গুফ্তগু : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
Bengali Short Story: সাধন বৈরাগীকেও আমি শেষ দেখেছিলাম এই কাঁকড় বিছনো পথেই। গরুড় সেজেছিল না অন্য কিছু জানি না। হয়তো পাখি হতে চেয়েছিল।
সন্ধ্যা ঘনায়। খাঁ সাহেব চোখ বন্ধ করে প্রথমে সরগম গেয়ে উঠে তান বাঁধেন, তারপর আলাপের সুর ধরেন সারেঙ্গিতে। ছায়ানট। জানলা দিয়ে ধেয়ে আসে পাহাড়তলির ঝোড়ো বাতাস, ধাক্কা দেয় জানলার পাল্লায়। মোম-শিখার এই নড়েচড়ে ওঠার মধ্যেও একটা ছন্দ আছে। নিভে যেতে পারে জেনেও তাই ধেয়ে আসা বাতাসের নাগালের কাছাকাছি রাখি তাকে। ঘরে দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ে সেই তরঙ্গের অনুনাদ।
খাঁ সাহেব তো বাজিয়েছিলেন সেই কবে... রেকর্ডিং থেকে গেছে ছায়ানটের। একটা কায়দার গ্রামোফোন বা ডিস্কপ্লেয়ার থাকলে, স্মৃতিরাও এমন ঘুরে ঘুরে বেজে উঠতে পারে। দিনের সব শব্দ আর শোর ঘুমিয়ে পড়লে, তার আরোহন অবরোহণ স্পষ্ট হয়। সেই সব কিছুই রাত্রিকালীন। "সারা নিশি ধরি তারায় তারায় অনিমেষ চোখে নীরবে দাঁড়ায়..."
খাঁ সাহেবের পরিচয় দেওয়ার আগে উস্তাদ ব্যবহার করা হত কিনা জানি না। আমি তো বসে থাকতাম জানলার পাশে কান পেতে। সে ভাবে কথাই হয়নি কোনওদিন। তাঁর জনাজা নিয়ে চলে যাওয়ার পর অনেকের মনে হল— তানপুরা আর সারেঙ্গিটার কী হবে। কেউ একজন বলেছিল, খাঁ সাহেবের সঙ্গেই দাফন করে দিতে। আত্মীয়রা রাজি হয়নি। তারপর আর যা কিছু... বিক্রি হয়ে গেল। বাড়ির চাকরের থেকে চোরাই মালের মতো নিয়ে এসেছিলাম কিছু ক্যাসেট। তখন ডিস্ক আর গ্রামাফোনের দিন পার হয়েছে।
খাঁ সাহেব তো বাজিয়েছিলেন সেই কবে... এখন শুধু জানলাটা আছে। আর আমি। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট আসে... হাওয়ায় হাওয়ায় পাল্লা তাল ঠোকে। আর হাত দুটো কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসে থাকি মাজারের এক কোণে। বিজলি চলে গেলে মোমবাতি তাল মেলায় ছায়ায় ছায়ায়। ক্রমে ঝালার দিকে এগিয়ে যান খাঁ সাহেব। এই সব কিছুই রাত্রিকালীন।
ধোঁয়াশা আর মেঘ ভেসে আসে। আপাত একই রকম হলেও একজন অন্তঃসার শূন্য আর একজন অন্তঃসত্ত্বা। প্রত্যাশা আর প্রতীক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়। পাহাড়তলির জনপদে অনেকটা নিচে নেমে আসে মেঘ। উনুনের ধোঁয়া, কুয়াশা, মেঘ... মাঝে মাঝে মিশে যায়। তখন মেঘের মধ্যে দিয়ে গেলেও চোখ জ্বলে, ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে গেলেও... বৃষ্টির রাতে ভাবি, মেঘকে দস্তুর মতো অনুকরণ করার চেষ্টা করেও ধোঁয়াশা সেই বহুরূপীর মতো, যাকে দিনের শেষে ঘষে ঘষে মুখ থেকে রঙ তুলতে হবে। বজ্র প্রসব করতে পারল না, এমনকী দু'ফোটা বারিধারা বর্ষণেও ব্যর্থ বলে দুয়ো দেবে তারা... যারা আপাতভাবে সাজপোশাক দেখে বাহবা দিয়েছিল প্রথমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে টানতে নিজের পরচুলা ঠিক করে নেয় সাধন বৈরাগী। কৃষ্ণ আর কালী সাজতে একই রকম নীল লাগে তার, মাঝে মাঝে কালোও। সাজের সময়ে বাঁশি না খুঁজে পেলে নকল জিভটাই মুখে নিতে হয় অগত্যা... তারপর সাজে সামান্য পরিবর্তন। বাড়ি ফিরে হাঁড়িতে ভাত ফোটায়। পরচুলায় চিরুনি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখে। ওর অপূর্ণতা আর দেব-দেবী সাজার এই অভ্যেস আমার অপরিচিত নয়। সব রঙ ঘষে তোলার পরেও যে কিছুটা থেকে যায়...
মাঝে মাঝে ভাবি, জিজ্ঞেস করি— এই যে কেউ কাঁধে মাথা রাখে না তুই বাঁশি ধরলে, এই যে কারও বুকে পা দিতে পারিস না। কষ্ট হয়... না রে?
আমারও হয়... খাঁ সাহেবের সারেঙ্গি শুনতে শুনতে।
আরও পড়ুন-সাইকেল: অমৃতা সরকার
দুটো চিঠি পড়েছিল ডাকবাক্সে। বার করে দেখি আসলে চিঠি নয়। একটা বিদ্যুতের বিল, আর অন্যটা ধার-শোধের হিসেব। এখন ডাকবাক্সে শুধুই জরুরি কাগজ জমা পড়ে। চিঠি আসে না। নীলচে ইনল্যান্ড লেটার আর হলুদ পোস্টকার্ডগুলো আর উড়ে এসে ঢোকে না এ বাসায়। এত বছরের অভ্যেস মতই আলাদা আলাদা ফাইলে বিদ্যুতের বিল আর ব্যাংকের চিঠি ঢুকিয়ে রেখে দিই, যন্ত্রবৎ। সেই কবেকার ডাকবাক্স। যারা এখন নেই, তাদের নামও থেকে গেছে। যারা চিঠি লেখে না আর, তাদের চিঠিগুলো যেমন থেকে গেছে আমার কাছে, অন্য একটা ফাইলে। মাঝে মাঝে গুছিয়ে তুলে রাখার মাঝেই কোনও অবাধ্য কাগজ উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়ে। কুড়োতে গেলে উড়ে উড়ে এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। হাতের লেখা দেখে চেনার চেষ্টা করি, কার।
তারপরেও, এই মফসসলের পোস্ট অফিসে এখনও যে ভিড় হয়, দেখে অবাকই লাগে মাঝে মাঝে। বেশির ভাগেরই বয়স সত্তরের ওপরে, বেশিরভাগই মহিলা, দৃশ্যত বিধবা। স্বামীর রেখে যাওয়া পেনশনের টাকা তুলতে আসেন। একবার দেখলাম এক মাঝবয়সী মহিলা কিছু ফর্ম ভরছেন ওই বিধবাদের মাঝেই একটা কোণে দাঁড়িয়ে, লেখার জায়গা করে নিয়ে। দু'জন পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে, ঠিক হচ্ছে কিনা। মহিলা লিখতে লিখতে যেন বার দুয়েক চোখের জল মুছলেন মনে হল। সিঁথি খালি। হাতে চুড়ি নেই। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে সেখান থেকে পোস্ট অফিসের বাইরের এই সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। দেখলাম, কিছু দূরে আমারই মতো দাঁড়িয়ে আছে সাধন। সোনালি জটা পরে শিব সেজেছে, গলায় রবারের সাপ, মাথায় রুপোলি রাংতার চাঁদ। কপালে ত্রিপুণ্ড্রক আর তৃতীয় নয়ন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। গায়ে হালকা নীল রঙের প্রলেপের উপর ছাই ঘষেছে আচ্ছা করে।
জিজ্ঞেস করলুম— চিনিস?
চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। বুঝতে পারেনি। প্রত্যাশা করেনি এমন প্রশ্ন। হন হন করে চলে গেল ডমরু বাজাতে বাজাতে। পালালো আর কী! দুপুরে মেঘ জমলে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসি। ভাবি, লেখা হয় না। তারপর অনেক রাত পার করে যখন কিছু একটা লেখা শেষ হয়। ঠিকানা লিখতে গিয়ে থমকে যাই। ফাইলে আরও একটা চিঠি বেড়ে যায়, যা আসলে আমারই লেখা।
মাহেন্দ্রক্ষণে ঘুম ভাঙলে অসমাপ্ত স্বপ্নে দেখা অস্পষ্ট দৃশ্য আর বাক্যগুলো মনে পড়ে। শব্দগুলো সাজিয়ে এক অর্থ খুঁজতে গিয়ে অন্য অর্থ সামনে এসে পড়ে ঝপ করে লাফ দিয়ে নামা বন-বেড়ালের মতো। তার চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, স্বপ্ন থেকে শুধু নিদ্রিত মন জাগে না, মাঝে মাঝে সন্তাপও জাগে। সে দীর্ঘশ্বাস আসলে জমে থাকা গন্ধর্বপরাগের মুক্তিলাভ।
এই সব বিল, রসিদ, পাওয়া আর না-পাঠানো চিঠি, ডাকবাক্স... কিছুই থাকে না শেষমেশ। কী থাকে বলো তো? জানো? চলে গেলে তো আর জানা হবে না! হবে?
যেখানে ছোট ছোট টিলা, দুটো বড়ো পাথরের স্তম্ভের উপর ভারসাম্য নিয়ে রাখা বড়ো চাট্টান- এইসব দেখা যেত, সেই পথ ধরে এগোলেই অরণ্য গভীর হয়। অরণ্য বলছি বটে, আসলে অরণ্য পিছিয়ে গেছে অনেকটাই। এ আসলে মানুষের নাগালের মাঝেই পাহাড়ি জঙ্গল। নদী সরু হয়ে গেছে নালার মতো। কেউ দেখে বলবেই না, এই নদীর জলে চিতাবাঘ আর হাতিরা জল খেতে আসত। দানবের মতো গৌর দেখা যেত টিলার কাছে লাল কাঁকড়ের রাস্তায়। ময়ূরের কেকা ভেসে আসা ছিল স্বাভাবিক অভ্যেস। এখন বাঁধানো রাস্তা, সরকারি প্রকল্পের সাইনবোর্ড। জরিপ করে যায় সাদা গাড়ি চড়ে এসে। সে রাস্তা চলে গিয়ে মিশেছে জাতীয় সড়কে। সড়কের ওপারে আবার পথ। বড় নদীর সাঁকো। আবার গ্রাম, তারপর আবার জঙ্গল। অরণ্য বলা আসলে বলারই ভুল, পিছোতে পিছোতে সে কোথায় হারিয়ে গেছে আজ!
এই টিলাগুলোর গায়ে ছোটো ছোটো পাথরের ধাপ বেয়ে উপরে ওঠা যায়। কোথাও পাথরে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে খুবই মসৃণ। আবার কোথাও উঠে দু'দণ্ড বসাও যায়। কতদিন দেখেছি খাঁ সাহেব এমনই এক টিলার ওপরে বসে আসরের নামাজ পড়ে সেজদা করছেন। অথবা সারেঙ্গি নিয়ে বসে আছেন পাটে বসা সূর্যের দিকে মুখ করে। বিকেলের আলো ফুরোলে ধাপে ধাপে নেমে আসতেন, মাথায় সাদা ফেজ পরা খাঁ সাহেব। চোখাচুখি হলে ডান হাত সামান্য তুলে সালাম ওয়ালেইকুম জানিয়ে মৃদু হেসে চলে যেতেন পাশ কাটিয়ে। মৃদুস্বরে উত্তর দিতাম, ওয়ালেইকুম আস্সালাম, শুনতে পেতেন কিনা জানি না। হয়তো সৌজন্যের হাসিটা দেখতে পেতেন। বুঝতে দিতে চাইনি কখনও যে চোরের মতো ওঁর সারেঙ্গি শুনছি পাথরের আড়ালে বসে ঝিমনোর অজুহাতে। পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। ফেরার পথে মা কালী মন্দিরের সিঁড়িতে সারেঙ্গি আর তার ছড়টা রেখে একবার সিঁড়িতে মাথা ঠেকাতেন সেজদা করার মতোই। মাঝে মাঝে অমাবস্যা রাতে চিলেকোঠার ঘরে বসে ধরতেন তিলক কামোদ।
ওরা বলেছিল সারেঙ্গি আর তানপুরা খাঁ সাহেবের জনাজার সঙ্গে দাফন করতে। আর কী কী দাফন করত? তাহলে এই টিলা আর জঙ্গল, চিলেকোঠার ঘর, আমার জানলা আর অপেক্ষা... সব কিছুই তো দাফন করতে হয় তার সঙ্গে।
সাধন বৈরাগীকেও আমি শেষ দেখেছিলাম এই কাঁকড় বিছনো পথেই। গরুড় সেজেছিল না অন্য কিছু জানি না। হয়তো পাখি হতে চেয়েছিল। খড়-কাপড়ের ডানা নিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল একটা টিলার পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে। ঘাড়টা ভেঙে গেছিল অত উপর থেকে পড়ে। মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে কালো হয়ে জমাট বেঁধে যাচ্ছিল নুড়ি-পাথরের উপর। অথচ চোখে-মুখে যন্ত্রণার কোনও চিহ্ন নেই। অমন উজ্জ্বল সাজতে কখনও দেখিনি সাধন বহুরূপীকে। ঠিক যেন কোনও রূপকথার রঙধনু-ডানা পক্ষীরাজ! অনেকেই নাকি জানত, সাধনের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু জটিলতার কথা, এই বয়সেও একা থাকার কারণ। আমার সেসব আর মনে পড়ে না, হয়তো শুনিইনি কখন ঠিক করে। হুঁ হুঁ করে গেছি বাজারের থলি হাতে। ওকে শেষবার ওভাবে দেখে খারাপ লেগেছিল। এমন উজ্জ্বল পক্ষীরাজ সাজার জন্য একটা তারিফ ওর প্রাপ্য ছিল। বেঁচে থাকলে যে তারিফটা শুনত, তা শুনতে পেল না। বলার সুযোগ দিল না। সকলেই জানে, ও আত্মহত্যা করেছিল টিলা থেকে লাফ দিয়ে। খাঁ সাহেব চলে যাওয়ার পর আমার আর বিকেলের দিকে ওই টিলার পথে বিশেষ যাওয়া হত না। গেলে হয়ত দেখতে পেতাম, ওড়ার আগে কীভাবে ডানা মেলছে... চোখে পড়ে যেত, হয়তো। হঠাৎ কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে, টিলার ধার থেকে লাফ দেওয়ার আগে একবার থমকে দাঁড়াতও, হয়তো।
তারপর থেকে আলো কমে আসার পর ওই টিলার কাছে গেলেই মনে হয় খাঁ সাহেব সারেঙ্গি বাজাচ্ছেন, আর সাধন বহুরূপী ঘষে ঘষে নিজের গা থেকে দেবতা-সাজা রঙ তোলার চেষ্টা করে রক্তারক্তি করে ফেলছে নিজেকে, পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে সারেঙ্গির সুরে মিশে যাচ্ছে তার কান্না। আসলে, টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালেও ভার্টিগো হয়। ধার থেকে অনেকটা দূরে বসে মাঝে মাঝে পাটে বসা সূর্য, নীচের পথ দিয়ে চলে যাওয়া মহিষদের দল, আর জলা থেকে উড়ে আসা পাখিদের দেখি। পাথর আঁকড়ে বসে থাকি। ধারের দিকে এগোলে হাঁটু কাঁপে। অথচ আগে এমন হতো না। হাত ধরার মানুষ আর পাশে না থাকলে, তারও একসময়ে ফ্যান্টম পেইনের মতো কোনও লক্ষণ দেখা যায় বোধহয়। মনে হয় এখনও কেউ হাত ধরে আছে। আজকাল অনেকটা উপরে দাঁড়ালে এমন অনুভূত হয় বেশি করে।
এই উপর থেকে সড়কের ধার দিয়ে মন্থর গতিতে মহিষের দল এগিয়ে যেতে দেখলে মনে হয় কোনও প্রাগৈতিহাসিক জীব। কোনও পাথর বা গাছের আড়াল থেকে বিরল-দর্শন ময়ূর তার সঙ্গিনীকে ডেকে উঠলে মনে হয় কোনও প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের চিৎকার। এখনও একটা দুটো ময়ূর আছে, হাতে গোনা কিছু শেয়াল ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে। আর বুনো শুয়োর। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক কানে এলে ভাবি, হঠাৎ একদিন হয়তো গভীর রাতে বাঘের ডাকও কানে আসবে আবার, হয়তো এখনও কোনও বাঘ আছে কোথাও, পাহাড়তলির জঙ্গলে। যাদের ডাক হয়তো শুনতে পেত আমার পিতামহ, অথবা তার পূর্বপুরুষ, তাদেরই শেষ প্রতিনিধি। হয়তো বাঘ কিংবা বাঘিনী।
আসলে কেউ চায় না এই অঞ্চলের জঙ্গলে আর বাঘ অথবা চিতা বাঘ আসুক। সত্যি বলতে,. আমিও চাই না। তাতে বিপদ তারই। গোধূলি গগনে সিঁদুরে মেঘ ঢেকে এলে অথবা কফস উদাসী জ্যোৎস্নায় টিলার উপরে বসে হঠাৎ বাঘের কথা মনে পড়ে গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না। সেই ভার্টিগো আর হাঁটু-কাঁপা পদক্ষেপ নিয়েই টিলের ধারে এসে বসি। তুষার রায়ের 'হানিমুন' মিশে যায় বুদ্ধদেব গুহর 'বনজ্যোৎস্না'য়। ভাবি, কোনও বাঘের ডাকে সাড়া দিয়ে যদি সে চলে যেতে চায়, তাহলে আমার কি সত্যিই কিছু করার থাকতে পারে? শুনেছি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরের সামনাসামনি এলে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে মানুষ।
আরও পড়ুন- দুই বুড়োবুড়ি : গৌতম দে
সেও জানতে চায়, "তুমিও কি সাড়া দিতে না, কোনও বাঘিনীর ডাকে?"
আমার হাসি পায়। কোনও পাথরের কোণ থেকে তক্ষক ডেকে ওঠে, কোনও নাম-না-জানা পাখি চমকে উড়ে যায় ডাকতে ডাকতে— নৈঃশব্দ্য লঙ্ঘন করা হাসির শব্দে।
আমি কে যে বাঘিনী আমাকে পাত্তা দেবে? সাধ মিটবে তার? মিটবে স্বাদ?
আহত করে ফেলে রেখে চলে যাবে, পরিত্যক্ত... পড়ে থাকব মুরাদ বকশের মতো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে, সেই এক পরাজিত দৃষ্টি নিয়ে। কথোপকথন ফুরোয়। আবার ফিরে আসি পাহাড়তলির বেলাফুরনো আলোয়। মহিষের পাল বাথানের দিকে এগিয়ে যায় এক বিষণ্ণ মন্থর গতিতে। জনপদ ত্যাগ করে চলে যাওয়া বৌদ্ধ শ্রমণদের মতো। পশ্চিম দিকের সোনালি আলোর পথে এগিয়ে যেতে যেতে তারা মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। আলো একই আছে, শুধু যেন কারা পথের চেহারা বদলে দিয়ে গেছে অকস্মাৎ।
দীন হয়ে গেছে জলাশয়, ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির মতো। ঠিক এমন সময়ে আমার অপূর্ণতারা আবার ঘিরে ধরে। মনে পড়ে যায়, খাঁ সাহেব আর টিলায় এসে বসবেন না সারেঙ্গি নিয়ে। সাধন বৈরাগীর সেই পক্ষীরাজ রূপ আর ভালো করে দেখা হল না। কৃত্তিবাস পরিহিতা সেই যোগিনী কমণ্ডুলু হাতে ঝুঁকে পড়ে যে হাত বাড়িয়ে দিল তা হাত ধরার জন্য, না থামানোর জন্য, না কিছু দেওয়ার জন্য-- তাও জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।
রাত গভীর হয়। বৃষ্টি নামে। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোম-আলোয় বসে শুনি খাঁ সাহেবের সারেঙ্গি। আর কান পেতে থাকি... বাঘিনী অথবা যোগিনীর ডাক শোনার অপেক্ষায়। যার স্মৃতিতেও আমি আছি। যার কাছে আমার স্মৃতি আছে।
সারেঙ্গি থামলে, আমার স্মৃতির কপালে চুমু এঁকে ঠিক ঘুম পাড়িয়ে দেবে (সে)।