‘পঙ্গু’ করা হল তসলিমা নাসরিনকে, কীভাবে কর্পোরেট দালালে পরিণত হলেন স্বয়ং ডাক্তার

Taslima Nasrin : “অপারেশান এক্ষুনি না করলে প্রব্লেম”, ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হাঁটু বদল হল তসলিমার

‘নি রিপ্লেসমেন্ট’, শব্দটি আজকাল খুবই পরিচিত। আশেপাশের বাড়িতে একটু খোঁজ নিলে সহজেই দু-একজনকে পাওয়া যাবে, যাঁরা এই বিষম পদ্ধতিটির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। সহজভাবে বলতে গেলে হাঁটু বদলে ফেলা। একটা সময় এই কথাটা শুনলেই রীতিমত আঁতকে উঠতে হতো, নিজের হাঁটু তা কিনা বদলে ফেলা হবে, ভাবা যায়? হ্যাঁ ভাবা যায়,আজকাল অবশ্য একটু বেশি করেই ভাবা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের 'উন্নতি' আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যাতে এ ঘটনা একেবারেই মামুলি বিষয়। পান থেকে চুন খসলেই, অর্থাৎ হাঁটু সামান্য বেগরবাই করলেই কেটে ফেলো, বাজারে এখন কিনতে পাওয়া হয় কৃত্রিম হাঁটু, জুড়ে দিলেই খেল খতম।

বিষয়টা শুনতে যতটা সহজ লাগছে আদপেও কি ঠিক তাই? একটা ধার করা, কেনা হাঁটু কি আদৌ আগের মত হাঁটতে, ছুটতে, লাফাতে পারে? প্রশ্নগুলো আগে থেকেই ছিল। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা নতুন করে চোখ খুলে দিয়েছে সমাজের। গত দুইদিন ধরে নেট মাধ্যমে ঘুরে ফিরে আসছেন তসলিমা নাসরিন। চিরকালই বিতর্কিত বলে পরিচিত এই মানুষটি আবারও নতুন একটা বিতর্ক সামনে এনেছেন। ফেসবুক বিবৃতিতে তিনি লেখেন - “এক মুহূর্তে একটি মৃত্যু ঘটেছিল। সেই মৃত্যু আমার উচ্ছল উজ্জ্বল জীবনকে গ্রাস করে নিয়ে একটি স্তব্ধ স্থবির জীবন ফেলে রেখে গেছে। এই জীবনটি আমার নয়, অথচ আমার।” কী সেই এক মুহূর্তের মৃত্যু? কেন এমন কথা বললেন লেখিকা? এই বিষয়ে অবশেষে স্পষ্ট করলেন তিনিই। অভিযোগের তীর সরাসরি বর্তমান সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে। সরাসরি তোপ দেগেছেন তিনি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন - “নিজেকে ভালোবাসো তুমি এবার…”, পরীমনিকে কেন এ কথা বললেন তসলিমা?

দিন কয়েক হল ‘অদ্ভুত’ সব পোস্ট করছিলেন লেখিকা। একেবার লিখছেন মরণোত্তর দেহ দানের কথা, আবার কখনও লিখছেন এক মুহুর্তে মৃত্যু ঘটেছে তাঁর। এ সব নিয়ে শুরু হয়েছিল জল্পনা। তার মধ্যে রবিবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় ছবি পোস্ট করে সেই জল্পনা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেন তিনি। অবশেষে গতকাল জানা গিয়েছে আসল কারণ।

লেখিকার বয়ান, “হাসপাতালের বেডে আমার শুয়ে থাকার ছবি দেখে অনেকে ভেবেছে আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। না, সেসব কিছুই হয়নি। সেদিন ওভারসাইজ পাজামা পরে হাঁটছিলাম ঘরে, পাজামা চপ্পলে আটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। অগত্যা যা করতে হয়, করেছি। হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছিল, আইস্প্যাক দিয়েছি, ভলিনি স্প্রে করেছি। মনে হল হাঁটুর লিগামেন্টে হয়তো লেগেছে, কোনও হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে দেখি কী হলো। গেলাম হাসপাতালে। এক্সরে আর সিটিস্ক্যান করে হাড়ের ডাক্তার বলে দিলেন পায়ের ফিমার নামের হাড়টির গলায় একখানা ক্র্যাক হয়েছে। এর চিকিৎসা কী, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দুটো অপশান দিলেন, প্রথম অপশান ইন্টারনাল ফিক্সেশান, ফাটলের জায়গাটা স্ক্রু লাগিয়ে ফিক্স করে দেবেন। দ্বিতীয় অপশান হিপ রিপ্লেসমেন্ট, আমার হিপ কেটে ফেলে দিয়ে কিছু প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে একটা নকল হিপ বানিয়ে দেবে্ন।”

ঠিক এই অবধি লেখাটা পড়লেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সামান্য একটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া থেকে কিনা এমন বিপত্তি যে একেবারে অস্ত্রোপচার! আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষ হলে অবশ্য একরকম ছিল কিন্তু তসলিমা নাসরিন যে নিজেও পেশায় একজন ডাক্তার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষয় তিনিও তো খানিকটা অবগত। সেই তিনিও কিনা এক্কেবারে ঘোল খেয়ে গেলেন। ঠিক করে ভাবার অবকাশ অবধি পেলেন না যে কোন অপশনটি বেছে নেবেন। এমনকী তিনি নিজেই জানান যে, তিনি চাননি সার্জারি করতে, জোর দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন, “ফিক্সেশান করবো”। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ সে সব কিছুকে তোয়াক্কা করলে তো! অতঃপর হাঁটু বদল, কেনা হাঁটু লাগানো হল তসলিমার শরীরে। আর এর জেরেই নিজেকেই “পঙ্গু” বলে দাবি লেখিকার।

চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, এ তো জরুরি পরিষেবা, আর ডাক্তার? তিনি তো ভগবান! এমন বিশ্বাসই মনে মনে পোষণ করেন সাধারণ মানুষ। তাহলে এ কোন সময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা? যেখানে রক্ষকই কিনা ভক্ষক! জীবন বাঁচানোও এখন কেবল পয়সার খেলা। চিকিৎসা এখন বড় ব্যবসা। দেশের জরুরি পরিষেবার সরকারি পরিকাঠামো ধুঁকছে, আর সেই সুযোগে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে কিছু পয়সালোভী পিশাচের দল। স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও কোনও ছাড় নেই। মানুষের জীবন নিয়ে বড় রকমের একটা খেলা চলছে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেও তো স্পষ্ট এই একই ছবি। হাতে গোনা কয়েকটা সরকারি হাসপাতাল, তাও কেবল কলকাতায় কুক্ষিগত। জেলার হাসপাতালগুলোর কথা যত না বলা যায় ততই ভালো। সেখানে না আছে যন্ত্রপাতি, না আছে ভালো ডাক্তার। আর কলকাতায় গুটিকয়েক যে কজন ভালো ডাক্তার আছেন, এই বিপুল পরিমাণ রোগীর কাছে তারা নেহাৎই তুচ্ছ। প্রতিদিন সকাল থেকে লম্বা লাইন পড়ে সরকারি হাসপাতালের ওপিডি-তে। এই এত রোগীকে সামাল দেওয়ার জন্য না আছে পরিমিত ডাক্তার, না আছে বেড। এমনকী মাটিতে পড়ে থাকতে হয় মুমূর্ষু রোগীদের। আর এই বিষম পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাঁচতে অগত্যা বেসরকারি হাসপাতাল।

ব্যাস এখানেই শুরু ব্যবসা। বেড ভাড়া থেকে শুরু করে ওষুধ, খাবার, ডাক্তার সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা মূল্য ধার্য করা। সেসব দিয়েও মুক্তি নেই, এরপর শুরু হয় আসল ব্যবসা। যেন কোনও হাসপাতাল নয়, খোদ বাজার।

আরও পড়ুন - মেসি হোক বা পেনাল্টি, ফেসবুকেই বিশ্বকাপ খেললেন তসলিমা

হার্টের অবস্থা খুব খারাপ এক্ষুনি স্টেন বসাতে হবে নাহলে মৃত্যু অবধারিত, কিংবা রোগীর অবস্থা খুব খারাপ এক্ষুনি ভেন্টিলেশনে দিতে হবে নাহলে বাঁচানো যাবে না, এরকম একের পর এক ভয় দেখিয়ে চিকিৎসা নিয়েও চলে ব্যবসা। আর এরই একটার সম্প্রতি শিকার হয়েছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনি বারবার বললেন হাঁটুতে ফিক্সেশান করাবেন, অথচ কিছুতেই রাজি হলেন না স্বয়ং সার্জেন। ক্রমশ বোঝাতে লাগলেন, “ফিক্সেশানে সবসময় ফিক্স হয় না, ৮০% কাজ হয়, কিন্তু ২০ % ফেইল করে”। একটা অদ্ভুত ভয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল লেখিকাকে। হাসপাতালের সকলেই দাগিয়ে দিতে থাকলেন উনি ‘বড় সার্জেন’, তাই এটাই করতে হবে। এমনকী তসলিমাকে দ্বিতীয় কারোর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগও কার্যত দিল না বেসরকারি হাসপাতাল। “অপারেশান এক্ষুনি না করলে প্রব্লেম, ইনফেকশান হয়ে যাবে”, ক্রমাগত একটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়েই অগত্যা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হাঁটু বদল হল তসলিমার।

তসলিমা লিখছেন, “আমার হিপ জয়েন্ট কেটে ফেলে দিয়ে টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হলো। একটা পঙ্গু মানুষের জীবন আমাকে দেওয়া হলো।” এই সাইক্লিং করছেন, সুইমিং করছেন, ট্রেড মিল করছেন, ছুটছেন, দৌড়চ্ছেন, এমনটাই অ্যাকটিভ একজন মানুষ তসলিমা, সেই তসলিমাকে হাসপাতাল থেকে স্বান্তনা দেওয়া হল, “চিন্তার কিছু নেই, তুমি হাঁটতে পারবে।” আর দেওয়া হল একগাদা রেস্ট্রিকশন।

এই গোটা ঘটনা যেন নতুন করে চোখ খুলে দেয়, বর্তমান সমাজের অবক্ষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। একটা বেসরকারি হাসপাতাল মানেই একটা বিশাল দালাল চক্র। একটা বড় ব্যবসা। আর এই ব্যবসার দায় সরকারেরও। সরকারি পরিষেবা যতদিন না আশার আলো দেখাতে পারবে ততদিন রমরমিয়ে চলবে স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা। আর এই ব্যবসার জেরেই ভগবানের আসন থেকে ক্রমশ আরও আরও নেমে আসবে ডাক্তার পেশাটি।

More Articles