সুখে দুঃখে ছিলেন টলিপাড়ার ‘আপনজন', শমিত ভঞ্জকে মনে রাখেনি বাঙালি
Shamit Bhanja : তপন সিনহার হাত ধরে হয়ে শমিত ভঞ্জ উঠলেন টলিপাড়ার ‘আপনজন’
‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘গল্প হলেও সত্যি’-র মতো বিখ্যাত সব ছবিতে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন পরিচালক তপন সিনহা। একডাকে তখন টলিপাড়া চেনে তাঁকে। এরকমই একটা সময় নামী পরিচালকের ঘরে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে ঢুকলেন এক দামাল ছেলে। সরাসরি পরিচালকের চোখে চোখ রেখে বলে বসলেন, “অভিনয় করতে চাই”। পরিচালকের মেজাজ যাঁরা জানেন, তাঁরা সকলেই তখন ভয়ে তটস্থ। অথচ বেপরোয়া সেই ছেলেটি। ভয়ের লেশমাত্র নেই চোখে মুখে। বরং শিরদাঁড়া সোজা করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন উত্তরের অপেক্ষায়। পরিচালকের আর সাধ্য কি এমন একজনকে ফেরায়! ব্যাস জুটে গেল অভিনয়ের বরাত। আর বাংলা ছবিও নতুন করে পেল জাত অভিনেতা শমিত ভঞ্জকে।
এর আগেও অবশ্য তিনটি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন শমিত ভঞ্জ, তবে তার মধ্যে দুটিই ছিল ভিড়ে দৃশ্যে, আর অপরটি এক তবলা বাদকের ভূমিকায়। তবে বড়ো চরিত্রে দর্শকের সামনে প্রথম সুযোগ আসে ১৯৬৮ সালে ‘আপনজন’ চলচ্চিত্রের হাত ধরে। হুবহু নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে গেল ছবির ‘ছেনো’ চরিত্রটি। দাপুটে অভিনয়ে মস্তানের চরিত্রেও আপামর বাঙালির হৃদয় জুড়ে বসলেন তিনি।
১৯৪৪ সালের ২ জানুয়ারি অবিভক্ত মেদিনীপুরের তমলুক শহরে জন্ম শমিত ভঞ্জর। ডাক নাম বুবু। এই নামেই অবশ্য পরবর্তীকালে টলিপাড়ায় অনেকেই ডাকতেন তাঁকে। বাবা প্রীতিময় ভঞ্জ ও মা শীলাদেবীর চার সন্তান। তবে ছোট ছেলে শমিত বরাবরই ছিল একটু আলাদা ধরনের। ছোটো থেকে সবেতেই সে বেপরোয়া, দামাল। ভয় ডর নেই এক্কেবারে। তমলুকে জন্মালেও বাবার কর্মসূত্রে পড়াশোনা করেছেন জামশেদপুরের লয়েলা স্কুলে। স্কুলে পড়াকালীনই ছিলেন ডানপিটে। একবার বোন কৃষ্ণাকে তার সহপাঠী চড় মারলে তার ভয়ানক প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। একটা বালি ভর্তি চৌবাচ্চার মধ্যে সেই ছেলেটিকে পুঁতে দিয়ে বালি চাপা দিয়ে দিয়েছিল বছর সাতের শমিত।
আরও পড়ুন - উত্তমের সঙ্গে দারুণ ভাব, অথচ সুচিত্রাকে চলতেন এড়িয়ে, অনুপ কুমারকে কি ভুলেছে বাঙালি?
হ্যাঁ, ছোট থেকে রাগী, জেদী, বেপরোয়া শমিত ভঞ্জ। বড়ো হয়েও সেই স্বভাবের বিশেষ বদল হয়নি।অভিনয় করবেন বলে একদিন বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। নিজ তখনও বেকার, অথচ সেসব কিছুকে পাত্তা না দিয়েই কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন জেদের বশে।
সম্বল বলতে ছিল কেবল অভিনয়ের জেদ আর দারুণ গানের গলা। নিজের চেষ্টায় তবলা বাজানো শিখেছিলেন শমিত ভঞ্জ। পরে অবশ্য কেরামতুল্লার কাছে তালিম নিয়েছিলেন তিনি। তখন কে জানতো, এটাই কাজে লেগে যাবে অবশেষে! ‘নিশাচর’ ও ‘বাদশা’ ছবির ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা ছেলেটিকে আলাদা করে প্রথম দেখা গেল সেই তবলাবাদক রূপেই। ১৯৬৫ সালে বলাই সেনের ‘সুরের আগুন’ ছবিতে।
অভিনয়ের শুরুটা হয় স্কুলে নাটক করা দিয়েই। পরবর্তীকালে পলিটেকনিক পড়া মাঝ পথে ছেড়ে কলকাতায় এসে যোগ দেন সবিতাব্রত দত্তর দল ‘রূপকার’-এ। প্রথম প্রথম সেখানেই বেশ কয়েকটা নাটকে অভিনয় করতে থাকেন শমিত। তবে এতে খিদে মেটেনি দামাল নায়কের। তাই ঘুরতে শুরু করলেন সিনেমা পাড়ায়। অতঃপর তপন সিনহার হাত ধরে হয়ে উঠলেন টলিপাড়ার ‘আপনজন’। আর অবশ্য ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
তবুও আক্ষেপ একটা থেকেই যায়। বড় ভুল সময়ে জন্মেছিলেন শমিত ভঞ্জ। তিনি যখন পা রাখছেন সিনেমায় তখনও উত্তম মোহে আচ্ছন্ন টলিপাড়া। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ইতিমধ্যে অন্য একটা জোনার দখল করে ফেলেছেন। তাই হয়তো আলাদা করে যোগ্য সম্মান জুটল না কোনদিনই। নাহলে হয়তো ঠিক জায়গা হতো হলিউডের ক্লিন্ট ইস্টউড, লি ভন ক্লিফ বা ডেনজেল ওয়াশিংটনের মতো অভিনেতাদের পাশেই। অথচ আপনজন, পরিণীতা, গুড্ডি, ফুলেশ্বরী, অরণ্যের দিনরাত্রি, স্ট্রাইকার, সবুজ দ্বীপের রাজা, আবার অরণ্যে -এর কালজয়ী চলচ্চিত্রে তাঁর দাপুটে অভিনয় আজও পলক ফেলতে দেয়না দর্শকদের। এমনকী বাংলা চলচিত্রের ইতিহাসে ‘কাকাবাবু’র মতো আইডল চরিত্রও প্রথম অভিনয় করেছিলেন তিনিই।
সত্যজিৎ রায় অবশ্য চিরকালই টলিপাড়ার ম্যাজিক ম্যান। কারণ তিনি প্রকৃতই জাত চিনতেন অভিনেতার। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে শমিত ভঞ্জকে নিয়েছেন মানিক বাবু, ব্যাস চাকা ঘুরে গেল ভাগ্যের। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। সেই বছর অজিত গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রূপসী’ও মুক্তি পায়। তারপর থেকে টানা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর তিন থেকে চারটি করে ছবি মুক্তি পায় শমিতের। তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, দীনেন গুপ্তর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘ফেরা’ -এর পাশাপাশি হিন্দি ছবির জগতেও বীরদর্পে পা রাখলেন তিনি। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘গুড্ডি’ দিয়েই অন্য এক শমিতকে চিনল দর্শক। এরপর ওহি রাত ওহি আওয়াজ’, ‘অনজানে মেহমান’ ও ‘কিতনে পাস কিতনে দূর’, এই তিনটি হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেন তিনি।
হাটে বাজারে ছবিতে অভিনয় করতে এসে আলাপ হয় আরেক কিংবদন্তি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কলকাতায় তখন চালচুলোহীন অবস্থা শমিতের, তার ওপর আবার বিয়ে করে বসেছেন। অগত্যা নিজের বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরের একটি ঘরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কৃতজ্ঞ শমিতের মুখে প্রায়ই শোনা যেত, “ভানুদা না থাকলে হয়তো আমি হারিয়েই যেতাম।”
আরও পড়ুন - সুচিত্রা বলতেন ‘দুষ্টু ছেলে’, ডার্লিং মুনের প্রেমে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম আমি…
অতঃপর ছেলের জনপ্রিয়তা দেখে বেশি দিন রাগ করে থাকতে পারলেন না বাবা -মা। তমলুক থেকে গোটা পরিবার উঠে এল কলকাতার ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে। জমিয়ে হুল্লোড় করতে আর খেতে ভালোবাসতেন শমিত ভঞ্জ। অন্যান্য অভিনেতাদের মতো চেহারা ঠিক রাখতে খাওয়া দাওয়ায় কোনও দিনই কৃপণতা করেননি তিনি। জীবনকে চেটেপুটে উপভোগ করতে ভালোবাসতেন তিনি। নিজেও যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমনই অন্যদের নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াতেও খুব ভালোবাসতেন। যেন বাস্তবের ‘ভজহরি মান্না’ তিনিই। অত বড় অভিনেতা হয়েও ছিলেন ছাপোষা মধ্যবিত্ত, এবং নিতান্ত ফ্যামিলি ম্যান। পরিবারের সঙ্গে মিশে থাকতে ভালোবাসতেন সব সময়।
এ হেন একজন অভিনেতা ১৯৯৫ সালের পর থেকে হঠাৎই আরেক চলে গেলেন। ওই বছর ‘প্রতিধ্বনি’ ও ‘মোহিনী’ ছবি দুটির পর থেকে টানা চার বছর পুরোপুরি বেপাত্তা এমন একজন অভিনেতা। মাঝে শোনা যায়, ‘উল্টো পাল্টা’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করছেন শমিত ভঞ্জ। কিন্তু সে কাজও শেষ করতে পারলেন না। অবশেষে ১৯৯৯ সাল নাগাদ সামনে আসে আসল রহস্য। তাঁর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। খুবই অসুস্থ তখন তিনি, কিন্তু ওই চিরকেলে বেপরোয়া জেদ তো যাওয়ার নয়। আর সেটা আঁকড়ে ধরেই জীবনের শেষ ছবিতে আবারও অভিনয় করতেন শমিত ভঞ্জ। বন্ধু গৌতম ঘোষের পরিচালনায় ২০০৩ সালে মুক্তি পেল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির সিক্যুয়েল ‘আবার অরণ্যে’।
ডাক্তার, রোগ সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জেদী সেই দামাল ছেলেটা সেদিন নিজের জীবনের শেষ অভিনয়ে আবারও হয়ে উঠলেন “ফ্যান্টাস্টিক!” শেষ ছবির প্রথম প্রিন্ট তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ঠিকই তবে হলে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগ আর হয়নি। কিন্তু বাংলা ছবির দর্শক দেখেছিল সবটাই। দেখেছিল কতটা ইচ্ছাশক্তি থাকলে এমন শমিত ভঞ্জ হওয়া যায়! তাঁকে কি বাংলা সিনেমার প্রথম ‘আধুনিক নায়ক’ বললে খুব ভুল হয়?