সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের, তাও কেন বিনা বিচারে ৪ বছর বন্দি উমর খালিদ?
Umar Khalid: ২০১৮ সালের ১৩ অগাস্ট, সংসদ ভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অজ্ঞাত পরিচয় দুই যুবক উমরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
এক দশকে দেশে ঘোষিত কর্মসূচি থেকে অঘোষিত কর্মসূচিই যেন বেশি কাজ করেছে। যেমন, সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি এখনও আছে। তবে তা থাকলেও সরকারপক্ষ নিজের মতো হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে লেগে পড়েছে। সিএএ-এনআরসি আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রায় সকলেই মুক্তি পেয়ে গেলেও, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বিনা বিচারে দীর্ঘ ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রনেতা উমর খালিদকে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে, যেখানে এই আইনে সাজার সর্বোচ্চ সময়সীমাই ৭ বছর। কেন এমন আচরণ? ধর্মে মুসলিম বলেই কি উমরের সঙ্গে এমনটা হচ্ছে। ২০২৪-এর নির্বাচনের ফল ইঙ্গিত করছে আর বেশি দিন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করে ফল পাবে না বিজেপি সরকার। তবে এও মনে রাখতে হবে, মোদি সরকার ফের ক্ষমতায় এসেই অরুন্ধতী রায় ও শেখ শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এর অধীনে মামলা শুরু করার অনুমতি দিয়েছে দিল্লি পুলিশকে।
উমর খালিদ জনজাতি জীবন নিয়ে গবেষণারত এবং জেএনইউ-এর প্রাক্তন ছাত্রনেতা। উত্তর-পূর্ব দিল্লি দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকে বারবার জামিনের আর্জি খারিজ করে শীর্ষ আদালত। বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) সহ একাধিক ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লি পুলিশ। দেশের ক্ষমতাসীন পক্ষের হাতিয়ার যেমন বিশ্বব্যাঙ্ক, এডিবি, এফডিআই, আদালতের রায়, নীতিনির্ধারক, মিডিয়া এবং পুলিশ। তেমনই অপরপক্ষ হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ধর্না, অনশন, সত্যাগ্রহ এবং আইনকে। তাঁদেরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উমর খলিদ। প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে বিনা বিচার ৪ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছে উমরকে?
আরও পড়ুন- প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?
২০২০ সালে দিল্লি হিংসার ঘটনায় উমরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রর অভিযোগ এনে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এ মামলা করেছিল দিল্লি পুলিশ। সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন উমরকে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ করকরদুমা আদালতে প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমরের জামিনের আবেদন খারিজ করা হয়। ওই বছরই ২৩ মে আদালত গ্রীষ্মের ছুটির আগে শুনানি শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়। তবে, শুনানির আগেই ৪ জুন আদালতে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যায়। ছুটি শেষ হয় ৪ জুলাই। ফলত ৪ জুলাই অবধি শুনানি স্থগিত হয়। ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর দিল্লি হাইকোর্ট ফের জামিনের আর্জি খারিজ করায় শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন উমর। সেবার আদালত বলেছিল, উমর নাকি অন্য আরেক অভিযুক্তর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এদিন উমরের জেল বন্দি অবস্থার ৭৬৪ তম দিন ছিল।
২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর বোনের বিয়েতে যোগ দিতে উমর করকরদুমা আদালতে দু'সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিনের জন্য আবেদন করেন। ৩ ডিসেম্বর দিল্লি দাঙ্গার সময় পাথর ছোড়ার মামলায় উমরকে মুক্তি দেয় করকরদুমা আদালত কিন্তু বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এর মামলায় নিষ্পত্তি হয়নি। ১২ ডিসেম্বর এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করা হয়। সে সময় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগযোগেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২৩ ডিসেম্বর অবশেষে উমর ৮৩০ দিন পর এক সপ্তাহের জন্য জেলমুক্ত হয়েছিলেন।
২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল উমর সুপ্রিম কোর্টে মুক্তির দাবি করে দিল্লি হাইকোর্টের বিরুদ্ধে বিশেষ পিটিশন ফাইল করেন। ৯ জুন তাঁর বন্দি জীবনের ১০০০ দিন পূরণ হয়। ১২ জুলাই দিল্লি পুলিশ চার্জশিট পেশ করতে আরও সময় চায়। ২৪ জুলাই উমরের আইনজীবী বিশেষ কারণে উপস্থিতি না হতে পারায় এক সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। ৯ অগাষ্ট শীর্ষ আদালতের বিচারপতি প্রশান্তকুমার মিশ্র উমরের জামিনের আবেদনের শুনানি থেকে সরে যান। ১৮ অগাস্ট আবারও শুনানি হয়নি। ফের এদিন স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর উমরের আইনজীবী কপিল সিব্বল অন্য একটি মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। ১২ সেপ্টেম্বর আদালত ডিটেল হিয়ারিংয়ের জন্য ১ মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। ২৯ নভেম্বর আইনজীবীর অনুপস্থিতির কারণে আবারও শুনানির হয়নি। ফের এদিন স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ১০ জানুয়ারি, ২০২৪ জেনারেল এস.ভি.রাজুর অনুপস্থিতির কারণে পুনরায় শুনানির স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
৩১ জানুয়ারিতেও শুনানি হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদী এবং বিচারপতি পঙ্কজ মিঠলের বেঞ্চ আবার এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি পঙ্কজ মিঠল ফের স্থগিতাদেশের কথা জানান।
এভাবে ১৪ বার শুনানি না হওয়ায় ১৪ ফেব্রুয়ারি উমর ইউএপিএ মামলায় সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আর্জি প্রত্যাহার করে নেন। উমরের আইনজীবী কপিল সিব্বল জানান, ১৪বার শুনানির তারিখ পরিবর্তন হওয়ায় জামিনের আর্জি খারিজ প্রত্যাহার করে ট্রায়াল কোর্টে ভাগ্যপরীক্ষা করতে চান তাঁরা। ২৮ মে উমর তিন মাস পর জামিনের আর্জি প্রত্যাহার তুলে নেন। এরপর ফের জামিনের আবেদন নাকচ করে আদালত।
উমর খালিদের প্রতি সংহতিতে সবর হয়েছিলেন আমেরিকান ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক নোয়াম চমস্কি। এই প্রবীণ অধ্যাপক একটি ভিডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন, 'খালিদের বিরুদ্ধে একমাত্র তথ্যপ্রমাণ তাঁর বক্তৃতা, যা একটি মুক্ত সমাজে সকলেরই মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত। এই ঘটনায় ভারতের বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বের ছবি ফুটে উঠছে। ভারতে স্বাধীন নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এই সব কিছু আসলে সরকারিভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নীতি লঙ্ঘন করার বৃহৎ অপচেষ্টা, এসকল কিছুর মূল উদ্দেশ্যে হলো হিন্দু আধিপত্য কায়েম করা। এছাড়াও উমরের মুক্তির দাবি করে সরকারের উদ্দেশে বিবৃতি দিয়েছেন শিক্ষাবিদ, লেখক এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা। সেই তালিকায় রয়েছেন মীরা নায়ার, অমিতাভ ঘোষ, সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, রত্না পাঠক শাহ, পি সাইনাথেরা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির পৌত্র তথা ইতিহাসবিদ রাজমোহন গান্ধিও উমর খালিদকে দেশের প্রথম সারির মেধাবী তরুণ বলে মনে করেন।
আরও পড়ুন- বিচারের আগেই মিডিয়া যে ভাবে ‘অপরাধী’ বানিয়েছে উমর খলিদকে
২০২০-র দিল্লি দাঙ্গায় কেন্দ্র পরিচালিত দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। দাঙ্গা শুরুর কিছুদিন আগে বিজেপির নেতৃত্বরা উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা তো দূর, কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি। সেই সময় বিজেপি ঘনিষ্ঠ ধর্মগুরুরাও নির্দ্বিধায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেছেন। কোনও পদক্ষেপের ভয় ছিল না তাঁদেরও। বলা হয়, এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের নানাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়েছিল বিজেপি সরকার। বলে রাখা প্রয়োজন, ২০১৮ সালের ১৩ অগাস্ট, সংসদ ভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অজ্ঞাত পরিচয় দুই যুবক উমরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। স্বাধীনতা দিবসের মাত্র দু'দিন আগের ঘটনা এটি, যখন দেশের রাজধানী নিরাপত্তায় ঘেরা থাকে। এই ঘটনার কিন্তু কোনও তদন্তই করা হয়নি, উল্টে কেন্দ্র সরকারের দিল্লি পুলিশ বলেছিল, ঘটনাস্থলে রিভলভার পাওয়া গেলেও কেউ নাকি গুলি ছোড়েনি।