মানা যে উচিত নয়, নিজের জীবনের প্রতিটি পদে সেই কথাটি যেন প্রমাণ করে চলেছে জম্মু ও কাশ্মীরের হান্দওয়ারারের এক প্রতিবন্ধী বালক।

নাম, পারভেজ আহমেদ। জম্মু ও কাশ্মীরের হান্দওয়ারার বাসিন্দা তিনি। ছোটবেলায় এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পা হারান পারভেজ। তবে সেই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দমে থাকে না ছোট বালকটি। ধীরে ধীরে নিজের জীবনকে সাফল্যের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংগ্রাম চালায় সে। কেবল প্রতিবন্ধী বলে জীবন কি আটকে থাকবে? একদমই নয়, বর্তমানে সকল প্রতিবন্ধকতাকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে পড়াশোনা করে চলেছে সে।

জানা গিয়েছে, বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয় হলেও প্রতিদিন সেই রাস্তা অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলে পারভেজ। সেই পথে একাধিক বাধা এলেও তা পেরিয়ে নতুন আলোর সন্ধানে এগিয়ে চলে সে। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় তার এই জীবনযুদ্ধের কাহিনি উঠে আসায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছে নেটিজেনরা। কীভাবে এক বালক কেবলমাত্র জেদের বশেই একের পর এক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে, তা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না দেশবাসীর।

আরও পড়ুন: চোরাশিকারিদের ত্রাস, বন্যপ্রাণীদের বুকে আগলে রাখেন এই মানুষটা

পারভেজকে তার সংগ্রামের কাহিনি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় সে বলে, "আমরা যে এলাকায় থাকি, সেখানকার রাস্তা খুব একটা ভালো নয়। ছোট থেকেই দেখে আসছি রাস্তা খারাপ। তবে আমাকে যদি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়, তবে বিদ্যালয়ে পৌঁছতেই হবে। সেই কারণে এক পায়ে ভর দিয়ে কোনওমতে পৌঁছে যাই স্কুলে। তবে সত্যি বলতে গেলে, এতে অসুবিধেও হয় অনেক। সেই কারণে যদি একটি কৃত্রিম অঙ্গ পাওয়া যেত, তাহলে স্কুল যাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য একাধিক কাজ করতেও সুবিধে হতো।" সাক্ষাৎকারজুড়ে পারভেজের করুণ আর্তি ছড়িয়ে পড়ে সকলের কাছে। বর্তমানে তার এই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরেই সকলে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় ছোট পারভেজকে এবং এরপরেই বালকটির সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন জয়পুর ফুট ইউএসএ-র প্রধান প্রেম ভান্ডারি।

তবে শুধু স্কুল যাওয়াই নয়, বাড়ির ছোটখাটো কাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভিন্ন কাজে হাত লাগিয়ে চলে পারভেজ। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা যেন তার সামনে কোনও বাধা বলে বিবেচিতই হয় না। তার এই অদম্য লড়াই দেখে বিনামূল্যে তাকে কৃত্রিম অঙ্গ প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জয়পুর ফুট ইউএসএ-র প্রধান প্রেম ভান্ডারি। এই সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, "সম্প্রতি পারভেজ আহমেদের জীবনযুদ্ধের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ‍্যাল মিডিয়াজুড়ে। এরপরেই আমি এবং আমার পরিবার আবেগঘন হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ওই বালকটিকে আমাদের কোনও না কোনওভাবে সাহায্য করতেই হবে। সেই কারণে আমরা ওর বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং খুব দ্রুত ওকে বিনামূল্যে কৃত্রিম অঙ্গ দান করা হবে। আশা করা যায় যে, এরপর পারভেজের সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।"

উল্লেখ্য, বর্তমানে পারভেজ জম্মু ও কাশ্মীরের নওগাঁয় একটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে পারভেজ। নবম শ্রেণির এই বালকের লক্ষ্য ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়া এবং পিছিয়ে পড়া মানুষকে সাহায্যর মাধ্যমে সমাজে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করা। পারভেজের এই অপরাজেয় মনোভাব প্রসঙ্গে তার এক স্কুলশিক্ষক জানান, "পারভেজ ছেলে হিসেবে খুব ভালো। ও প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। তবে শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাই নয়, অন্যান্য একাধিক ক্ষেত্রেও যোগদান করে ও। দেখে কেউ বলতেই পারবে না যে, কত বড় সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে চলেছে পারভেজ। তাই আমরা চাই ভবিষ্যতে ও আরও এগিয়ে চলুক।"

তবে পারভেজের এই জীবনযুদ্ধকে একদম সামনে থেকে যাঁরা দেখে চলেছেন, তাঁরা হলেন পারভেজের বাবা ও মা। ছোট থেকেই ছেলের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে চলেছে তাঁর গোটা পরিবার। এক্ষেত্রে পারভেজের বাবা গোলাম আহমেদকে ধরা হলে আবেগঘন দেখায় তাঁর গলা। তিনি বলেন, "পারভেজ যখন খুব ছোট ছিল, তখন এক ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড হয়, আর সেই ঘটনায় ও নিজের পা হারায়। প্রথমে স্বভাবতই আমরা প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রী বর্তমানে হার্টের রোগী। এছাড়া পারভেজের সঙ্গে যখন ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে, সেই মুহূর্তে আমি বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম না। দুর্ভাগ্যবশত তাই আমি ছেলেকে উদ্ধার করতেও অক্ষম হই। তবে ভগবানের করুণায় সেই যাত্রায় বেঁচে যায় ও।"

পারভেজের বাবা আরও বলেন, "সেই অগ্নিকাণ্ডের পর পারভেজের অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে তিন লক্ষ টাকা দাবি করে বসে। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কাছে এত টাকা ছিল না। তবে আমরা কেউ হার মানিনি। ছেলেকে সুস্থ করে তোলাই ছিল সেই মুহূর্তে আমার একমাত্র দায়িত্ব আর সেই কারণে সব চিন্তা ভুলে সমস্ত সম্পত্তি আমি বিক্রি করে দিই। সেই টাকায় সুস্থ করে তোলা হয় ছেলেকে। কিন্তু বর্তমানে পারভেজ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলেছে। প্রতিদিন প্রায় দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তাকে স্কুল যেতে হয়। তাই আমি সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ করতে চাই যে, আপনারা আমার ছেলেকে সহায়তা করুন যাতে ও কিছুটা হলেও বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতির হাত থেকে স্বস্তি পায়। শুধু পড়াশোনাতেই নয়, বিভিন্ন খেলাধুলোর প্রতিও ঝোঁক রয়েছে পারভেজের। তাই আমি চাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও এগিয়ে চলুক।"

 

More Articles