রাত ৯ টায় রহস্যময় গর্জন! হাজারে হাজারে মানুষ পশুকে খুন করেছিল বিশ্বের বীভৎসতম এই হ্রদ
Dangerous Lake of The World: রাত ৯ টা নাগাদ, যখন সেই গর্জন শোনা যায়, মোটামুটিভাবে যে যেখানে ছিল মারা যায়!
৩৭ বছর আগের এক দিন। সাল ১৯৮৬, দিনটা ২১ অগাস্ট। উত্তর-পশ্চিম ক্যামেরুনের লেক নিওসের দিক থেকে অদ্ভুত গর্জন ভেসে এল। জলের শব্দ তো নয়, বজ্রপাতও না। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে যাওয়ার সময়, দিগন্ত কাঁপানো এক গর্জন! স্থানীয় কৃষক ইফ্রিয়াম চে এই লেক নিওসের কাছাকাছিই রইতেন। হ্রদের কাছে এক পাহাড়ের টিলার গায়ে মাটির ইটের তৈরি বাড়িই তাঁর ঠিকানা। রাত ৯টার দিকে ভয়ঙ্কর এই গর্জন শুনতে পেলেন। কীসের থেকে এই আওয়াজ, তার কুল কিনারা না পেয়ে ফের শুয়ে পড়েন ইফ্রিয়াম। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে কাছাকাছি এক জলপ্রপাতের দিকে যান। একটা আস্ত জলপ্রপাত, গতকাল অবধি যা বয়ে গিয়েছে সশব্দে, আশ্চর্যজনকভাবে শুকিয়ে গিয়েছে সেটি! আরও অদ্ভুত হচ্ছে পুরো জায়গাটি ভয়ঙ্করভাবে শান্ত! পাখি বা কোনও প্রাণী, এমনকী পোকামাকড়ের কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এ কেমন পরিস্থিতি! আতঙ্কিত হয়ে তিনি হ্রদের ধারে তাঁর গ্রামের দিকে নেমে যেতে থাকেন, আর্তনাদ কানে আসে তাঁর!
হালিমা সুলে গবাদি পশুপালক, ওই গ্রামেই বাস। দু' চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তাঁর। হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে ইফ্রিয়াম চে-র দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে হালিমা। তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে তাঁর পরিবারের ৩১ জন সদস্যের মৃতদেহ এবং ৪০০টি মৃত গবাদি পশুর দেহ। মৃতদের উপর কোনও মাছি অবধি ছিল না কারণ যে মাছি বসেছিল সেগুলিও মারা যায়। হালিমা একা নন, লেক নিওসের ওই গর্জনের পরের দিন সকালে, হ্রদের ২৫ কিলোমিটার জুড়ে ১,৭৪৬ জন মানুষ এবং ৩,৫০০ টিরও বেশি গবাদি পশুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- গান গায় বালিয়াড়ি! ধূ ধূ বালিতে প্রকৃতির গা ছমছমে ‘কনসার্ট’-এর নেপথ্যের রহস্য জানেন?
হালিমার মতোই বাকিদের গল্পগুলোও খানিক একই। ঘরের ভিতরে মৃত মানুষ, ঘরের বাইরে মৃত পশুপাখি, কুকুর, গরু। যেন কী এক আগ্রাসী মড়ক লেগেছে। স্থানীয় বাসিন্দা মনিকা লোম এনগং বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ৫৬ জনের বড় পরিবার ছিল তাঁদের। ৫৩ জনই মারা যান। কোনও যুদ্ধ নেই, বোমা, গুলিগোলা নেই। অথচ চারিদিকে থইথই মৃত্যু। ওই গ্রামের নীচের গ্রামে আরও কয়েকশ লোক মারা পড়েন। রাত ৯ টা নাগাদ, যখন সেই গর্জন শোনা যায়, মোটামুটিভাবে যে যেখানে ছিল মারা যায়! কীভাবে? একমাত্র পচা ডিমের গন্ধ এবং মৃত ও জীবিতদের শরীরে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন ছাড়া আর কোনও সূত্র মেলে না।
মনিকা জানিয়েছিলেন, তাঁর যখন ঘুম ভাঙে, দেখেন বাঁ হাতে পোড়া দাগ। তবে কোনও ব্যথাই নেই। কিন্তু হাতটা দেখে মনে হবে যেন ক্ষতের কারণে প্রায় পচে গেছে। রাতারাতি কী যে ঘটল, কারও কাছেই পরিষ্কার ছিল না। কেউ ভাবল রাসায়নিক আক্রমণ, কেউ শরণ নিল কুসংস্কারের। যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বেশিরভাগই এলাকা ছেড়ে পালাতে চাইলেন। অধিকাংশই জানিয়েছিলেন, পরিবারের সদস্যরা মেঝেতে ঘুমোচ্ছিলেন। যে যেখানে শুয়েছিলেন সেখানেই মারা যান। দেখা যায় অদ্ভুত এক গতিতে হ্রদ থেকে গ্যাসের মেঘ বেরিয়েছে। কিছু মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরের দিন জেগে দেখেন চারপাশে কেবল মৃতদেহ।
আরও পড়ুন- জলে নামতেই গলে পাঁক সারা দেহ! জানেন, কেন উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান এতখানি ভয়াবহ?
এই ভয়াবহ মর্মান্তিক ঘটনার তথ্যতালাশ করতে বিজ্ঞানীরা দৌড়ন লেক নিওসে। সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ। হ্রদটি নীল থেকে লাল হয়ে গিয়েছে। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই বমি, ডায়রিয়া এবং হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন, যার সবকটিই ছিল CO2 বিষক্রিয়ার লক্ষণ। লেক থেকে নমুনা নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে এই ঘটনার কারণ জানা যায় অবশেষে। লেক নিওস একটি আগ্নেয়গিরির গর্তে তৈরি হয়েছিল, এই গর্ত থেকে CO2 বা কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন হচ্ছিল। সাধারণত, আগ্নেয়গিরির হ্রদে এই গ্যাস তখনই নির্গত হবে যদি জলটি বহমান হয়। লেক নিওস অস্বাভাবিকভাবে স্থির ছিল। ফলস্বরূপ, কয়েক দশক ধরে পলিতে CO2 তৈরি হয়েছিল, যার কথা কোনওদিন টেরও পাননি কেউ।
সেই দিন হ্রদে ঠিক কি এমন ঘটেছিল তা জানা যায়নি। ভূমিধস দেখে দেয় নাকি হঠাৎ গ্যাস নিঃসৃত হয়েছিল জানা যায়নি তবে প্রায় ২০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রায় ১.২ ঘন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে CO2 গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। শ্বাসরোধ করে ফেলে মানুষের, পশুপাখির। গ্যাসটি আশেপাশের বাতাসের চেয়ে ঘন, তাই উঁচু জমিতে যাদের বাড়ি ছিল প্রাণে বেঁচে যান তারা।
এই সমস্যাটি একমাত্র লেক নিওসে ঘটেছে এমন নয়। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং রুয়ান্ডার মধ্যবর্তী কিভু হ্রদ, নিওসের চেয়ে অনেক বড় এবং অনেক বেশি ঘনবসতি এলাকা। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের ঘটনা প্রতি হাজার বছর বা তার পরে সংঘটিত হয়। তাই সম্ভবত এমন রহস্যময় বিষক্রিয়া ঘটবেই, তবে কখন ঘটবে তা বলা যায় না।