হু হু করে বাড়ছে সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম, শিশুকে নিরাপদ রাখতে এই নিয়ম মানতেই হবে
দেশ-বিদেশে বহু শিশুর এভাবে মৃত্যু হয়েছে। তবে এই অসুখের কারণ আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হলেও কিছু রোগের ব্যাপারে চিকিৎসাশাস্ত্র আজও দিশা দেখাতে পারেনি। তেমনই একটা সমস্যা হল সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম ( SIDS)। এর অর্থ, এক বছরের কমবয়সি শিশুর হঠাৎই ঘুমের মধ্যে মৃত্যু। আবার অনেক সময় দেখা যায়, জন্মানোর কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা যায় দুধের শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা না করালে অনেক সময় তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হয় এই রোগে। দেশ-বিদেশে বহু শিশুর এভাবে মৃত্যু হয়েছে। তবে এই অসুখের কারণ আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানীর মতে, সাধারণত রক্তে বুটিরিলকোলিনেস্টেরাস (BChE) নামে এক ধরনের উৎসেচক কমমাত্রায় থাকার কারণেই শিশুদের রহস্যজনকভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। এই অসুখ 'কোট ডেথ' নামেও পরিচিত। পশ্চিমের দেশগুলোতে কয়েকহাজার শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এসআইডিএস। এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন' জানিয়েছে যে, প্রত্যেক বছর অজানা কারণে প্রায় ৩,৪০০ জন শিশু আচমকাই মারা যায়। অপর দিকে, ব্রিটেন জানিয়েছে যে, বছরে প্রায় ২০০ জন শিশুর প্রাণ যায় এমন অজানা কারণে। অস্ট্রেলিয়ায় এই রোগের চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষণা অনেক দূর এগোলেও এসআইডিএসের নির্দিষ্ট সঠিক কারণ এখনও অজানাই রয়ে গেছে।
সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (এসআইডিএস) কী?
সাধারণত ঘুমের সময় এক বছরের কম বয়সি কোনও সুস্থ শিশুর আচমকা মৃত্যুকেই সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিমড্রোম বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১ থেকে ৪ মাস বয়সের মধ্যে শিশুদের এসআইডিএসের কারণে মৃত্যু হতে দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ঘাতক হৃদরোগ প্রাণ নিল কে কে-র, কীভাবে আগেভাগে আপনি চিনবেন আসন্ন বিপদকে?
অনেক চিকিৎসক মনে করেন যে, শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ ও জেগে থাকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে অংশ দায়ী তার কোনও সমস্যা হলে এসআইডিএসে মৃত্যু হতে পারে শিশুর। শীতের দেশে এই কারণে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই বেশি। আমাদের দেশে শীতকালে এই সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।তাই এই সময় গর্ভবতী মা এবং সদ্য মায়েদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন।
মৃত্যুর কারণগুলি কী কী?
এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও যে যে-ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেড়ে যায় সেগুলি হল:
১. যেসব শিশু জন্মানোর সময় কম ওজন নিয়ে জন্মায়, তাঁদের ঝুঁকি স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী শিশুদের তুলনায় বেশি হয়।
২. গর্ভাবতী অবস্থায় ধূমপান চালিয়ে গেলে বা হবু মায়ের সামনে যদি বাবা অথবা অন্যরা সিগারেট-বিড়ি খান, তাঁদের শিশুদের এসআইডিএসের ঝুঁকি অনেক বেশি।
৩. নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম হলে, অর্থাৎ প্রিম্যাচিওর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আচমকা হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৪. দেখা গেছে, শিশু হিসেবে ছেলেদের ঝুঁকি মেয়েদের তুলনায় বেশি।
৫. ২০ বছরের থেকে কম বয়সে সন্তানের জন্ম দিলেও ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম’-এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৬. গবেষণায় দেখা গেছে একটি শিশুর যদি এমন আচমকা মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে পরবর্তী সন্তানের মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় দশ গুণ বেশি হয়।
৭. বাচ্চাদের উপুড় করে ঘুম পাড়ালেও অনেক সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই সবসময় চেষ্টা করুন, বাচ্চাকে নিচের দিকে পিঠ রেখে শোয়াতে।
৮. বাচ্চার গায়ে কম্বল বা অন্য ভারী কিছু চাপা দিয়ে রাখলেও মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ে।
৯. পাহাড়ি অঞ্চলে অথবা খুব বেশি ঠান্ডার সময় শিশুর ঘরে রুম হিটার বা কাঠ-কয়লা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। যার থেকে আচমকা মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
১০. অত্যন্ত নরম বিছানায় ঘুম পাড়ালেও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।
গবেষণা কী বলছে ?
ই-বায়ো মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এসআইডিএসে যে-সকল শিশুর মৃত্যু হয়, তারা অন্য শিশুদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়।এক্ষেত্রে গবেষকরা ৬৫৫ জন সুস্থ শিশু, এসআইডিএসের কারণে মৃত ২৬ জন শিশু এবং অন্য কোনও কারণে মৃত্যু হওয়া ৪১টি শিশুর শুকনো রক্তের মধ্যে তুলনা করে দেখেন। গবেষণায় দেখা যায় যে, এসআইডিএসের কারণে মৃত দশটি শিশুর মধ্যে নয় জনের বিসিএইচই উৎসেচকের মাত্রা অন্য দু'টি বিভাগের শিশুদের তুলনায় কম রয়েছে। এই বিসিএইচই উৎসেচক শিশুর জেগে থাকা, মাথা ঘোরানো এবং শ্বাস নেওয়ার জন্য সংকেত পাঠায়। শিশুর শরীরের রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো শারীরিক কাজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে এই উৎসেচক বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেননি তাঁরা। তাই ভবিষ্যতেও এই অসুখের চিকিৎসা কীভাবে করা হবে, এখন সেটাই দেখার।
করণীয়
কিছু কথা মাথায় রাখলে শিশুমৃত্যু খানিকটা হলেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
১. বাচ্চাকে উপুড় করিয়ে ঘুম পাড়াবেন না। চেষ্টা করুন, সোজা করে শুইয়ে রাখার।
২. আশেপাশের কেউ ধূমপান করলে গর্ভাবস্থায় বা ছোট দুধের শিশুকে তাঁর থেকে সেই সময় দূরে রাখুন।
৩. ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাতে ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরিয়ে রাখুন। মোটা কম্বল ব্যবহার না করাই ভালো।
৪. সদ্যোজাত শিশুকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন।
৫. কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার পদ্ধতি সব মা-বাবাদের জেনে রাখা ভালো। কোনও সমস্যা হলে দ্রুত কাছাকাছি চিকিৎসকের পরমার্শ নিন। কোলের সন্তানকে নিয়ে সুস্থ থাকুন।