মায়ের থেকে সন্তানকে কেড়ে নেয় রাষ্ট্র! মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ের আসল ঘটনা কী?
Mrs Chatterjee vs Norway True Story: ২০১১ সালের মে মাসে অনুরূপ এবং সাগরিকার কাছ থেকে তাঁর দুই সন্তানকে কেড়ে নেয় রাষ্ট্র।
এক বাঙালি মা, বিপক্ষে নরওয়ে সরকার। এতটুকু লিখলেই বোঝা যায় মিসেস চ্যাটার্জি বনাম নরওয়ের কথা হচ্ছে। রানি মুখোপাধ্যায় বড়পর্দায় ফিরছেন, সঙ্গে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। সিনেমার ট্রেলার ইতিমধ্যেই প্রকাশিত। ট্রেলারেই বোঝা গিয়েছে, নরওয়ে সরকারের সঙ্গে নিজের দুই সন্তানের হেফাজত চাওয়ার জন্য লড়াই করে চলেছেন এক ভারতীয় দম্পতি। কোনও খুন-জখম-বীভৎস দৃশ্য ছাড়াই এই সিনেমার ট্রেলার হাড় কাঁপিয়ে দিয়েছে আমজনতার। এমনটাও যে হতে পারে, একজন মাকে কখনও এই লড়াইও যে লড়তে হতে পারে ভাবেননি কেউ। ট্রেলার দেখে মুহূর্তের জন্য আতঙ্ক আর আশঙ্কার মেঘে ঢেকে গিয়েছে বাস্তবের সাধারণ যাপন। ট্রেলারেই লেখা, ‘বেসড অন আ ট্রু স্টোরি'। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমার আকর যা, অর্থাৎ মূল কাহিনি যা তা রীতিমতো থ করে দিয়েছিল বিশ্বকে। 'মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে' আগামী ১৭ মার্চ মুক্তি পেতে চলেছে। সত্য ঘটনাটি ঘটার প্রায় ১২ বছর পর।
সত্য ঘটনা জানতে যেতে হবে ২০১১ সালে। নরওয়ের শিশু কল্যাণ পরিষেবা, যা বার্নেভার্ন নামেও পরিচিত, অনুরূপ এবং সাগরিকা ভট্টাচার্যের দুই সন্তানকে তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। মা বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ওই দুই শিশুকে সরকারের 'যত্নে' রাখা হয়। নিজের সন্তানদের ফিরে পেতে আস্ত একটা দেশের বিরুদ্ধে এই দম্পতির লড়াই এবং অবশেষে জয়ই রানি-অনির্বাণ অভিনীত চলচ্চিত্রের মূল বিষয়।
ঠিক কী ঘটেছিল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ভট্টাচার্যের সঙ্গে? নরওয়েতে বসবাসকারী সাগরিকা ও অনুরূপের দুই সন্তান। তিন বছরের অভিজ্ঞান এবং এক বছরের মেয়ে ঐশ্বর্য। অনুরূপ ভট্টাচার্য এবং সাগরিকা ভট্টাচার্য ২০০৭ সালে নরওয়েতে চলে আসেন। তাদের প্রথম সন্তান অভিজ্ঞান জন্মায় ২০০৮ সালে। ২০১০ সালে তাঁদের কন্যা ঐশ্বর্যর জন্ম। অভিজ্ঞানের মধ্যে অজিটমের কিছু লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। বাড়ির কাছেই একটি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ২০১১ সালের মে মাসে অনুরূপ এবং সাগরিকার কাছ থেকে তাঁর দুই সন্তানকে কেড়ে নেয় রাষ্ট্র। নরওয়ের সরকারের দাবি, শিশুদের যত্ন নিতে অপারগ বাবা-মা। শিশুদের জোর করে খাওয়ানো, হাতে করে খাওয়ানোর মতো বিষয় নিয়ে আপত্তি করে সরকার।
আরও পড়ুন- ভূমিকম্পের ১২৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার দু’মাসের শিশু! যে ঘটনায় অবাক উদ্ধারকারীরাও
নরওয়ে সরকার আরও জানায়, শিশুদের খেলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। বাচ্চাদের অনুপযুক্ত জামাকাপড় এবং খেলনা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছিল সাগরিকার বিরুদ্ধে। নরওয়ের চাইল্ড প্রোটেক্টিভ সার্ভিস শিশুদের বাবার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমানোর মতো বিষয়েও আপত্তি তোলে। সে দেশের সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, শিশুর আলাদা বিছানা থাকতে হবে।
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের পর, নরওয়ের কর্তৃপক্ষ শিশুদের বাবা অনুরূপের ভাইকে দুই শিশুদের হেফাজত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে তিনি তাদের ভারতে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তবে ততদিনে অনুরূপ ও সাগরিকা পৃথক হয়ে গিয়েছেন। সাগরিকা তাঁর সন্তানদের হেফাজত পেতে আইনের পথেই হাঁটেন। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর সাগরিকা তাঁর সন্তানদের ফিরে পান। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা হাইকোর্ট সাগরিকাকে তাঁর ছেলে অভিজ্ঞান এবং মেয়ে ঐশ্বর্যর হেফাজত মঞ্জুর করে।
কিন্তু কোনও দেশ কি বাবা মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে চাইলেই কেড়ে নিতে পারে? নরওয়ের শিশু কল্যাণ দফতরের আইন অত্যন্ত কড়া। শিশু সুরক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর এবং দেশে বসবাসকারী সকল নাগরিকের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এই দেশে। সেই বসবাসকারী, যে দেশের যে সংস্কৃতিরই হোক না কেন, এই আইন সকলের জন্য বলবৎ। শিশুকে আলতো করে থাপ্পড় মারাও সেই দেশে বেআইনি।
আরও পড়ুন- ‘দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব’: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
যে যে শিশুর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন বা বাড়ির মধ্যে বাবা মায়ের সঙ্গে থেকেও বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন শিশু কল্যাণ পরিষেবার তরফে এইসব পরিস্থিতিতে বাবা মায়ের কাউন্সেলিং এবং বিভিন্ন সাহায্য প্রদান করা হয়, যার মধ্যে বাড়িতে নানা সুবিধা সরবরাহের পাশাপাশি ডে-কেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ভট্টাচার্য পরিবারের ক্ষেত্রে, কাউন্সেলিং করা হতো নিয়মিত।
নরওয়ে সকারের বিরুদ্ধে এই মামলায় হস্তক্ষেপ করার জন্য বিদেশ মন্ত্রকের কাছে আবেদন করেছিলেন অনুরূপ ও সাগরিকা। এমন অমানবিক শিশু কল্যাণ পরিষেবার জন্য ভারত সরকার তীব্র সমালোচনা করে নরওয়ের। নরওয়ের হিউম্যান রাইটস অ্যালার্টের প্রধান বেরিট আরসেট ঘটনাটিকে 'রাষ্ট্রীয় অপহরণ' বলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, নরওয়েতে এই ধরনের ঘটনা প্রথম নয়... দেশের আইনি ব্যবস্থা শিশু কল্যাণ পরিষেবার পক্ষপাতী এবং তারা সব সময় যা ইচ্ছা তাই করে। নরওয়ের কোনও মানুষ যদি অন্য দেশের কাউকে বিয়ে করেন, তাঁদেরও একই ঝক্কি পোহাতে হয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার বলে যে বাবা-মায়ের কারও একজনের মানসিক সমস্যা আছে, পুরোটাই কেবলমাত্র নিজেদের মামলা শক্তপোক্ত করার জন্য ...এটিই ঘটেছে এই ক্ষেত্রেও।